দেনা-পাওনা

সেইখানে চুপ করিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া ষোড়শী উঠিয়া গিয়া প্রদীপ রাখিয়া হাত ধুইল, কহিল, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

কি?

এই ঘরে একদিন আমার কাছে আপনি চেয়ে খেয়েছিলেন, আজ তেমনি আমার চাওয়ায় আপনাকে খেতে হবে।

দাও। ক্ষিদেও পেয়েচে।

সে জানি। আমরা পুরুষমানুষের মুখের পানে চাইলেই টের পাই। বলিয়া ষোড়শী জল-হাতে মুছিয়া লইয়া সামনেই ঠাঁই করিয়া দিল। দেবীর প্রসাদ আজ ছিল না, কিন্তু প্রজারা আজ তাহাকে অনেক-কিছু দিয়া গিয়াছিল, তাহাই পাতায় করিয়া সাজাইয়া আনিতে ষোড়শী রান্নাঘরে চলিয়া গেলে একাকী চারিদিকে চাহিয়া সেদিনের সেই দোয়াত ও কলমটা কুলঙ্গির উপরে তাহার চোখে পড়িল। মিনিট-দুই চিন্তা করিয়া সে তাহা পাড়িয়া আনিল। পকেট হইতে একখানা চিঠি বাহির করিয়া তাহার সাদা অংশটা ছিঁড়িয়া লইয়া প্রদীপের সুমুখে আসিয়া সে পত্র লিখিতে বসিল। বোধ হয় তিন-চারি ছত্রের বেশী নয়, শেষ করিয়া ভাঁজ করিল, এবং উপরে ষোড়শীর নাম লিখিয়া তাহা পকেটে রাখিয়া দিল। খানিক পরে খাবার লইয়া ষোড়শী প্রবেশ করিল। শালপাতায় জলে-ভিজানো সরু ধানের চিড়া, শালপাতার ঠোঙ্গায় দধি, আর একটা পাতায় কিছু ফলমূল ও চিনি, এবং ঘটিতে করিয়া জল আনিয়া তাহার সম্মুখে রাখিয়া দিয়া একটুখানি মলিন হাসিয়া বলিল, সেদিন ধনীর দেওয়া ঠাকুরের প্রসাদ ছিল, আর আজ গরীবের ঘরের চিড়ে দই আর একটু চিনি। এ কি আপনার মুখে রুচবে?

জীবানন্দ হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসিয়া বলিল, তুমি খেতে দিলে মুখের জন্যে ভাবিনে অলকা, কিন্তু পেটে সহ্য হলে হয়; আমার আবার সেই কলিকের ব্যথাটায়—

কথা শেষ না হতেই ষোড়শী চক্ষের পলকে পাতাটা টানিয়া লইল। ব্যাকুল ম্লানমুখে কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, আমার পোড়াকপাল, তাই ভুলেছিলাম! কিন্তু এ ত আপনাকে আমি প্রাণান্তে খেতে দিতে পারব না।

জীবানন্দ নিজের কথায় লজ্জাবোধ করিয়া কহিল, বেশী না খেলে বোধ হয় ক্ষতি হবে না।

ষোড়শী বলিল, বোধ হয়। বোধ হয় নিয়ে আপনাদের চলে, কিন্তু আমাদের চলে না।

কিন্তু এর জন্যে ত তোমার দুঃখ হবে।

ষোড়শী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, দুঃখ হবে কি গো? যাবার সময় তোমার মুখের খাবার কেড়ে নিয়েচি, কিচ্ছু দিতে পারিনি—আমি তো কেঁদেই মরে যাবো। একটু মৌন থাকিয়া হঠাৎ ভারী একটা অনুনয়ের স্বরে বলিয়া উঠিল, ও-বেলা নানা ঝঞ্ঝাটে রাঁধতে পারিনি, এ-বেলা সন্ধ্যার পর রেঁধেছি। ভাত, মাছের ঝোল—

মাছের ঝোল কি-রকম?

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, কেন, আমি কি বিধবা নাকি? আমি ত সব খাই।

এতক্ষণ পরে জীবানন্দ হাসিল, বলিল, তা হলে সেগুলি সব নিজের জন্যে রেখে আমাকে দয়া করে ফলার খাওয়াতে গেলে কেন?

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ কহিল, আমার দোষ হয়েচে, অপরাধ হয়েচে—একশ’বার ঘাট স্বীকার করচি। যদি বলেন ত আপনার কাছে আমি দশ হাত মেপে নাকে খত দিতে পারি। এই বলিয়া সে ভিজা-চিড়ার পাতাটা তুলিয়া ভাত ও মাছের ঝোল আনিতে হাসিমুখে উঠিয়া গেল।

ষোড়শীর প্রশ্নের উত্তরে জীবানন্দ যখন বলিয়াছিল, তাহার ভাবনার আদি-অন্ত নাই, তখন সে মিথ্যা বলে নাই, বোধ করি বাড়াইয়াও বলে নাই। এ জীবনে নিজের জীবনকে সে কখনও আলোচনার বিষয় করে নাই, এবং কোনদিন কোন প্রয়োজনই তাহার মুহূর্তের প্রয়োজনকে অতিক্রম করিয়া যাইতে পায় নাই। তাই তাহার ক্ষণকালের রুমালের প্রয়োজন ক্ষণপরের ঢাকাই চাদরের ঢের বড়; তাই আস্তরণের অভাবে শয্যায় তাহার বহুমূল্য শাল পাতা, এইজন্যই সে হাতের কাছে অ্যাশ-ট্রে না পাইলে সোনার ঘড়ির ডালার উপরে জ্বলন্ত চুরুট রাখিতে লেশমাত্র ইতস্ততঃ করে না। ভবিষ্যৎ তাহার কাছে সত্যবস্তু নয়, যে আসে নাই, সেই অনাগতের প্রতি সে ভ্রূক্ষেপমাত্র করে না। নারীর যে দেহটা সে চোখে দেখিতে পায়, তাহারই প্রতি তাহার আসক্তি, কিন্তু চোখ মেলিয়া যাহাকে দেখা যায় না, সেই তাহার দেহের অতিরিক্ত যে নারীত্ব—তাহার প্রতি তাহার কোন লোভই ছিল না। কিন্তু গ্রহবশে যৌবনের একান্তে আসিয়া আজ যে গহনে সে পথ ভুলিয়াছে ইহার কোন সন্ধানই সে জানিত না। কিসের জন্য যে অলকার আশেপাশে মন তাহার অহর্নিশি ঘুরিয়া মরিতেছে, নানাবিধ কৃচ্ছ্রসাধনায় যৌবন যাহার ক্ষুব্ধ নিপীড়িত, রূপ যাহার কঠিন ও কান্তিহীন, তাহাকে অনুক্ষণ কামনা করিয়া সংসার যখন তাহার এমনি বিস্বাদ হইয়া গেল, তখন কারণাতীত এই মোহের কৈফিয়ত সে যে নিজের কাছেই খুঁজিয়া পাইত না। কোন্‌ অবিদ্যমানে এই রমণী যে তাহার কোন্‌ অপূর্ণতা সম্পূর্ণ করিয়া দিবে, কি তাহার প্রয়োজন, এই অপরিচিত চিন্তার সে কূল পাইত না।

ভাত খাইতে বসিয়া একসময় সে বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল। সম্মুখে খোলা দোরের দিকে পিঠ করিয়া ষোড়শী বসিয়াছিল, এই একটা সাধারণ প্রশ্নের ঠিকমত জবাব না পাইয়া সে বলিয়া উঠিল, আপনি কি ভাবচেন, আমার উত্তর দিচ্চেন না?

জীবানন্দ মুখ তুলিয়া কহিল, কিসের?

ষোড়শী বলিল, এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।

জীবানন্দ বোধ হয় অন্যমনস্কতার জন্যই বুঝিতে পারিল না, কহিল, কাজ নেই?

ষোড়শী বলিল, কৈ, আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।

কিন্তু তুমি ত অসতী নও। এই বলিয়া জীবানন্দ চোখ মেলিয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্ষণকালমাত্র তাহাদের চোখে চোখে মিলিল, তাহার পরে ষোড়শী মুখ ফিরাইয়া লইল। কিন্তু এতক্ষণ এত কথাবার্তার মধ্যে যে বস্তুটা সে লক্ষ্য করে নাই, এই ক্ষণিকের দৃষ্টিতে এই প্রথম দেখিতে পাইয়া সে যথার্থই বিস্মিত হইল।

জীবানন্দের চোখে বুদ্ধির সেই অতি-তীক্ষ্ণতা ছিল না, মুখের কথার মত চাহনি তাহার স্পষ্ট, সরল এবং স্থূল। তাহার বক্রোক্তি ও অভিমান যে এই লোকটির কাছে নিষ্ফল হইয়াছে তাহা সে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইল। একটু চুপ করিয়া কহিল, কিন্তু এ কথা ত এতদিন আমার চেয়ে আপনিই বেশী জানতেন।

0 Shares