দেনা-পাওনা

জীবানন্দ কহিল, এ কথা আপনার সত্য, কিন্তু ভ্রম যতক্ষণ আছে ততক্ষণ রজ্জুটাই ত আমার সত্য!

নির্মল বলিল, কিন্তু তাতে মরণ আটকাবে না। আরও একটা সত্য কথা আপনাকে বলে যাই। এইসব নোংরা কাজ করা আমার ব্যবসা নয়। আপনাকে আমি অতিশয় ঘৃণা করি, এবং এক পাপিষ্ঠের জন্য আর এক পাপিষ্ঠকে অনুরোধ করতে আমি লজ্জা বোধ করি; কিন্তু সে আপনি বুঝবেন না—সে সাধ্যই আপনার নেই।

জীবানন্দের মুখের উপর কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। লেশমাত্র উত্তেজনা নাই, তেমনি সৌম্য-শান্তকণ্ঠে কহিল, কিন্তু আপনাকে আমি ঘৃণা করিনে নির্মলবাবু, শ্রদ্ধা করি, এ বোঝবার সাধ্যও ত আপনার নেই!

তাহার নির্বিকার স্বচ্ছন্দতায় নির্মল জ্বলিতে লাগিল, এবং এই প্রত্যুত্তরকে কদর্য উপহাস কল্পনা করিয়া তিক্তকণ্ঠে বলিল, চোর-ডাকাতদের মধ্যেও বিশ্বাস বলে একটা বস্তু আছে, নিজেদের মধ্যে তারাও তা ভাঙ্গে না। বিশ্বাসঘাতককে তারা ঘৃণা করে। কিন্তু জীবনব্যাপী দুরাচারে বুদ্ধি যার বিকৃত, তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই—আমি চললাম। এই বলিয়া সে চক্ষের পলকে পিছন ফিরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। জীবানন্দ চাহিয়া দেখিল অনেকেই হাতের কাজ বন্ধ করিয়া সবিস্ময়ে চাহিয়া আছে। সে ম্লানমুখে শুধু একটু হাসিয়া বলিল, সময় যেটুকু নষ্ট করলি বাবারা, সেটুকু কিন্তু পুষিয়ে দিস্‌। কথাটা নির্মলের কানে গেল।

দিন-চারেকের মধ্যেই কৃষককুলের চিরদিনের দুঃখ দূর করিয়া জল-নিকাশের সাঁকো তৈরি শেষ হইল, গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে ভিড় করিয়া লোক দেখিতে আসিল, কিন্তু যে ইহা নির্মাণ করিল, সেই জীবানন্দ শয্যাগত হইয়া পড়িল। এ পরিশ্রম সে সহ্য করিতে পারিল না। এই অজুহাতে এবং সাহেবের সহিত দেখা করিয়া নানা কৌশলে নির্মল তদন্তের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিতে পারিয়াছিল, কিন্তু সে-দিনও সমাগতপ্রায়। কেবল দুটা দিন বাকী। বাঁচিবার একমাত্র পথ ছিল, এবং তাহাই অবলম্বন করিয়া জনার্দন তারাদাসকে দিয়া চণ্ডীমাতার বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করাইলেন, এবং নিজে মন্দিরের একান্তে বসিয়া সকাল-সন্ধ্যায় কায়মনে ডাকিতে লাগিলেন, মায়ের কৃপায় যেন এ যাত্রা জীবানন্দ আর না ওঠে। সাহেব সরজমিনে আসার পূর্বেই যেন কিছু একটা হইয়া যায়।

মেয়েকে লইয়া ষোড়শীর হাতে-পায়ে গিয়া পড়ার কথাও মনে হইয়াছিল, কারণ ছোটলোকদের যদি কেহ ঠেকাইতে পারে ত কেবল সে-ই পারে, কিন্তু কোথায় সে? সাতদিনের সময় পাইয়া হৈমর নিশ্চিত ভরসা হইয়াছিল ছেলেকে সঙ্গে করিয়া গিয়া একবার কাঁদিয়া পড়িতে পারিলে সে কিছুতেই না বলিতে পারিবে না; কিন্তু সে আশা যে বৃথা হইতে বসিল।

এই কয়দিন প্রায় প্রত্যহই নির্মলকে সদরে যাইতে হইতেছিল। এই যে বিশ্রী মামলাটা বাধিবে, তাহার সকল ছিদ্রপথই যে আগে হইতে বন্ধ করা আবশ্যক। সেদিন দুপুরবেলায় সে রেজেস্ট্রী আপিসের বারান্দার একধারে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া কতকগুলা প্রয়োজনীয় দলিলপত্রের নকল লইয়া নিবিষ্টচিত্তে পড়িতেছিল, হঠাৎ সুমুখেই ডাক শুনিল, জামাইবাবু, সেলাম। ভাল আছেন?

নির্মল চমকিয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, ফকিরসাহেব। তাঁহারও হাতে একতাড়া কাগজ।

তাড়াতাড়ি উঠিয়া অভিবাদন করিয়া তাঁহার দুই হাত ধরিয়া পাশে বসাইয়া কহিল, শুনেছিলাম আপনাকে ডাকলেই আপনার দেখা মেলে। এ-কয়দিন মনে মনে আমি প্রাণপণে ডাকছিলাম।

ফকির হাসিলেন, কহিলেন, কেন বলুন ত?

ষোড়শীকে আমার বড় প্রয়োজন। তিনি কোথায় আছেন আমাকে দেখা করতেই হবে।

ফকির বিস্মিত হইলেন না, আনন্দও প্রকাশ করিলেন না, বলিলেন, দেখা না হওয়াই ত ভাল।

নির্মল অত্যন্ত লজ্জিত হইল। কহিল, আপনি হয়ত সর্বজ্ঞ। তা যদি হয়, জানেন ত আমাদের কত বড় প্রয়োজন?

ফকির কহিলেন, না, আমি সর্বজ্ঞ নয়, কিন্তু মা ষোড়শী কোন কথাই আমাকে গোপন করেন না। একটু থামিয়া বলিলেন, দেখা হওয়া না-হওয়ার কথা তিনিই জানেন, আমি জানিনে, কিন্তু তাঁর সমস্ত ব্যাপার আপনাকে জানাতে আমার বাধা নেই। কারণ, একদিন যখন সবাই তাঁর সর্বনাশে উদ্যত হয়েছিল, তখন আপনিই একাকী তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি তাঁর মুখেই এ কথা শুনেচি।

নির্মল কহিল, আর আজ ঠিক সেইটি উলটে দাঁড়িয়েচে ফকিরসাহেব। এখন কেউ যদি তাঁদের বাঁচাতে পারে ত তিনিই পারেন।

ফকিরের মুখ অপ্রসন্ন হইল। ইহার বিস্তৃত বিবরণের জন্য তিনি কৌতূহল প্রকাশ না করিয়া কেবল কহিলেন, চণ্ডীগড়ের খবর আমি জানিনে। কিন্তু আমি বলি, তাঁর ভাল করার ভার ভগবানের উপর আপনি ছেড়ে দিন। আমার মাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না নির্মলবাবু।

বিগত দিনের সমস্ত দুঃখের ইতিহাস নির্মলের মনে পড়িল। ইহার জবাব দেওয়া কঠিন, সে শুধু কুণ্ঠার সহিত প্রশ্ন করিল, এখন তিনি কোথায় আছেন?

জায়গাটাকে শৈবাল-দীঘি বলে।

সেখানে সুখে আছেন?

এইবার ফকির মৃদু হাসিয়া কহিলেন, এই নিন! মেয়েমানুষের সুখে থাকার খবর দেবতারা জানেন না। আমি ত আবার সন্ন্যাসী মানুষ। তবে মা আমার শান্তিতে আছেন এইটুকুই অনুমান করতে পারি।

নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আদালতে আপনি কোথায় এসেছিলেন?

ফকির কহিলেন, তা বটে! সন্ন্যাসী ফকিরের এ স্থান নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু সংসারের মোহ ত মানুষকে সহজে ছাড়ে না বাবা, তাই শেষ বয়সে আবার বিষয়ী হয়ে উঠেচি। ভাল কথা, বিনা পয়সায় আপনার মত আইনজ্ঞ ব্যক্তিও আর পাব না, এবং আপনাকেই কেবল বলা যায়। আমার এই কাগজগুলি যদি দয়া করে একবার দেখে দেন।

নির্মল হাত বাড়াইয়া কহিল, এ কিসের কাগজ?

একটা দান-পত্রের খসড়া। বলিয়া ফকির তাঁহার কাগজের বাণ্ডিল নির্মলের হাতে তুলিয়া দিলেন। পরের কাজ করিবার মত সময় ও প্রবৃত্তি নির্মলের ছিল না; সে নিস্পৃহের মত তাহা গ্রহণ করিল, এবং ধীরে ধীরে তাহার পাক খুলিয়া পাঠে নিযুক্ত হইল। কিন্তু কয়েক ছত্র পরেই অকস্মাৎ তাহার চোখের দৃষ্টি তীব্র, মুখ গম্ভীর এবং কপাল কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। এই দানের সম্পত্তি অকিঞ্চিৎকর নয়, কয়েক পৃষ্ঠা ব্যাপিয়া তাহার বিবরণ, সেইগুলির উপর কোনমতে চোখ বুলাইয়া লইয়া অবশেষে শেষ পাতায় আসিয়া যখন তাহার জীবানন্দের সেই চিঠিখানার প্রতি দৃষ্টি পড়িল, তখন লাইন-কয়েকের সেই লিখনটুকু এক নিশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়া নির্মল স্তব্ধ হইয়া রহিল।

0 Shares