দেনা-পাওনা

জীবানন্দ কহিল, আপনি কুটুম্ব মানুষ, সমস্ত গ্রামের আদরের বস্তু, কিন্তু ইচ্ছে করে এমন জায়গায় এসে দেখা করলেন যে—সহসা মিস্ত্রী ও মজুরদের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় কহিল, বাবারা, আজ আমাদের একটু রাত্রি পর্যন্ত খাটতে হবে। সপ্তাহ ধরে মেঘ করচে, আজকালের মধ্যেই হয়ত জল হবে।

কিন্তু তা হলে ত কোনমতেই চলবে না। আমরা এমন কাজ করে যাবো যে, আমাদের নাতি-পুতিদের পর্যন্ত ঘাড় নেড়ে বলতে হবে যে, হাঁ, সাঁকো করেছিল তারা, সত্যিকারের দরদ দিয়েই করেছিল। সেই ত আমাদের মেহন্নতয়ানা!

লোকগুলা গলিয়া গেল। বীজগাঁয়ের ভয়ঙ্কর জমিদার একসঙ্গে খাটিতেছেন, তাঁহার মুখের এই কথা; তাহারা সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করিয়া জানাইল যে, তাহাদেরও সেই ইচ্ছা। জ্যোৎস্না যদি না মেঘে ঢাকে ত তাহারা রাত্রি দশটা পর্যন্ত কাজ করিবে।

নির্মল কহিল, আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।

জীবানন্দ বলিল, আর একদিন হলে হয় না?

না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

জীবানন্দ হাসিল; কহিল, তা বটে। অকাজের বোঝা বহাতে যাঁরা এতদূর টেনে এনেছেন, তাঁরা কি আপনাকে সহজে ছেড়ে দেবেন!

খোঁচাটা নির্মলের গায়ে বাজিল। সে কহিল, সে ত ঠিক কথা। অকাজ মানুষ করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশায়। না হলে আপনাকেই বা এই মাঠের মাঝখানে বিরক্ত করবার আমার প্রয়োজন হত কেন?

জীবানন্দ কিছুমাত্র রাগ করিল না, তেমনি প্রসন্নমুখে বলিল, আমি কিছুমাত্র বিরক্ত হইনি নির্মলবাবু। যে জন্যে আপনি এসেছেন, সে যে আপনার কর্তব্য, এ বিষয়েও আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, না হলে আপনিই বা আসবেন কেন? কিন্তু কর্তব্যের ধারণা ত সকলের এক নয়। রায়মহাশয়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে; আপনার আসার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিক খুশী হবো, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি ঠিক করে ফেলেচি। এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।

নির্মলের মুখ ম্লান হইল। সে একটু ভাবিয়া কহিল, দেখুন, ভালই হলো যে অপ্রিয় আলোচনার ভূমিকার অংশটা আপনি দয়া করে আমাকে উত্তীর্ণ করে দিয়ে গেলেন। এসে অবধি আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কথাই শুনেচি—

জীবানন্দ সহাস্যে বলিল, একটা এই যে আমার মাথার ঠিক নেই, সত্য কিনা বলুন?

নির্মল কহিল, সংসারে সাধারণ মানুষের বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে অকস্মাৎ কারও কর্তব্যের ধারণা যদি অত্যন্ত প্রভেদ হয়ে যায় ত দুর্নাম একটা রটেই। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?

জীবানন্দ কহিল, সত্য বৈ কি। তাহার কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য নাই, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা, তথাপি নির্মল নিঃসংশয়ে বুঝিল ইহা ফাঁকি নয়। বলিল, এমন ত হতে পারে আপনার কবুল-জবাবে আপনিই শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।

জীবানন্দ কহিল, নির্মলবাবু, আপনার কথাটা হলো ঠিক সেই পাঠশালার গোবিন্দের মত। পণ্ডিতমশাই! মুকুন্দও যে আম চুরি করছিল! অর্থাৎ, বেতটা চারিয়ে না পড়লে তার পিঠের জ্বালা কমবে না। এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল। তাহার সকৌতুক হাসির ছটায় নির্মলের মুখ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল দেখিয়া সে জোর করিয়া তাহা নিবারণ করিয়া কহিল, রক্ষে করুন আপনি, এ আমি স্বপ্নেও চাইনে। আমার কৃতকর্মের ফল আমি ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে, রায়মশাই নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন, এবং আমার এককড়ি নন্দীমশাইও আর কোথাও গোমস্তাগিরি কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার কোন আক্রোশ নেই।

নির্মল আইন ব্যবসায়ী, সহজে হাল ছাড়িবার পাত্র নয়, কহিল, এমন ত হতে পারে কারও কোন শাস্তিভোগ করারই আবশ্যক হবে না, অথচ ক্ষতিও কাউকে স্বীকার করতে হবে না।

জীবানন্দ তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, বেশ ত, পারেন ভালই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি সে হবার নয়। কৃষকেরা তাদের জমি ছাড়বে না। কারণ এ শুধু তাদের অন্ন-বস্ত্রের কথা নয়। তাদের সাত-পুরুষের চাষ-আবাদের মাঠ, এর সঙ্গে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এ তাদের দিতেই হবে। একটু চুপ করিয়া কহিল, আপনি ভালই জানেন অন্য পক্ষ অত্যন্ত প্রবল, তার উপর জোর-জুলুম চলবে না। চলতে পারে কেবল চাষাদের উপর কিন্তু চিরদিন তাদের প্রতিই অত্যাচার হয়ে আসচে, আর হতে আমি দেব না।

নির্মল মনে মনে প্রমাদ গণিয়া কহিল, আপনার বিস্তীর্ণ জমিদারি, এই ক’টা চাষার কি আর তাতে স্থান হবে না? কোথাও না কোথাও—

না না, আর কোথাও না—এই চণ্ডীগড়ে। এইখানে আমি জোর করে তাদের কাছে ছ হাজার টাকা আদায় করেচি—আর সে টাকা যুগিয়েছেন জনার্দন রায়—সে শোধ করতেই হবে। কিন্তু অপ্রীতিকর আলোচনায় আর কাজ নেই নির্মলবাবু, আমি মনঃস্থির করেচি।

এই ছ হাজার টাকার ইঙ্গিত নির্মল বুঝিল না, কিন্তু এটা বুঝিল যে তাহার শ্বশুরমহাশয় অনেক পাকে আপনাকে জড়াইয়াছেন যাহা মুক্ত করা সহজ নয়। সে শেষ চেষ্টা করিয়া কহিল, আত্মরক্ষায় সকলেরই ত অধিকার আছে, অতএব শ্বশুরমশায়কেও করতে হবে। আপনি নিজে জমিদার, আপনার কাছে মামলা-মকদ্দমার বিবরণ দিতে যাওয়া বাহুল্য—শেষ পর্যন্ত হয়ত বা বিষ দিয়েই বিষের চিকিৎসা করতে হবে।

জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, চিকিৎসক কি জাল করার বিষে খুন করার ব্যবস্থা দেবেন?

নির্মলের মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। কহিল, জানেন ত, অনেক সময় ওষুধের নাম করলে আর খাটে না! সে যাই হোক, আপনি জমিদার, ব্রাহ্মণ, বয়সে বড়, আপনাকে শক্ত কথা বলবার ইচ্ছে আমার নেই। কিংবা হঠাৎ কি কারণে আপনার ধর্ম-জ্ঞান এরূপ প্রচণ্ড হয়ে উঠল তাও জানবার কৌতূহল নেই, কিন্তু একটা কথা বলে যাই যে, এ জিনিস আপনার স্বাভাবিক নয়। গভর্নমেন্ট যদি প্রসিকিউট করে ত জেলের মধ্যে একদিন তা উপলব্ধি করবেন। আপনি সর্পকে রজ্জু বলে ভ্রম করচেন।

0 Shares