দেনা-পাওনা

সেদিন আদালত হইতে ফিরিয়া হৈমর কাছে শুনিল মায়ের চিঠি আসিয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন, রাত্রে লুকাইয়া ষোড়শী কোথায় যে চলিয়া গেছে কেহই জানে না।

নির্মল পরিহাসের চেষ্টায় জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, কেউ জানে না কোথায় গেছে? সাগর সর্দারও না, এমনকি জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী পর্যন্ত না?

হৈম রাগ করিয়া কহিল, তোমার এক কথা। সাগর জানলেও জানতে পারে, কিন্তু জমিদার জানবে কি করে? মেয়েদের নামে একটা দুর্নাম দিতে পারলে যেন তোমরা বাঁচো!

তা বটে। বলিয়া নির্মল বাহিরে যাইতেছিল, হৈম ডাকিয়া কহিল, আরও একটা কাণ্ড হয়েচে। সেই রাত্রে জমিদারের শান্তিকুঞ্জ কে একদম পুড়িয়ে দিয়েছে।

বল কি!

হাঁ। লোকের সন্দেহ, রাগ করে সাগর পুড়িয়েছে। কিন্তু জমিদারের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যে মিথ্যে দুর্নামটা তাঁর গ্রামের সকলে মিলে দিলে, তা সত্যি হলে কি কখনো জমিদারেরই বাড়ি পুড়ত? তুমিই বল?

নির্মল চুপ করিয়া রহিল। হৈম কহিল, যে যাই কেন না বলুক, আমি কিন্তু নিশ্চয় জানি তিনি নির্দোষী। চণ্ডীর এমন ভৈরবী আর কখনো ছিল না। তাঁর দয়াতেই ছেলের মুখ দেখতে পেয়েচ, তা জানো?

এ কথারও নির্মল কোন উত্তর দিল না। সকল ঘটনা জানিতে, চিঠি লিখিয়া সকল সংবাদ সবিস্তারে আহরণ করিতে তাহার কৌতূহলের সীমা ছিল না, কিন্তু এ ইচ্ছাকে সে দমন করিয়া বাহির হইয়া গেল। ষোড়শীর সকল সম্পর্ক হইতে আপনাকে সে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবেই, এই ছিল তাহার পণ। কিন্তু পরদিন সকাল না হইতেই যখন শ্বশুরের জরুরি তার আসিয়া পড়িল এবং সন্ধ্যার মেলে শাশুড়ীর চিঠি আসিল, পত্র পাওয়ামাত্র জামাই না আসিয়া পৌঁছিলে তাহার বৃদ্ধ শ্বশুরকে এ যাত্রা কেহই রক্ষা করিতে পারিবে না, জেল তাঁহাকে খাটিতেই হইবে, তখন হৈম কাঁদিতে লাগিল, এবং নির্মলকে আর একবার তোরঙ্গ ও বিছানাপত্র বাঁধিবার হুকুম দিয়া তাহার কাজের বন্দোবস্ত করিতে বাটী হইতে বাহির হইতে হইল।

দিন-দুই পরে হৈমকে সঙ্গে করিয়া নির্মল চণ্ডীগড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, একটা ভয়ের মধ্যে সকলের দিন কাটিতেছে। কে যে কখন আগুন ধরাইয়া দিবে তাহার ঠিক নাই। চারিদিকে লোক নিযুক্ত হইয়াছে, কর্তা শুকাইয়া যেন অর্ধেক হইয়া গেছেন, কোথাও বাহির হন না—এতবড় প্রতাপান্বিত ব্যক্তির নিজের গ্রামের মধ্যেই এতবড় দুর্গতি দেখিয়া নির্মল বিস্মিত হইল। এখান হইতে বেশী দিন সে যায় নাই, কিন্তু কি পরিবর্তন! খবর যাহা পাইল তাহা অত্যন্ত উলটা-পালটা রকমের, বিশেষ কিছু বুঝা গেল না; কেবল একটা সংবাদে সকলেরই মিল হইল যে, জমিদার জীবানন্দ চৌধুরীর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। সে মদ ছাড়িয়াছে, প্রজাদের দিয়া নিজের বিরুদ্ধে নালিশ করাইয়া দিয়াছে, যে টাকায় পোড়া বাড়ি মেরামত করা উচিত ছিল, তাই দিয়া মাঠের সাঁকো তৈরি করাইতেছে—এমনি কত কি গল্প, কিন্তু হঠাৎ কিসের জন্য সে এরূপ হইল, তাহা কেহই জানে না। এই লোকটিকে নির্মল অতিশয় ঘৃণা করিত; ইহারই কাছে দরবার করিতে যাইতে হইবে মনে করিয়া সে অতিশয় সঙ্কুচিত হইল। অথচ ব্যাপার যাহা দাঁড়াইয়াছে তাহাতে আর যে কি পথ আছে তাহাও চোখে পড়িল না। ভূমিজ প্রজারা অত্যন্ত বিরুদ্ধে! একে ত তাহাদের সর্বনাশ হইয়াছে, এবং তাহা সম্পাদন করিতে কোন চেষ্টারই ত্রুটি হয় নাই, তাহাতে তাহাদের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষিণী ভৈরবী মাতার প্রতি যে অত্যাচার হইয়াছে, তাহাতে ক্রোধের তাহাদের সীমা নাই। তাহারা কোন কথা শুনিবে না।

এদিকে মাদ্রাজী সাহেবের বিস্তর ক্ষতি, তাঁহার কল-কব্জা আসিয়া পড়িয়াছে, সে ক্ষতিপূরণ করা একপ্রকার অসাধ্য ব্যাপার। জমির দখল তাঁহারই চাই-ই। বিশেষতঃ নিজে অনুপস্থিত থাকিয়া যে এটর্নির দ্বারা তিনি কাজ চালাইতেছেন তিনি যেমন রুক্ষ, তেমনি অভদ্র, তাঁহার কাছে কোন সুবিধারই আশা নাই। একমাত্র ভরসা নিজেদের মধ্যে এক হওয়া; যেহেতু, আর যাহাই হোক, পিনাল কোডের সেই দুরন্ত ধারাগুলোয় তাহাতে বাঁচিবার সম্ভাবনা। নিজেদের মধ্যে কবুল জবাব দিলে আর কোন রাস্তা নাই, অথচ সেই পাগল লোকটা শাসাইয়া রাখিয়াছে হাকিমের কাছে সে কোন কথাই লুকাইবে না। এই কথা নির্মল হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিত, কিন্তু আসিয়া অবধি সে যে-সকল গল্প শুনিল, বিশেষ করিয়া সেই মদ ছাড়ার কাহিনী—হার্টফেলের ভয় দেখাইয়াও ডাক্তারে যাহাকে এক ফোঁটা গিলাইতে পারে নাই, সেই ভীষণ একগুঁয়ে লোকটার মাথায় হঠাৎ কি খেয়াল চাপিয়াছে, কে তাহার কৈফিয়ত দিবে? অথচ, সে আসিয়াছে এই দুর্মদ একান্ত অবোধ ব্যক্তিকে সুবুদ্ধি দিতে। তাহাকে বুঝাইতে হইবে, ভয় দেখাইতে হইবে, অনুনয়-বিনয় করিতে হইবে—কি যে করিতে হইবে সে কিছুই জানে না। এই অত্যন্ত অপ্রীতিকর কার্য হইতে নির্মলের সমস্ত চিত্ত যেন বিদ্রোহ করিতে লাগিল, কিন্তু উপায় কি? দুষ্কৃতকারী যে হৈমর পিতা। তাঁহাকে যে বাঁচাইতেই হইবে। হৈম কাঁদিতে লাগিল, শাশুড়ী কাঁদিতে লাগিলেন, এককড়ি চোরের মত আনাগোনা করিতে লাগিল, শ্বশুর না খাইয়া শয্যা গ্রহণ করিলেন—অথচ মাঝে কেবল একটি দিন বাকী, পরশু দিন আসিবেন হাকিম তদন্ত করিতে।

অপরাহ্ণের কাছাকাছি জীবানন্দের সহিত দেখা হইল তাহার মাঠের মাঝখানে। এতকাল জল-নিকাশের পথ ছিল না, তাই সাঁকো তৈরি হইতেছিল। প্রশান্ত হাস্যে দুই হাত বাড়াইয়া আসিয়া জীবানন্দ তাহাকে গ্রহণ করিয়া কহিল, আপনার আসার খবর আমি কালই পেয়েছি। ভাল আছেন আপনি? বাড়ির সব ভাল? তাহার কথায় আচরণে গরিমা নাই, কৃত্রিমতা নাই—যেমন সহজ, তেমনি খোলা—তাহাকে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই। এতখানির জন্য নির্মল প্রস্তুত ছিল না; তাহার আপনাকে আপনি যেন ছোট মনে হইল। মাথা যদি ইঁহার খারাপ হইয়াও থাকে ত লজ্জা পাইবার নয়। জীবানন্দের কুশল প্রশ্নের উত্তর নির্মল শুধু মাথা নাড়িয়াই দিল এবং প্রতি প্রশ্ন করিবার কথা হঠাৎ তাহার মনে হইল না।

0 Shares