দেনা-পাওনা

ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।

জীবানন্দ নিজেও বহুক্ষণ অবধি মৌন থাকিয়া মনে মনে কত কি যেন ভাবিতে লাগিল, অকস্মাৎ একসময়ে বলিয়া উঠিল, তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?

ষোড়শী শান্তকণ্ঠে শুধু কহিল, না। তার পরে সে উঠিয়া গিয়া রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রণাম করিয়া যখন ফিরিয়া আসিল, জীবানন্দ কহিল, আর একটা দিন?

ষোড়শী বলিল, না।

তবে সকল অপরাধ আমার এইখানে দাঁড়িয়ে আজ ক্ষমা করে যাও।

কিন্তু তাতে কি আপনার খুব বেশী প্রয়োজন আছে?

জীবানন্দ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, এর উত্তর আজ দেবার আমার শক্তি নেই। এখন কেবল এই কথাই আমার সমস্ত মন ছেয়ে আছে অলকা, কি করলে তোমাকে একটা দিনও ধরে রাখতে পারি। উঃ—নিজের মন যার পরের হাতে চলে যায়, সংসারে তার চেয়ে নিরুপায় বুঝি আর কেউ নেই। আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ, লোকে জানবে আমি তোমাকেই শাস্তি দিয়েচি, তুমি সহ্য করেচ, আর নিঃশব্দে চলে গেছ। তুমি যাবার আগে তোমার মা-চণ্ডীকে জানিয়ে যাও, যে এর চেয়ে মিথ্যে আর নেই।

ষোড়শী কোন উত্তর না দিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিবার মুখে সহসা জীবানন্দ দুই হাত প্রসারিত করিয়া কহিল, তোমার ঠাকুরের সুমুখে দাঁড়িয়ে আজ এই কথাটি আমাকে বলে দাও, কি করলে তোমাকে আমি কেবল একটি দিন কাছে রাখতে পারি। তার পরে তুমি—

ষোড়শী পিছাইয়া গিয়া কহিল, চৌধুরীমশাই, আপনার পাইক-পিয়াদারা কি কেউ নেই যে এত অনুনয়-বিনয়? আপনি ত জানেন, আমি কারও কাছে নালিশ করব না।

জীবানন্দ পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল। রাগ করিল না, প্রতিঘাত করিল না, সবিনয়ে ধীরে ধীরে কহিল, তুমি যাও, অসম্ভবের লোভে আর তোমাকে আমি পীড়ন করব না। পাইক-পিয়াদা সবাই আছে অলকা, কিন্তু যে নিজে ধরা দেবে না, জোর করে ধরে রেখে তার বোঝা বয়ে বেড়াবার জোর আমার গায়ে নেই।

ষোড়শী পথ ছাড়া পাইয়াও পা বাড়াইল না, কহিল, আমি কোথায় যাচ্চি সে কৌতূহল বোধ করি আর আপনার নেই?

জীবানন্দ কহিল, কৌতূহল? বোধ হয় তার সীমা নেই—কিন্তু তাতে আর জ্বালা নেই অলকা। আমি কেবল এই কামনা করি, সেখানে কষ্ট তোমাকে যেন কেউ না দেয়। তোমার প্রতি যারা বিরূপ তারা যেন তোমাকে সম্পূর্ণ ভুলে থাকতে পারে। হঠাৎ গলাটা যেন তাহার ধরিয়া আসিল, কিন্তু নিজের দুর্বলতাকে আর সে প্রশ্রয় দিল না, মুহূর্তে সামলাইয়া ফেলিয়া কহিল, আমি জানি, যে লোক স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে যায়, তার সঙ্গে লড়াই চলে না। যেদিন আমাদের হাতে তোমার চাবি ফেলে দিলে সেইদিন তোমার কাছে আমাদের একসঙ্গে সকলের হার হলো। তোমার জোরের আজ অবধি নেই—তবু ত মানুষের মন বোঝে না। যতদিন বেঁচে থাকব, এ আশঙ্কা আমার কোনদিন ঘুচবে না।

ষোড়শী সেইখানে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া জীবানন্দের পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইয়া কহিল, আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ—

কি অনুরোধ অলকা?

ষোড়শী মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া কহিল, সে আপনি জানেন।

জীবানন্দ একটুখানি ভাবিয়া বলিল, হয়ত জানি, হয়ত ভেবে দেখলে জানতেও পারব—কিন্তু সেই যে একদিন বলেছিলে সাবধানে থাকতে—কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। আজই কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কে দু’জন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে শপথ করে গেল, তাদের মায়ের যে সর্বনাশ করেছে তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না—আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সমস্ত শুনলাম—দু’দিন আগে হলে হয়ত মনে হতো, সে বুঝি আমি—দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হ’লো না—কি অলকা?

না, কিছু নয়, বলিয়া ষোড়শী জোর করিয়া আবার সোজা হইয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে জীবানন্দ দেখিতে পাইল না, সহসা তাহার মুখ ছাইয়ের মত সাদা হইয়া গেল। কহিল, চলুন আমার ঘরে গিয়ে একটুখানি আজ বসতে হবে। আমাকে গাড়িতে তুলে না দিয়ে বাড়ি যেতে আপনাকে দেব না। আসুন—

পরিচ্ছেদ – পচিশ

গরুর গাড়ির নীচে চাদর মুড়ি দিয়া গাড়োয়ান শুইয়াছিল, সে ষোড়শীর পায়ের শব্দ অনুভবে বুঝিয়া কহিল, মা, শৈবাল-দীঘি ত দশ-বারো ক্রোশের পথ, একটু রাত থাকতে বার না হলে পৌঁছতে কাল প্রহর বেলা উৎরে যাবে।

ষোড়শী বলিল, আচ্ছা, তাই হবে। কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিল, কোথায় যাচ্চি বোধ করি শুনতে পেলেন?

জীবানন্দ কহিল, পেলাম বৈ কি।

ষোড়শী কহিল, বেশী দূরে নয়। আপনার আক্রোশ এ পথটুকু অনায়াসে খুঁজে বার করতে পারবে।

কিন্তু তোমার ওপর আক্রোশ ত আমার নেই।

ঘর খুলিয়া ষোড়শী প্রবেশ করিল, কহিল, আমার একটিমাত্র কম্বল গাড়িতে পাতা। আপনাকে বসতে দিই এমন কিছু নেই। নির্মলবাবু হলে আঁচল বিছিয়ে দিতাম, কিন্তু আপনাকে ত তা মানাবে না। এই বলিয়া সে মুচকিয়া একটু হাসিয়া ঘরের কোণ হইতে একখানি কুশাসন গ্রহণ করিয়া মেঝের উপর পাতিয়া দিয়া বলিল, যদি অপরাধ না নেন ত—

জীবানন্দ নিঃশব্দে উপবেশন করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

এতবড় শ্লেষের উত্তর না পাইয়া ষোড়শী মনে মনে বিস্মিত হইল। প্রদীপের আলো অতিশয় ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল, ষোড়শী উজ্জ্বল করিয়া দিয়া সেটা হাতে করিয়া জীবানন্দের মুখের কাছে আনিয়া মুহূর্তকাল স্থিরভাবে থাকিয়া কহিল, কি ভাবচেন বলুন ত?

আমার ভাবনার কি অন্ত আছে?

অন্ত না থাকে আদি ত আছে, তাই বলুন।

জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া কহিল, না, তাও নেই। যার অন্ত নেই তার আদিও থাকে না।

ষোড়শীর মুখে আসিয়া পড়িল, ও-সকল কেবল দর্শনশাস্ত্রের বুলি—শুধু বাক্য—ও লইয়া সংসার চলে না, কিন্তু জীবানন্দের মুখ দেখিয়া তাহার নিজের মুখে স্বর বাহির হইল না। মনে মনে সে সত্যই বিস্ময়াপন্ন হইয়া অনুভব করিল, একটা কেবল সুচতুর উত্তর দিবার জন্যই এ কথা আজ সে বলে নাই, এ লইয়া আর বাদানুবাদ করিতে সে চাহে না। যাহাকে একান্তই নিষ্ফল বলিয়া বুঝিয়াছে সে লইয়া আর তর্ক কেন?

0 Shares