দেনা-পাওনা

জীবানন্দ কৌতূহলী হইয়া উঠিল, কহিল, এঁর সদুপদেশেই বোধ করি তিনি চলে যাচ্চেন?

প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। বরঞ্চ এঁর উপদেশের বিরুদ্ধেই তিনি চলে যাচ্চেন।

জীবানন্দ উপহাস করিয়া কহিল, বল কি প্রফুল্ল, ফকিরসাহেব শুনি যে তাঁর গুরু! গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?

প্রফুল্ল কহিল, এ ক্ষেত্রে তাই বটে।

কিন্তু এত বড় বিরাগের হেতু?

প্রফুল্ল কহিল, বিরাগের হেতু আপনি। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কি জানি এ কথা আপনাকে শোনানো ভাল হবে কি না, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন—পাছে কলহ-বিবাদের মধ্য দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সকলের চেয়ে বড় ভয়। নইলে দেশের লোককে তিনি ভয় করেন নি।

জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে তাহার প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

প্রফুল্ল একটুখানি হাসিয়া কহিল, দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, কি হাত পেতে নিয়ে আপনিই মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল, যদি বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাবো আশা হয়।

জীবানন্দ এ কথারও কোনও উত্তর দিল না, তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।

সন্ধ্যা হয়-হয়, বেহারা পাত্র ভরিয়া মদ আনিয়া উপস্থিত করিল; জীবানন্দ হাত নাড়িয়া কহিল, নিয়ে যা—দরকার নেই।

ভৃত্য বুঝতে না পারিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে প্রফুল্ল কহিল, কখন দরকার সেইটে বলে দিন না।

জীবানন্দ সহসা কখন যেন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, প্রফুল্লের প্রশ্নে চোখ তুলিয়া কহিল, এখন ত নিয়ে যা—দরকার হলে ডেকে পাঠাবো। সে চলিয়া যাইতেছিল, জীবানন্দ ডাকিয়া কহিল, হাঁ রে, তোদের চা আছে?

প্রফুল্ল কহিল, শোন কথা! চা নেই ত আমি বেঁচে আছি কি করে?

তবে, তাই এক বাটি নিয়ে আয়।

বেহারা প্রস্থান করিলে প্রফুল্ল প্রশ্ন করিল, অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে?

জীবানন্দ বলিল, অরুচি নয়—কিন্তু আর খাবো না।

প্রফুল্ল হাসিল, এবং ক্ষণেক পূর্বে তাহারই প্রতি প্রযুক্ত বিদ্রূপ ফিরাইয়া দিয়া কহিল, এই নিয়ে ক’বার হ’লো দাদা?

জীবানন্দ রাগ করিল না, সেও হাসিয়া তাহারই অনুকরণ করিয়া কহিল, এ মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।

প্রফুল্ল মুখ টিপিয়া শুধু একটু হাসিল, প্রত্যুত্তর করিল না।

চাকর আলো দিয়া গেল। ক্রমশঃ সন্ধ্যার অন্ধকার যখন বাহিরে গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, জীবানন্দ হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, যাই একটু ঘুরে আসি—

প্রফুল্ল আশ্চর্য হইয়া কহিল, কৈ, কাপড় ছাড়লেন না?

থাক গে।

আপনার সহচর? গাদা পিস্তলটি?

সেও থাক! আজ একলাই ঘুরতে চললাম।

প্রফুল্ল ভয়ানক আপত্তি করিয়া বলিল, না না, সে হয় না দাদা। অন্ধকার রাত, পথে ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। এই বলিয়া সে তাড়াতাড়ি দেরাজ হইতে পিস্তল বাহির করিয়া হাতে গুঁজিয়া দিতে গেল।

জীবানন্দ দুই-পা পিছাইয়া গিয়া কহিল, ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল—

প্রফুল্ল বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, হঠাৎ হলো কি দাদা? না হয় পাইকদের ডেকে দিই, তাদের কেউ সঙ্গে যাক।

জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া কহিল, না, তাও না। আজ থেকে আমি এমনি একলা বার হব, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার, আর আমার থেকে কারও কোন ভয় না হোক; তার পরে যা হয় তা আমার ঘটুক—আমি কারও কাছে নালিশ করব না। এই বলিয়া সে অন্ধকারে ধীরে ধীরে একাকী বাহির হইয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – চব্বিশ

পরিপূর্ণ সুরাপাত্র অসম্মানে ফিরিয়া গেল দেখিয়া প্রফুল্ল ব্যঙ্গ করিয়াছে। করিবারই কথা। লিভারের দুঃসহ যাতনায় ও চিকিৎসকের তাড়নায় শয্যাগত জীবানন্দের জীবনে এ অভিনয় আরও হইয়া গেছে; কিন্তু স্বেচ্ছায়, সুস্থদেহে মদের বদলে চা খাইয়া বাটীর বাহির হওয়া খুব সম্ভব এই প্রথম। সমস্ত জগৎটা তাহার বিস্বাদ ঠেকিল, এবং শান্তিকুঞ্জের ঘন-ছায়ায় ঘেরা পথের মধ্যে যেদিকে চাহিল, সেই দিক হইতেই একটা অস্ফুট কান্নার সুর আসিয়া যেন তাহার কানে বাজিতে লাগিল। তাহার অভ্যস্ত জীবনের নীচে তাহারই যে আরও একটা সত্যকার জীবন আজও বাঁচিয়া আছে এ খবর সে জানিত না। গেট পার হইয়া যখন মাঠের পথে বাহির হইয়া আসিল, তখন সন্ধ্যার ধূসর আকাশ ধীরে ধীরে রাত্রির অন্ধকারে পরিণত হইতেছিল। একদিকে শীর্ণ নদীর বালুময় শুষ্ক সৈকত আঁকিয়া বাঁকিয়া দিগন্তে অদৃশ্য হইয়াছে, আর একদিকে বৈশাখের শষ্প-শস্যহীন বিস্তৃত ক্ষেত্র চণ্ডীগড়ের পাদমূলে গিয়া মিশিয়াছে। পথে পথিক নাই, মাঠে কৃষকদের আর দেখা যায় না, রাখাল বালকেরা গোচারণের কাজ আজিকার মত শেষ করিয়া গৃহে ফিরিয়া গেছে—সান্ধ্য আকাশতলে জনহীন ভূখণ্ডের এই স্তব্ধ বিষণ্ণ মূর্তি আজ তাহার কাছে অত্যন্ত করুণ ও অদ্ভুত মনে হইল। এই পথে, এমনি নির্জন সন্ধ্যায় সে আরও কতবার যাতায়াত করিয়াছে; কিন্তু এতদিন ধরিত্রী যেন এই তাঁহার শান্ত দুঃখের ছবিখানি মাতালের রক্তচক্ষু হইতে একান্ত সঙ্কোচে গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন। ওপারের রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তর বহিয়া উষ্ণ বায়ু আসিয়া মাঝে মাঝে তাহার গায়ে লাগিতেছিল; কিছুই নূতন নয়—সেইদিকে চাহিয়া অকস্মাৎ রুদ্ধ অভিমানের কান্নায় যেন আজ তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, মা পৃথিবী, তোমার দুঃখের তপ্ত নিশ্বাসটুকুও কি লজ্জায় এতদিন চেপে রেখেছিলে, পাষণ্ড বলে জানতে দাওনি? সংসারে আপনার বলতে আমার কেউ নেই, নিজের ছাড়া কারও সুখ-দুঃখের কখনও ভাগ পাইনি—সেও কি মা, আমার দোষ? আজ আছি, কাল যদি না থাকি, দুনিয়ার কারও ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই, এ কথা কি তুমিই কোনদিন ভেবেচ মা?

এ অভিযোগ যে সে কাহার কাছে করিল, মা বলিয়া যে সে বিশেষ কাহাকে লক্ষ্য করিয়া ডাকিল, বোধ হয় সে নিজেই ঠিকমত উপলব্ধি করে নাই, তথাপি গিরিগাত্র-স্খলিত উপলখণ্ড-সকল যেমন নির্ঝরের পথ ধরিয়া আপনার ভারবেগে আপনিই গড়াইয়া চলে, তেমনি করিয়াই তাহার সদ্য উৎসারিত আকস্মিক বেদনার অনুভূতি চোখের জলের পথ ধরিয়া কথার মালা গাঁথিয়া গাঁথিয়া নিরন্তর বহিয়া চলিতে লাগিল। মাঠের জলনিকাশের জন্য চাষারা একবার এই পথের উপর দিয়া নালা কাটিয়া দিয়াছিল।

0 Shares