দেনা-পাওনা

ইংরেজের বিচারালয় ধনীর জন্য তৈরি, দরিদ্রের জন্য নয়—তাঁহার অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে, ব্যারিস্টার জামাই আছে, বিশ্বস্ত উকিল-মোক্তার আছে—এবং আরও কত কি সুবিধা-সুযোগ আছে—এইসকল আপনাকে আপনি বলিয়া জনার্দন শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু সুবিধা বিশেষ হইল না। কারণ, এ ত শুধু টাকাকড়ি, জমিজমা, কেনা-বেচাই নয়, এতদুপলক্ষে যে-সকল অসামান্য কার্যগুলা সম্পন্ন করাইয়াছেন, তাহার ফলস্বরূপ ফৌজদারী দণ্ডবিধির কেতাবের পাতায় পাতায় যে-সকল কঠিন বাক্য লিপিবদ্ধ করা আছে, তাহাদের নিষ্ঠুর চেহারা আড়ালে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে অত্যন্ত ভয় দেখাইতে লাগিল।

এ কথা রাষ্ট্র হইতে যে অবশিষ্ট নাই, সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রায়মহাশয় তাহা জানিতেন, তাই দিনের বেলাটা কোনমতে কাটাইয়া রাত্রের অন্ধকারে এককড়িকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, এবং জমিদার-সরকার হইতে ইহার কিরূপ বিহিত হইতেছে জিজ্ঞাসা করিলেন।

এককড়ি কহিল, হুজুরের কাছে ত এখনও পেশ করাও হয়নি।

জনার্দন রাগ করিয়া কহিলেন, করনি ত কর গে। বুড়ো বয়সে কি শেষে ফাটক খাটবো নাকি?

তাঁহার শঙ্কা ও ব্যাকুলতায় এককড়ি হাসিয়া বলিল, ভয় কি রায়মশাই, ফাটক খাটতে হয় ত আমিই খাটবো, আপনাদের যেতে দেব না। কিন্তু গরীবের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন, ভুলবেন না।

জনার্দন খুশী হইয়া কহিলেন, সে ত জানি এককড়ি, তুমি থাকতে ভয় নেই, তুমি যা বোঝো উকিলের বাবাও তা বোঝে না, কিন্তু জানো ত সব? কে সাহেব নাকি নিজে তদারকে আসচে—ব্যাটা মহা বদমাশ। কিন্তু ভেতরের খবর কিছু জানো? কে ব্যাটাদের বুদ্ধি দিলে বল ত? টাকা কে যোগালে?

এককড়ি অসঙ্কোচে ষোড়শীর নাম করিয়া বলিল, টাকা যোগালেন মা চণ্ডী, আর কে? তাতেই ত তাড়াতাড়ি আড়ালে সরে গেল।

ছুঁড়ী আছে কোথায় বল ত?

এককড়ি কহিল, কাছাকাছি কোথাও লুকিয়েচে—জানতে একদিন পারবই।

জনার্দন ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, খবরটা নিয়ো। হাঙ্গামাটা কেটে যাক, তারপরে।

এককড়ি নন্দী সেদিন এইখানে আহারাদি করিয়া অনেক রাত্রে বাড়ি গেল। অভিমান করিয়া বলিল, সেদিন সাগর সর্দারের প্রসঙ্গে আপনারা সবাই তাঁর মন যুগিয়ে মুখ টিপে হাসলেন, কিন্তু পুলিশের কাছে সেদিন খবরটি দিয়ে রাখলে আজ এ বিপদ আপনাদের ঘটতো না।

জনার্দন সলজ্জে ত্রুটি স্বীকার করিলেন। এককড়ি তখন প্রভুর সম্বন্ধে বিশেষ একটি সংবাদ তাঁহার গোচর করিয়া কহিল, মদ খেয়ে বরঞ্চ ছিল ভাল, এখন কথা বলাই ভার! কলিক্‌ লেগেই আছে—এতকালের অভ্যাস, হয়ত আর বেশীদিন নয়।

জনার্দন বিশ্বাস করিতে পারিলেন না, কহিলেন, সত্যি সত্যিই খায় না নাকি?

এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, এটা সত্যি যে খায় না। সূর্যদেব পশ্চিমে ওঠাও সহজ—কিন্তু কি জানেন রায়মশাই, ভয়ানক একগুঁয়ে লোক—সেদিন সারাদিনের যন্ত্রণায় রাত্রে হাত-পা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এলো, ডাক্তারবাবু ভয় পেয়ে বললেন, আমার কথা রেখে অন্ততঃ এক-চামচে খান—হার্ট ফেল্‌ করতে পারে—বাবুর কিন্তু ভয়ই হলো না। একটু হেসে বললেন, এতকালের মধ্যে ও-বেচারা কখ্‌খনো ফেল করেনি, সমানে চলেছে, আজ যদি একদিন করেই ফেলে ত আর দোষ দেব না, কিন্তু আমি জীবনভোরই ফেল করে আসচি, আজ অন্ততঃ একটা দিনও আমাকে পাশ করতে দিন। কেউ খাওয়াতে পারলে না।

বল কি!

এককড়ি কহিল, খেয়াল চেপেছে বাড়ি মেরামত থাক, ওই টাকায় মাঠের মাঝখানে এক সাঁকো, আর রূপসী বিলের উত্তরধারে একটা মস্ত বাঁধ তুলতে হবে। ইঞ্জিনিয়রবাবু এসেছিলেন, হিসেব করে বললেন, ও টাকায় দশখানা বাড়ি মেরামত হতে পারে। তার একভাগ এদিকে দিয়ে বাড়িটা রক্ষা করুন; কিন্তু কিছুতেই না। দেওয়ানজী বাপের বয়সী বুড়োমানুষ, বললেন, জমিদারি বাঁধা পড়বে যে! বাবু বললেন, প্রজারা সব বছর বছর খাজনা যোগাচ্চে আর মরচে। তাদের জমি বাঁচাবার জন্যে যদি জমিদারি বাঁধা পড়ে ত পড়ুক না। ও শোধা যাবে।

রায়মহাশয় চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিলেন, মাথা খারাপ-টারাপ হয়নি ত?

ইহার দিন-দুই পরে খবর লইয়া যখন জনার্দন জানিতে পারিলেন এককড়ি আজও সে কথা হুজুরে পেশ করে নাই, তখন তিনি বিচলিত হইয়া উঠিলেন। অপদার্থ ও ভীতু বলিয়া মনে মনে তাহাকে তিরস্কার করিলেন, এবং রাত্রে সুনিদ্রা হইল না। সাহেব হঠাৎ যদি একদিন এত্তেলা পাঠাইয়া সরজমিনে আসিয়া পড়ে ত বিপদের অবধি থাকিবে না। সকল দিকে প্রস্তুত না থাকিলে যে কি ঘটিতে পারে বলা যায় না। স্থির করিলেন, পরদিন দেখা করিয়া নিজেই সকল কথা নিবেদন করিবেন—পরের উপর নির্ভর করিয়া সময় নষ্ট করিলে মরিতে হইবে।

সকালে একশত আটবার দুর্গানাম জপ করিলেন, শ্রীশ্রীচণ্ডীমাতার নাম লাল কালি দিয়া কাগজের উপরে লিখিয়া কাজটা পাকা করিয়া লইলেন, এবং হাঁচি, টিকটিকি, শূন্যকুম্ভ প্রভৃতি সর্বপ্রকার বিপত্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া মোটা দেখিয়া জন-চারেক লোক সঙ্গে করিয়া জমিদারের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। কিন্তু অধিক দূর অগ্রসর হইতে হইল না, জন পাঁচ-ছয় লোক ছুটিয়া আসিয়া যে খবর দিল, তাহা যেমন অপ্রীতিকর, তেমনি অপ্রত্যাশিত। বেশী নয়, কাঠা-দশেক পরিমাণ বড় রাস্তার উপরেই একটা জায়গা কিছুকাল হইতে রায়মহাশয় দখল করিয়া ঘিরিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, দোকান-ঘরটা এইখানে সরাইয়া আনিবেন।

সম্পত্তি চঁণ্ডীর এবং এই লইয়া ষোড়শীর সহিত তাঁহার বাদানুবাদও হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পরাক্রান্ত জনার্দন রায়কে সে বাধা দিতে পারে নাই। এ সম্বন্ধে তাঁহার কি একটা দলিলও ছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেরা তাহা বিশ্বাস করিত না।

আজ সকালে এইটাই তাহার বে-দখল করা হইয়াছে। জনার্দন ধীরে ধীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, অনেকেই হাজির আছেন। শিরোমণি, তারাদাস, গগন চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজন তাঁহার দলভুক্ত ভদ্রব্যক্তিদের সমক্ষে জীবানন্দ চৌধুরী নিজে হুকুম দিয়া এবং নিজের লোক দিয়া তাঁহার বেড়া ভাঙ্গাইয়া মন্দির-সংলগ্ন ভূখণ্ডের অন্তর্গত করিয়া দিয়াছেন। কেহই প্রতিবাদ করিতে ভরসা করে নাই।

0 Shares