দেবদাস

অপরাহ্নবেলায় ধর্মদাস জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল। দেবদাসকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। দেব্‌তা, আজ তিন-চারদিন ধরে মা কত যে কাঁদচেন—

কেন রে?

কিছু না বলে হঠাৎ চলে এলে কেন? একখানা পত্র বাহির করিয়া হাতে দিয়া কহিল, মার চিঠি।

চুনিলাল ভিতরের খবর বুঝিবার জন্য উৎসুকভাবে চাহিয়া রহিল। দেবদাস পত্র পাঠ করিয়া রাখিয়া দিল। জননী বাটী আসিবার জন্য আদেশ ও অনুরোধ করিয়া লিখিয়াছেন।সমস্ত বাটীর মধ্যে তিনিই শুধু দেবদাসের অকস্মাৎ তিরোধানের কারণ কতকটা অনুমান করিতে পারিয়াছিলেন। ধর্মদাসের হাত দিয়া লুকাইয়া অনেকগুলি টাকাও পাঠাইয়াছিলেন। ধর্মদাস সেগুলি হাতে দিয়া কহিল, দেব্‌তা, বাড়ি চল।

আমি যাব না। তুই ফিরে যা।

রাত্রিতে দুই বন্ধু বেশবিন্যাস করিয়া বাহির হইল। দেবদাসের এ-সকলে তেমন প্রবৃত্তি ছিল না, কিন্তু চুনিলাল কিছুতেই সামান্য পোশাকে বাহির হইতে রাজী হইল না। রাত্রি নয়টার সময় একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ি চিৎপুরের একটি দ্বিতল বাটীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। চুনিলাল দেবদাসের হাত ধরিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। গৃহস্বামিনীর নাম চন্দ্রমুখী—সে আসিয়া অভ্যর্থনা করিল। এইবার দেবদাসের সর্বশরীর জ্বালা করিয়া উঠিল। সে যে এই কয়দিন ধরিয়া নিজের অজ্ঞাতসারে নারীদেহের ছায়ার উপরেও বিমুখ হইয়া উঠিতেছিল, ইহা সে নিজেই জানিত না।

চন্দ্রমুখীকে দেখিবামাত্রই অন্তরের নিবিড় ঘৃণা দাবদাহের ন্যায় বুকের ভিতর প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। চুনিলালের মুখপানে চাহিয়া ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, চুনিবাবু, এ কোন হতভাগা জায়গায় আনলে? তার তীব্রকণ্ঠ ও চোখের দৃষ্টি দেখিয়া চন্দ্রমুখী ও চুনিলাল উভয়েই হতবুদ্ধি হইয়া গেল। পরক্ষণেই চুনিলাল আপনাকে সামলাইয়া লইয়া দেবদাসের একটা হাত ধরিয়া কোমল-কণ্ঠে কহিল, চল চল, ভিতরে গিয়ে বসি।

দেবদাস আর কিছু কহিল না—ঘরের ভিতরে আসিয়া নীচের বিছানায় বিষণ্ণ নতমুখে উপবেশন করিল। চন্দ্রমুখীও নীরবে অদূরে বসিয়া পড়িল। ঝি রূপা-বাঁধানো হুঁকায় তামাক সাজিয়া আনিয়া দিল—দেবদাস স্পর্শও করিল না। চুনিলাল মুখ ভার করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ঝি কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া অবশেষে চন্দ্রমুখীর হাতেই হুঁকাটা দিয়া প্রস্থান করিল। সে দুই-একবার টানিবার সময়, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেবদাস তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া, হঠাৎ নিরতিশয় ঘৃণাভরে বলিয়া উঠিল, কি অসভ্য আর কি বিশ্রীই দেখতে!

ইতিপূর্বে চন্দ্রমুখীকে কেহ কখনো কথায় ঠকাইতে পারে নাই। তাহাকে অপ্রতিভ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু দেবদাসের এই আন্তরিক ঘৃণার সরল এবং কঠিন উক্তি তাহার ভিতরে গিয়া পৌঁছিল। ক্ষণকালের জন্য সে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরে আরও বার-দুই গুড়গুড় করিয়া শব্দ হইল, কিন্তু চন্দ্রমুখীর মুখ দিয়া আর ধোঁয়া বাহির হইল না। তখন চুনিলালের হাতে হুঁকা দিয়া সে একবার দেবদাসের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার পর নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। নির্বাক তিনজনেই। শুধু গুড়গুড় করিয়া হুঁকার শব্দ হইতেছে, কিন্তু তাহা যেন বড় ভয়ে ভয়ে। বন্ধুমণ্ডলীর মাঝে তর্ক উঠিয়া হঠাৎ নিরর্থক একটা কলহ হইয়া গেলে, প্রত্যেকেই যেমন নীরবে নিজের মনে ফুলিতে থাকে, এবং ক্ষুব্ধ অন্তঃকরণ মিছামিছি কহিতে থাকে, তাইত! এমনি তিনজনেই মনে মনে বলিতে লাগিল, তাইত! এ কেমন হইল!

যেমনই হোক, কেহই স্বস্তি পাইতেছিল না। চুনিলাল হুঁকা রাখিয়া দিয়া নীচে নামিয়া গেল, বোধ করি আর কোন কাজ খুঁজিয়া পাইল না,—তাই। ঘরে দুইজন বসিয়া রহিল। দেবদাস মুখ তুলিয়া কহিল, তুমি টাকা নাও?

চন্দ্রমুখী সহসা উত্তর দিতে পারিল না। আজ তার চব্বিশ বৎসর বয়স হইয়াছে, এই নয়-দশ বৎসরের মধ্যে কত বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইয়াছে; কিন্তু এমন আশ্চর্য লোক সে একটি দিনও দেখে নাই। একটু ইতস্তত করিয়া কহিল, আপনার যখন পায়ের ধুলো পড়েচে—

দেবদাস কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বলিয়া উঠিল, পায়ের ধুলোর কথা নয়। টাকা নাও তো?

তা নিই বৈ কি। না হলে আমাদের চলবে কিসে?

থাক, অত শুনতে চাইনে। বলিয়া সে পকেটে হাত দিয়া একখানা নোট বাহির করিল এবং চন্দ্রমুখীর হাতে দিয়াই চলিতে উদ্যত হইল—একবার চাহিয়াও দেখিল না কত টাকা দিল।

চন্দ্রমুখী বিনীতভাবে কহিল, এরি মধ্যে যাবেন?

দেবদাস কথা কহিল না—বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

চন্দ্রমুখীর একবার ইচ্ছা হইল, টাকাটা ফিরাইয়া দেয়; কিন্তু কেমন একটা তীব্র সঙ্কোচের বশে পারিল না, বোধ করি বা একটু ভয়ও তাহার হইয়াছিল। তা ছাড়া অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অপমান সহ্য করা অভ্যাস তাহাদের আছে বলিয়াই নির্বাক নিস্পন্দ হইয়া চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দেবদাস সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া গেল।

সিঁড়ির পথেই চুনিলালের সহিত দেখা হইল। সে আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, কোথায় যাচ্চ দেবদাস?

বাসায় যাচ্চি।

সে কি হে?

দেবদাস আরও দুই-তিনটি সিঁড়ি নামিয়া পড়িল।

চুনিলাল কহিল, চল, আমিও যাই।

দেবদাস কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, চল।

একটু দাঁড়াও, একবার উপর থেকে আসি।

না, আমি যাই, তুমি পরে এসো; বলিয়া দেবদাস চলিয়া গেল।

চুনিলাল উপরে আসিয়া দেখিল, চন্দ্রমুখী তখনও সেইভাবে চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

তাহাকে দেখিয়া কহিল, বন্ধু চলে গেল?

হ্যাঁ।

চন্দ্রমুখী হাতের নোট দেখাইয়া কহিল, এই দেখ। কিন্তু ভাল বোধ কর তো নিয়ে যাও; তোমার বন্ধুকে ফিরিয়ে দিয়ো।

চুনিলাল কহিল, সে ইচ্ছে করে দিয়ে গেছে, আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো কেন?

এতক্ষণ পরে চন্দ্রমুখী একটুখানি হাসিতে পারিল; কিন্তু হাসিতে আনন্দ ছিল না। কহিল, ইচ্ছে করে নয়, আমরা টাকা নিই বলে রাগ করে দিয়ে গেছে। হাঁ, চুনিবাবু, লোকটা কি পাগল?

0 Shares