দেনা-পাওনা

জীবানন্দ কহিল, বেশ ত, থাকো না। জায়গার ত আর অভাব নেই হে।

কিন্তু মা ভৈরবী ত আর নেই শুনতে পেলাম।

জীবানন্দ হাসিয়া কহিল, এরই মধ্যে শুনতে পেয়েচ? তা না-ই তিনি থাকলেন, তাঁর হুকুম ত আছে। তোমাকে যেতে বলে সাধ্য কার? তোমার যতদিন না পা সারে, তুমি থাকো। এই বলিয়া জীবানন্দ তাহার কাছে আসিয়া বসিল।

লোকটা প্রথমে একটু ভয় ও সঙ্কোচ অনুভব করিল, কিন্তু সে ভাব রহিল না। এবং দেখিতে দেখিতে অন্ধকার এই নির্জন নিস্তব্ধ দেবায়তনের একান্তে পরাক্রান্ত এক ভূস্বামী ও দীন গৃহহীন আর এক ভিক্ষুকের সুখ-দুঃখের আলোচনা একেবারে ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিল। লোকটির নাম উমাচরণ, জাতিতে কৈবর্ত, বাটী আগে ছিল মানভূম জেলার বংশীতট গ্রামে। গ্রামে অন্ন নাই, জল নাই, চিকিৎসক নাই—এ যাঁহার ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি, তিনি পশ্চিমের কোন এক শহরে ওকালতি করেন। রাজায় প্রজায় প্রীতি নাই, সম্বন্ধ নাই, আছে শুধু শোষণ করিবার বংশগত অধিকার। এই ফাল্গুনের শেষে বিসূচিকা রোগে তাহার স্ত্রী মরিয়াছে, উপযুক্ত দুই পুত্র একে একে চোখের উপর বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে, সে কোন উপায় করিতে পারে নাই; অবশেষে জীর্ণ ঘরখানি সে তাহার বিধবা ভ্রাতুষ্কন্যাকে দান করিয়া চিরদিনের মত গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। এ জীবনে আর তাহার ফিরিবার আশা নাই, ইচ্ছা নাই; এই বলিয়া সে ছেলেমানুষের মত হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। জীবানন্দের চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। পরের কান্না তাহার কাছে নতুন বস্তু নয়, এ সে জীবনে অনেক দেখিয়াছে, কিন্তু কোনদিন এতটুকু দাগ পর্যন্ত ফেলিতে পারে নাই, আজও সে ছাড়া আর কেহ জানিতেও পারিল না, কিন্তু অন্ধকারে জামার খুঁট দিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল কোথাও ছুটিয়া গিয়া যে স্ত্রী তাহার মরে নাই, যে ছেলে তাহার জন্মে নাই, যে গৃহ তাহাকে ত্যাগ করিয়া আসিতে হয় নাই, তাহাদেরই জন্য এই অপরিচিত লোকটার মতই ডাক ছাড়িয়া কাঁদে। খানিক পরে সে কতকটা আত্মসংবরণ করিয়া কহিল, বাবু, আমার মত দুঃখী আর সংসারে নেই।

জীবানন্দ কহিল, ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।

ইহার তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করিবার মত শিক্ষা বা শক্তি এই সামান্য লোকটার ছিল না, জীবানন্দ নিজেও তাহা আশা করিল না, কিন্তু থামিতেও পারিল না। তাহার অশ্রুসিক্ত কণ্ঠস্বরের অপূর্বতা তাহার কানে এমন অমৃত সিঞ্চন করিল যে, সে লোভ সে সামলাইতে পারিল না। বলিতে লাগিল, দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নাই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই মানুষ তাকে টের পায়। কিন্তু কোন্‌ পথে যে তার আনাগোনা আজও কেউ তার খোঁজ পেলে না। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও—অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তুমি চিনতে পারনি।

লোকটি চুপ করিয়া রহিল। কথাও বুঝিল না, সাথী যে কে আছে তাহাও জানিল না।

জীবানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তুমি মায়ের নাম করছিলে ভাই, আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম, কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা হবে।

লোকটি কহিল, আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কাল সকালেই চলে যেতে হবে।

চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা সারেনি, তুমি হাঁটতে পারো না।

সে কহিল, মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম, তিনদিনের বেশী আর কেউ থাকতে পারবে না।

জীবানন্দ হাসিয়া কহিল, ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে! মা চণ্ডীর কপাল ভাল! এই বলিয়া হঠাৎ তাহার একটা কথা মনে পড়িয়া ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?

সে কহিল, যারা তিনদিন আসেনি তারা সবাই মায়ের প্রসাদ পেলে।

আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশী হয়ে গেছে!

লোকটি ভালমানুষ, সহসা কাহারও নিন্দা করা স্বভাব নয়, বলিল, ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।

তাই হবে। বলিয়া জীবানন্দ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল। খুব সম্ভব অনাহূত যাত্রীদের সম্বন্ধে পূর্ব হইতেই এমনি একটা নিয়ম ছিল, কিন্তু ষোড়শী তাহা মানিয়া চলিতে পারিত না। এখন তারাদাস এবং এককড়ি নন্দী উভয়ে মিলিয়া জমিদারের নাম করিয়া সে ব্যবস্থা অক্ষরে অক্ষরে প্রবর্তিত করিবার চেষ্টা করিয়াছে। এই যদি হয়, অভিযোগ করিবার খুব বেশী হেতু নাই, কিন্তু মন তাহার কোনমতেই এ কথা স্বীকার করিতে চাহিল না। অন্তর হইতে সে বার বার কহিতে লাগিল, এমন হইতেই পারে না! এমন হইতেই পারে না! বুভুক্ষুকে আহার দিবার আবার বিধিব্যবস্থা কি! ওই যে ক্ষুধার্ত অতিথি ওইখানে অনাহারে বসিয়া রহিল, ক্ষুধাকে তাহার বাঁধিয়া রাখিবে ইহারা কোন্‌ আইনকানুনে? কহিল, ওহে ভাই, কাল আবার আমি আসব, কিন্তু চুপি চুপি চলে যেতে পারবে না, তা বলে যাচ্ছি।

কিন্তু ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলেন?

জীবানন্দ কহিল, বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? ধীরে ধীরে বাহির হইয়া যাইতেছিল, হঠাৎ মন্দিরের বারান্দায় থামের আড়ালে মানুষের চাপা-গলা শুনিয়া বিস্মিত হইল। প্রথমে মনে করিল, নিভৃতে কেহ আরাধনা করিতে আসিয়াছে, কিন্তু কথাটা তাহার কানে গেল। কে একজন বলিতেছে, আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেচে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতে ছাড়ব না বলে দিচ্চি।

অন্যজন জবাব দিল, মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো—ফাঁসি যেতে হয়, তাও যাবো।

আর একজন বলিল, হঃ—আমাদের আবার জেল! আমাদের আবার ফাঁসি! মা চলে যেতে চাচ্চে, আগে যাক—

অন্ধকারে না চিনিল মানুষ, না চিনিল গলা, তবু মনে হইল একজনের গভীর কণ্ঠস্বর সে কোথাও যেন শুনিয়াছে, একেবারে অপরিচিত নয়। চেষ্টা করিলে হয়ত মনে করিতেও পারিত, কিন্তু আজ তাহার সেদিকে মনই গেল না। সে ত অনেকের অনেক সর্বনাশ করিয়াছে—অতএব নিজেই ত সে ইহার লক্ষ্য হইতে পারে, কিন্তু আজ তাহা নির্ণয় করিবার ইচ্ছাই হইল না। মনে মনে হাসিয়া কহিল, বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়! আহা!

0 Shares