দেনা-পাওনা

উপরন্তু নজরের টাকাটার সম্বন্ধেও যে তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বহুদূর অগ্রসর হইয়া যাইবে ইহাও ষোড়শী স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। তা ছাড়া, এই দুর্দান্ত ভূস্বামীর বিরুদ্ধে তিনি করিবেনই বা কি! ছয়-সাত ক্রোশের মধ্যে একটা থানা নাই, চৌকি নাই—পুলিশের কাছে খবর দিতে গেলেও যে পরিমাণ সময়, অর্থ এবং লোকবলের প্রয়োজন তাহার কোনটাই তারাদাসের নাই। অতএব অত্যাচার যত বড়ই হোক, এই সুবৃহৎ শক্তির সম্মুখে অবনতশিরে সহ্য করা ব্যতীত আর যে গত্যন্তর নাই, এই কথাটাই চোখে আঙ্গুল দিয়া ষোড়শীকে বার বার দেখাইয়া দিতে লাগিল।

অথচ সমস্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে মিশিয়া তাহার আর একটা চিন্তার ধারা নীরবে অনুক্ষণ বহিয়া যাইতেছিল—সে ওই তাহার চণ্ডীমাতা, যাঁহাকে শিশুকাল হইতে সে কায়মনে পূজা করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু ঐ যে লোকটা ও-ঘরে ঘুমাইতেছে—যাহার গূঢ়, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ অস্পষ্ট হইয়া তাহার কানে পৌঁছিতেছে, উহার ধর্ম ও অধর্ম, ভাল ও মন্দ, আপনার ও পর—পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর প্রতি কি গভীর নির্মম অবহেলা!

নারীর চোখের জলে উহার করুণা নাই, রমণীর রূপ ও যৌবনে উহার মমতা নাই, আকর্ষণ নাই, স্বামী-পুত্রবতীর সতীধর্মকে নিতান্ত নিরর্থক হত্যা করিতে উহার বাধে না, তাহাদের হৃদয়ের রক্তে দুই পা ভরিয়া গেলেও ভ্রূক্ষেপ করে না, যে নিজের প্রাণটাকে পর্যন্ত এইমাত্র তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া তাহারি প্রদত্ত বিষ অসঙ্কোচে চোখ মুদিয়া ভক্ষণ করিল, এতটুকু দ্বিধা করিল না, অশ্রদ্ধা ও অনাসক্তির এই অপরিমেয় পাষাণ-ভার ঠেলিয়া কি মা-চণ্ডীই তাহার পরিত্রাণের পথ করিতে পারিবেন!

এমনি করিয়া সে যেদিকে দৃষ্টিপাত করিল নিদারুণ আঁধার ব্যতীত এতটুকু আলোক-রশ্মিও চোখে পড়িল না। তখন পরিপূর্ণ নিরাশ্বাস তাহার ওই একমাত্র দেবতার মন্দির ঘুরিয়াই কেবল কল্পনার জাল বুনিতে লাগিল।

ভোরের দিকে বোধ করি সে একটুখানি তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ পিঠের উপর একটা চাপ অনুভব করিয়া ধড়মড় করিয়া সোজা উঠিয়া বসিয়া দেখিল, জানালা দিয়া সূর্যের আলোক ঘরে প্রবেশ করিয়াছে।

বাহির হইতে যে দ্বার ঠেলিতেছিল, সে কহিল, আপনি বেরিয়ে আসুন, আমি এককড়ি।

ষোড়শী গায়ের বস্ত্র সংযত করিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং দ্বার খুলিয়া সম্মুখেই দেখিতে পাইল, গত রাত্রির সেই শয্যার উপর জীবানন্দ প্রায় তেমনিভাবেই বালিশে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে। কাল দীপের স্বল্প আলোকে তাহার মুখখানা ষোড়শী ভাল দেখিতে পায় নাই, কিন্তু আজ একমুহূর্তের দৃষ্টিপাতেই দেখিতে পাইল সুদীর্ঘ অত্যাচার তাহার দেহের প্রতি অঙ্গে কত বড় গভীর আঘাত করিয়াছে। বয়স ঠিক অনুমান হয় না—হয়ত চল্লিশ, হয়ত আরও বেশী—রগের দুইধারে কিছু কিছু চুল পাকিয়াছে, প্রশস্ত ললাট রেখায় ভরা, তাহারি উপরে কালো কালো ছাপ পড়িয়াছে। যক্ষ্মারোগীর চোখের মত দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ এবং তাহারই নীচে শীর্ণ নাকটা যেন খাঁড়ার মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সমস্ত মুখখানা অত্যন্ত ম্লান, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া ভিতরের কি একটা অব্যক্ত বেদনা যেন কালিমাব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে।

জীবানন্দ হাত নাড়িয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, তোমার ভয় নেই, কাছে এসো।

ষোড়শী ধীরে ধীরে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া নতনেত্রে নীরবে দাঁড়াইল। জীবানন্দ কহিল, পুলিশের লোক বাড়ি ঘিরে ফেলেছে—ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব গেটের মধ্যে ঢুকেছেন—এলেন বলে।

ষোড়শী মনে মনে চমকিয়া উঠিল, কিন্তু কথা কহিল না। জীবানন্দ বলিতে লাগিল, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট টুরে বেরিয়ে ক্রোশখানেক দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন, তোমার বাবা কাল রাত্রেই তাঁর কাছে গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন। কেবল তাতেই এতটা হতো না, কে-সাহেবের নিজেরই আমার উপর ভারী রাগ। গত বৎসর দু’বার ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পারেনি—আজ একেবারে হাতে হাতে ধরে ফেলেছে, বলিয়া সে একটু হাসিল।

এককড়ি মুখ চুন করিয়া পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, কহিল, হুজুর, এবার বোধ হয় আমাদেরও আর রক্ষে নেই।

জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সম্ভব বটে। ষোড়শীকে কহিল, শোধ নিতে চাও ত এই-ই সময়। আমাকে জেলে দিতেও পারো।

ষোড়শী জবাব দিতে গিয়া মুখ তুলিয়াই দেখিল জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। চোখ নামাইয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, এতে জেল হবে কেন?

জীবানন্দ কহিল, আইন। তা ছাড়া কে-সায়েবের হাতে পড়েচি। বাদুড়বাগানের মেসে থাকতে, এরই কাছে একবার দিন-কুড়ি হাজত-বাসও হয়ে গেছে। কিছুতে জামিন দিলে না—আর জামিন বা তখন হতো কে!

ষোড়শী হঠাৎ উৎসুককণ্ঠে প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, আপনি কি কখনো বাদুড়বাগানের মেসে ছিলেন?

জীবানন্দ কহিল, হ্যাঁ। ওই সময়ে একটা প্রণয়কাণ্ডের বৃন্দে হয়েছিলুম—ব্যাটা আয়ান ঘোষ কিছুতেই ছাড়লে না—পুলিশে দিলে। যাক সে অনেক কথা। কে আমাকে ভোলেনি, বেশ চেনে। আজও পালাতে পারতুম, কিন্তু ব্যথায় শয্যাগত হয়ে পড়েচি, নড়বার জো নেই।

ষোড়শী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কালকের ব্যথাটা কি আপনার সারেনি?

জীবানন্দ কহিল, না ভয়ানক বেড়েচে। তা ছাড়া এ সারবার ব্যথাও নয়।

ষোড়শী একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে কি করতে হবে?

জীবানন্দ কহিল, শুধু বলতে হবে তুমি নিজের ইচ্ছেয় এসেচ, নিজের ইচ্ছেয় এখানে আছো। তা বদলে, তোমার সমস্ত দেবোত্তর ছেড়ে দেব, হাজার টাকা নগদ দেব, আর নজরের ত কথাই নেই।

এককড়ি এই কথাগুলারই বোধ হয় প্রতিধ্বনি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু ষোড়শীর মুখের পানে চাহিয়া সহসা থামিয়া গেল। ষোড়শী সোজা জীবানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, এ কথা স্বীকার করার অর্থ বোঝেন? তারপরেও কি আমার জমিতে, টাকাকড়িতে প্রয়োজন থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

0 Shares