দেনা-পাওনা

নন্দী মহাশয়ের আদেশ অর্জন করিবার মত প্রচুর দক্ষিণা যখন তাহারা কোনমতেই সংগ্রহ করিতে পারে নাই, তখনই শুধু সর্বনাশ হইতে আত্মরক্ষা করিতে এই কাজ করিয়াছিল; কিন্তু দরিদ্রের এই দুঃসহ স্পর্ধা এককড়ি হুজুরের গোচর করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, নিরুপায়ের অশ্রুজলে ভ্রূক্ষেপমাত্র করেন নাই। স্থানটা তখন পর্যন্ত অসমতল অবস্থাতেই ছিল। দরিদ্র-পীড়নের এই উৎকট চিহ্ন এই পথে কতবারই ত তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, কিন্তু আজ ইহাই চোখে পড়িয়া দুই চোখ অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিল। মনে মনে কহিল, আহা! কত ক্ষতিই না জানি হয়েছে! কত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে হয়ত পেট ভরে দু’বেলা খেতেও পাবে না। কেনই বা মানুষে এ-সব করে? জায়গাটা অন্ধকারেই ক্ষণকাল পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিল, হাতে টাকা থাকলে কালই মিস্ত্রি লাগিয়ে এটা বাঁধিয়ে দিতাম, প্রতি বৎসর এ নিয়ে আর তাদের দুঃখ পেতে হতো না। আচ্ছা, কত টাকা লাগে? সে পথ ছাড়িয়া মাঠে নামিয়া গেল, এবং সমস্তটা মন দিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল। এ-সম্বন্ধে কোন ধারণাই তাহার ছিল না, কত ইঁট, কত চুন-বালি, কত কাঠ, কি কি আবশ্যক কিছুই সে জানিত না, কিন্তু কথাটা তাহাকে যেন পাইয়া বসিল। সেইখানে ভূতের মত অন্ধকারে একাকী দাঁড়াইয়া সে কেবলই মনে মনে হিসাব করিতে লাগিল, এই ব্যয় তাহার সাধ্যাতীত কি না।

পথের ও-ধার দিয়া কি একটা ছুটিয়া গেল? হয়ত কুকুর কিংবা শিয়াল হইবে, কিন্তু তাহার চমক ভাঙ্গিল। পরের জন্য দুঃখ বোধ করা এমনই অভ্যাসবিরুদ্ধ যে, চমক ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই ইহার সমস্ত তামাশাটা একমুহূর্তে ধরা পড়িয়া তাহার ভারী হাসি পাইল। তাড়াতাড়ি রাস্তায় উঠিয়া আসিয়া শুধু বলিল, বাঃ, বেশ ত কাণ্ড! কেউ যদি দেখে ত কি ভাববে! জীবানন্দ আজ মদ না খাইয়াই বাহির হইয়াছিল, তাহার আজিকার এই মনের দুর্বলতার হেতু সে বুঝিল, অবসাদগ্রস্ত চিত্তের মাঝে কেন যে আজ অকারণে কেবল কান্নার সুরই বাজিয়া উঠিতেছে, ইহারও কারণ বুঝিতে তাহার বিলম্ব ঘটিল না। আরও একটা জিনিস, নিজের সম্বন্ধে আজ তাহার প্রথম সন্দেহ হইল যে দীর্ঘদিনের অভ্যাস আজ তাহার সর্বাঙ্গ ঘেরিয়া একেবারে স্বভাবে রূপান্তরিত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আপনাকে আপন বলিয়া দাবী করিবার দাবী হয়ত তাহার চিরদিনের মত হাতের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। কিসের জন্য বাটীর বাহির হইয়াছিল ঠিক স্মরণ করিতে পারিল না, ঝোঁকের মাথায় জোর করিয়া যখন ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়াছিল, তখন স্থিরসঙ্কল্প হয়ত কিছুই ছিল না, হয়ত অগোচরে অস্পষ্টরূপে অনেক কথাই ছিল—যাহা এখন একেবারে লেপিয়া একাকার হইয়া গেল।গৃহত্যাগের কোন উদ্দেশ্যই মনে পড়িল না। কিন্তু গৃহে ফিরিতেও ইচ্ছা করিল না। কিছুদূর অগ্রসর হইয়া রাস্তা ছাড়িয়া পায়ে-হাঁটা যে পথটা মাঠের উপর দিয়া কোনাকুনি চণ্ডীগড়ের দক্ষিণ ঘুরিয়া গিয়াছে, অন্ধকারে সেই পথেই সে পা বাড়াইল।

পথটা দীর্ঘ এবং বন্ধুর, প্রতি পদক্ষেপেই বাধা পাইতে লাগিল, কিন্তু ধাক্কা খাইয়া, হোঁচট খাইয়া পথ চলিতে চলিতে বিক্ষিপ্ত চিত্ততল তাহার কখন যে ইট, কাঠ, চুন এবং সুরকির চিন্তায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, সে জানিতেও পারিল না।

জিনিসটা কিছুই নয়, ছোট একটা সাঁকো, বীজগ্রামের জমিদারের কাছে তাহার চেয়ে তুচ্ছ বস্তু আর ত কিছু হইতেই পারে না। সেটা তৈরি করার মধ্যে না আছে শিল্প, না আছে সৌন্দর্য; তবুও এই শিল্পসৌন্দর্যহীন সামান্য বস্তুটাই যেন কত দুঃখীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশিয়া তাহার মনের মধ্যে আজ এক নূতন রসে ভরিয়া অসামান্য হইয়া দেখা দিল! তাহাকে কতপ্রকারে ভাঙ্গিয়া কতরকমে গড়িয়া সে যেন আর শেষ হইতেই চাহিল না। অথচ এ-সকল যে শুধু তাহার অবসন্ন মনের ক্ষণস্থায়ী খেয়াল, সত্যবস্তু নয়, কাল দিনের বেলা ইহার চিহ্নমাত্র রহিবে না, এ কথাও সে বিস্মৃত হইল না, উৎসবের মাঝে গোপন শোকের মত কোথায় যেন বিঁধিয়াই রহিল। অথচ আজ রাত্রির মত এই ছেলেমানুষিটাকে সে কোনমতেই ছাড়িতে পারিল না, প্রশ্রয় দিয়া দিয়া কল্পনার পরে কল্পনা যোজনা করিয়া অবিশ্রাম চলিতে লাগিল।

সহসা কালো আকাশপটে চণ্ডী মন্দিরের চূড়া দেখা দিল। এতদূর আসিয়াছে তাহার হুঁশ ছিল না; আরও কাছে আসিয়া মন্দিরের ছোট দরজাটা তখনও খোলা আছে দেখিতে পাইয়া নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করিল। দেবীর আরতি অনেকক্ষণ শেষ হইয়া গেছে, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ, সমস্ত প্রাঙ্গণে ঘোর অন্ধকার, শুধু নাটমন্দিরের একধারে মিটমিট করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছে। জীবানন্দ নিকটে গিয়া দেখিল জন চার-পাঁচ মশার ভয়ে আগাগোড়া মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে, শুধু কে একজন থামের আড়ালে চুপ করিয়া বসিয়া মালা জপ করিতেছে। জীবানন্দ আরও একটু কাছে গিয়া লোকটিকে দেখিবার চেষ্টা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে তুমি?

লোকটি জীবানন্দের ধপধপে সাদা পরিচ্ছদ অন্ধকারেও অনুভব করিয়া তাঁহাকে ভদ্রব্যক্তি বলিয়া বুঝিল, কহিল, আমি একজন যাত্রী বাবু।

ওঃ—যাত্রী! কোথায় যাবে?

আজ্ঞে, আমি যাবো শ্রীশ্রীপুরীধামে।

কোথা থেকে আসচো? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী? এই বলিয়া জীবানন্দ ঘুমন্ত লোকগুলিকে দেখাইয়া দিল।

লোকটি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আজ্ঞে না, আমি একাই আসচি মানভূম জেলা থেকে। এদের কারও বাড়ি মেদিনীপুর, কারও বাড়ি আর কোথাও—কোথায় যাবে তাও জানিনে। দু’জন ত কেবল আজ দুপুরবেলাতে এসেছে।

জীবানন্দ জিজ্ঞাসা করিল,আচ্ছা, কত লোক এখানে রোজ আসে? যারা থাকে তারা দু’বেলা খেতে পায়, না?

লোকটা বিব্রত হইয়া পড়িল। লজ্জিতভাবে কহিল, কেবল খাবার জন্যেই সবাই থাকে না বাবু। পায়ে-হাঁটা আমার অভ্যাস ছিল না, তাই ফেটে গিয়ে ঘায়ের মত হল। মা ভৈরবী নিজের চোখে দেখে হুকুম দিলেন, যতদিন না সারে এখানে থাকো।

0 Shares