দেনা-পাওনা

অলক্ষ্যে নিঃশব্দে যখন বাহির হইয়া আসিল তখন রাত্রি বোধ হয় দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। নির্মল কালো আকাশ তারায় তারায় ঠাসা। সেই অসংখ্য নক্ষত্রলোক হইতে ঝরিয়া অদৃশ্য আলোকের আভাস অন্ধকার পথের মাটিকে ধূসর করিয়া দিয়াছে। তাহারই মাঝে মাঝে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কঠিন মাটির স্তূপ পথশ্রান্ত পথিকের মত কতকাল ধরিয়া যেন নিঃশব্দে বসিয়া আছে তাহার ইতিহাস নাই, তাহারই একটি পাশে গিয়া সে ঠিক তেমনি করিয়াই ধূলার উপর বসিয়া পড়িল।

সুমুখে কতকটা পতিত জমির একধারে ষোড়শীর কুটীর, গাছের আড়ালে বেশ স্পষ্ট দেখা না গেলেও তাহার মনে হইল অনেকগুলি মানুষ যেন সার বাঁধিয়া বাহির হইয়া আসিল, এবং অনতিদূর দিয়া যখন চলিয়া গেল, তখন ইহাদের কথাবার্তা হইতে জীবানন্দ এইটুকু সংগ্রহ করিল যে, ষোড়শীর গোযান আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এবং কাল প্রত্যুষেই সে চণ্ডীগড় ত্যাগ করিয়া যাইবে। ভক্ত প্রজার দল তাহার পদধূলি লইয়া ঘরে ফিরিতেছে। ষোড়শীকে নিষেধ করিবার পথ নাই, নিষেধ করিলে সে শুনিবে না, এই কয়দিনে এতটুকু তাহাকে সে চিনিয়াছে—কিন্তু মন তাহার ব্যথায় ভরিয়া উঠিল। সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে ইহার বিরুদ্ধে যত অন্যায় করিয়াছে, একটি একটি করিয়া এতকাল পরে তাহার তালিকা করা অসম্ভব, কিন্তু সেই-সকল অগণিত অত্যাচারের সমষ্টি আজ তাহার চোখের উপর স্তূপাকার হইয়া উঠিল।

ইহাকে সরাইয়া রাখিবার স্থান সংসারে সে কোথাও দেখিল না। স্ত্রী বলিয়া স্বীকার করিতে যাহাকে লজ্জাবোধ করিয়াছে, গণিকা বলিয়া তাহাকেই কামনা করিবার শয়তানী সে যে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া পাইল না। আজ সমস্ত হৃদয় তাহার ষোড়শীকে একান্ত-মনে চাহিতেছে, এ তাহার অধিকারের দাবী, অথচ চিরদিন ইহাকেই উপেক্ষা করিয়া, অপমান করিয়া, মিথ্যার পরে মিথ্যা জমা করিয়া, সে যে প্রাচীর গড়িয়া তুলিয়াছে, আজ তাহাকে লঙ্ঘন করিবার পথ তাহার কৈ?

হঠাৎ সম্মুখেই দেখিতে পাইল কে একজন দ্রুতপদে চলিয়াছে। তাহাকে অন্ধকারে চিনিতে বিলম্ব হইল না, ডাকিল, অলকা?

ষোড়শী চমকিয়া দাঁড়াইল। এ যে জীবানন্দ তাহা সে ডাক শুনিয়াই বুঝিয়াছিল। একটু সরিয়া আসিয়া তিক্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি এখানে কেন?

জীবানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কি জানি, এমনিই বসে ছিলাম। তুমি যাত্রার আগে ঠাকুর প্রণাম করতে যাচ্চো, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।

এই একটা বেলার মধ্যে তাহার কণ্ঠস্বরে কি যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়াছে, ষোড়শী বিস্ময়ে মৌন হইয়া রহিল। ক্ষণেক পরে কহিল, আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে, সে ত আপনি জানেন।

জীবানন্দ বলিল, জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারে নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র—একগাছা লাঠিও সঙ্গে নেই।

ষোড়শী কহিল, শুনেচি। প্রফুল্লবাবু আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, তাঁর কাছে খবর পেলাম আজ আপনি নিরস্ত্র বাড়ি থেকে একলা বেরিয়ে গেছেন, এবং—

এবং ঝোঁকের উপর মদ না খেয়ে বার হয়ে গেছি, না?

ষোড়শী কহিল, হাঁ। কিন্তু চণ্ডীগড়ে এ কাজ আর আপনি ভবিষ্যতে করবেন না।

জীবানন্দ কহিল, এ কাজ আমি প্রত্যহ করব এবং যতদিন বাঁচব—করব। প্রফুল্ল তোমাকে এত কথা বলেচে, এ কথা বলেনি যে, এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি পৃথিবীতে আমার শত্রু আছে এ আমি একদিনও আর স্বীকার করব না?

ষোড়শী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইহার যুক্তি লইয়াও তর্ক করিল না, এ কথার স্থায়িত্ব লইয়াও প্রশ্ন করিল না। জীবানন্দের মুখের চেহারা অন্ধকারে সে দেখিতে পাইল না, কিন্তু এই তাহার অদ্ভুত কণ্ঠস্বর নিশীথে এই নির্জন প্রান্তরের মধ্যে তাহার দুই কান ভরিয়া এক আশ্চর্য সুরে বাজিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে কহিল, আমার সঙ্গে মন্দিরে গিয়ে আপনার কি হবে?

জীবানন্দ কহিল, কিছুই না। শুধু যতক্ষণ আছ, সঙ্গে থাকব, তার পরে যখন যাবার সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাবো।

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারিল না। জীবানন্দ কহিল, যাবার দিনে আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না অলকা। আমার জীবনের দাম তুমি ত জানো, আর হয়ত দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কতরকমে দয়া করে গেছ, আমার শেষ দিন পর্যন্ত আমি সেই-সব কথাই স্মরণ করব।

ষোড়শী কহিল, আচ্ছা আসুন—এই বলিয়া সে অগ্রসর হইল।

মিনিট-দুই নিঃশব্দে চলার পরে জীবানন্দ কহিল, লোকে বলে, ও দয়ার যোগ্য নয়। আচ্ছা অলকা, দয়ার আবার যোগ্যতা অযোগ্যতা কি? দয়া যে করে সে ত নিজের গরজেই করে। নইলে, দয়া পাবার যোগ্যতা আমার ছিল এত বড় দোষারোপ করতে ত শুধু অতি বড় শত্রু নয়, তুমি পর্যন্ত পারবে না।

ষোড়শী মৃদুস্বরে বলিল, আমার চেয়ে আপনার বড় শত্রু সংসারে বুঝি আর কেউ নেই?

জীবানন্দ বলিল, না।

মন্দিরে প্রবেশ করার পরে জীবানন্দ হঠাৎ বলিয়া উঠিল, মজা দেখ অলকা, যাদের নিজের অন্ন নেই, সংসারে তারাই অপরের অন্নে সবচেয়ে বড় বাধা। ষোড়শী জিজ্ঞাসু-মুখে ফিরিয়া চাহিতে কহিল, আজ আমি এতক্ষণ পর্যন্ত এই মন্দিরেই বসে ছিলাম। ভৈরবী নেই, এখন জমিদার কর্তা। হুজুরের নাম করে তাই এরই মধ্যে যাত্রীদের উপর তে-রাত্রির আইন জারি হয়ে গেছে। তোমার সেই যে খোঁড়া অতিথিটি, পা না সারা পর্যন্ত যাকে তুমি থাকতে অনুমতি দিয়েছ, তার মুখেই শুনতে পেলাম হুজুরের কড়া হুকুমে আজ তার অন্ন বন্ধ। সে বেচারা অভুক্ত বসে চণ্ডীনাম জপ করছিল—হুজুরের কল্যাণ হোক, কাল সকালেই নাকি আবার তাকে চলে যেতে হবে, পা-দুটো তার থাক আর যাক।

ষোড়শী কহিল, আমার বাবা বুঝি হুকুম দিয়েছেন?

জীবানন্দ বলিল, শুধু তোমার বাবা কেন, গরীব-দুঃখীর প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য করতে অনেক বাবাই এ গ্রামে আছেন, আর হুজুরের সুনামে ত স্বর্গ-মর্ত্য ছেয়ে গেল। লোকটার কাছে বসে বসে তাই ভাবছিলাম অলকা, তোমার যাবার পরে সন্ন্যাসিনীর আসনে বসে এই সব বাবার দল যে তাণ্ডব-কাণ্ড বাধাবে তাকে আমি সামলাবো কি করে?

0 Shares