দেবদাস

মহেন্দ্র বলিল, কেন বল দেখি?

স্ত্রী কহিল, দাসদাসীরা দেখতে পায়, আর তুমি পাও না? কর্তার নতুনগিন্নী-অন্ত প্রাণ, তিনি তো আর কিছু বলবেন না; কিন্তু তোমার বলা উচিত।

মহেন্দ্র কথাটা বুঝিল না, কিন্তু উৎসুক হইয়া উঠিল; জিজ্ঞাসা করিল, কিসের কথা?

জলদবালা গম্ভীর হইয়া স্বামীকে মন্ত্রণা দিতে লাগিল—নতুন মার ছেলেমেয়ে নাই, তাঁর কেন সংসারে টান হবে, সব উড়িয়ে দিলেন, দেখতেও পাও না?

মহেন্দ্র ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কহিল, কি করে!

জলদ কহিল, তোমার চোখ থাকলে দেখতে পেতে। আজকাল সংসারের দ্বিগুণ খরচ—সদা ব্রত, দান-খয়রাত, অতিথি-ফকির। আচ্ছা, তিনি যেন পরকালের কাজ করচেন; কিন্তু তোমারও তো ছেলেমেয়ে হবে? তখন তারা খাবে কি? নিজের জিনিস বিলিয়ে দিয়ে কি শেষে ভিক্ষে করবে নাকি?

মহেন্দ্র শয্যার উপর উঠিয়া বসিয়া কহিল, তুমি কার কথা বলচ, মার কথা?

জলদ কহিল, আমার পোড়া কপাল যে, এ-সব আবার মুখ ফুটে বলতে হয়।

মহেন্দ্র কহিল, তাই তুমি মার নামে নালিশ করতে এসেচ?

জলদ রাগ করিয়া বলিল, আমার নালিশ-মকদ্দমার দরকার নেই। শুধু ভেতরের খবরটা জানিয়ে দিলুম, নইলে শেষে আমাকেই দোষ দিতে।

মহেন্দ্র অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া কহিল, তোমার বাপের বাড়িতে রোজ হাঁড়ি চড়ে না, তুমি জমিদারের বাড়ির খরচের ব্যাপার কি বোঝ?

এবার জলদও রাগিয়া উঠিল; বলিল, তোমার মার বাপের বাড়িতেই-বা ক’টা অতিথিশালা আছে শুনি?

মহেন্দ্র আর তর্কাতর্কি না করিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। সকালে উঠিয়া পার্বতীর কাছে আসিয়া কহিল, কি বিয়ে দিলে মা, একে নিয়ে সংসার করাই যে যায় না। আমি কলকাতায় চললুম।

পার্বতী অবাক হইয়া কহিল, কেন বাবা?

তোমাদের নামে কটু কথা বলে—আমি ওকে ত্যাগ করলুম।

পার্বতী কিছুদিন হইতেই বড়বৌয়ের আচরণ লক্ষ্য করিয়া আসিতেছিল; কিন্তু সে ভাব চাপা দিয়া হাসিয়া বলিল, ছিঃ বাবা, সে যে আমার বড় ভাল মেয়ে! তার পর সে জলদকে নিভৃতে ডাকিয়া কহিল, বৌমা, ঝগড়া হয়েচে বুঝি?

সকাল হইতেই জলদ স্বামীর কলিকাতা-যাত্রার আয়োজন দেখিয়া মনে মনে ভয় পাইয়াছিল; শাশুড়ীর কথায় কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, আমারই দোষ মা। কিন্তু ঐ দাসীরাই খরচপত্রের কথা নিয়ে বলাবলি করে।

পার্বতী তখন সমস্ত শুনিল। নিজে লজ্জিত হইয়া বধূর চোখ মুছাইয়া দিয়া কহিল, বৌমা, তুমি ঠিক বলেচ। কিন্তু আমি মা তেমন সংসারী নই, তাই খরচের দিকটা আমার স্মরণ ছিল না।

তাহার পর মহেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিল, বাবা, বিনাদোষে রাগ করো না—তুমি স্বামী, তোমার মঙ্গল-চিন্তার কাছে স্ত্রীর আর সব তুচ্ছ হওয়া উচিত। বৌমা তোমার লক্ষ্মী।

কিন্তু সেইদিন হইতে পার্বতী হাত গুটাইয়া আনিল। অতিথিশালার, ঠাকুরবাড়ির আর তেমন সেবা হইল না; অনাথ, অন্ধ, ফকির অনেকে ফিরিয়া যাইতে লাগিল। কর্তা শুনিয়া পার্বতীকে ডাকিয়া কহিলেন, কনেবৌ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কি ফুরাল নাকি?

পার্বতী সহাস্যে উত্তর দিল, শুধু দিলেই চলবে কেন? দিনকতক জমা করাও তো চাই—দেখচ না, খরচ কত বেড়ে গেছে!

তা যাক। আমার আর ক’দিন! দিনকতক সৎকর্ম করে পরকালের দিকটা দেখা উচিত।

পার্বতী হাসিয়া কহিল, এ যে বড় স্বার্থপরের মতো কথা গো! নিজেরটাই দেখবে, আর ছেলেমেয়েরা কি ভেসে যাবে? দিনকতক আবার চুপ করে থাকো, তার পর আবার সব হবে। কাজ মানুষের তো আর ফুরিয়ে যায় না!

কাজেই চৌধুরী মহাশয় নিরস্ত হইলেন।

পার্বতীর এখন কাজ কমিয়াছে, তাই ভাবনাটা কিছু বাড়িয়াছে। কিন্তু সমস্ত ভাবনারই একটা ধরন আছে। যাহার আশা আছে, সে একরকম করিয়া ভাবে; আর যাহার আশা নাই, সে অন্যরকম ভাবে। পূর্বোক্ত ভাবনার মধ্যে সজীবতা আছে, সুখ আছে, তৃপ্তি আছে, দুঃখ আছে, উৎকণ্ঠা আছে; তাই মানুষকে শ্রান্ত করিয়া আনে—বেশীক্ষণ ভাবিতে পারে না। কিন্তু আশাহীনের সুখ নাই, দুঃখ নাই, উৎকণ্ঠা নাই, অথচ তৃপ্তি আছে। চোখ দিয়া জলও পড়ে, গভীরতাও আছে—কিন্তু নিত্য নূতন করিয়া মর্মভেদ করে না। হালকা মেঘের মতো যথা-তথা ভাসিয়া চলে। যেখানে বাতাস লাগে না, সেখানে দাঁড়ায়; আর যেখানে লাগে, সেখান হইতে সরিয়া যায়; তন্ময় মন উদ্বেগহীন চিন্তায় একটা সার্থকতা লাভ করে। পার্বতীর আজকাল ঠিক তাই হইয়াছে। পূজা-আহ্নিক করিতে বসিয়া অস্থির, উদ্দেশ্যহীন হতাশ মনটা চট্‌ করিয়া একবার তালসোনাপুরের বাঁশঝাড়, আমবাগান, পাঠশালা-ঘর, বাঁধের পাড় প্রভৃতি ঘুরিয়া আসে। আবার হয়ত এমন কোন স্থানে লুকাইয়া পড়ে যে, পার্বতী নিজেকেই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারে না। আগে হয়ত ঠোঁটের কোণে হাসি আসিয়াছিল, এখন হয়ত একফোঁটা চোখের জল টপ্‌ করিয়া কোষার জলের সঙ্গে মিশিয়া যায়। তবু দিন কাটে। কাজ করিয়া, মিষ্ট কথাবার্তা কহিয়া, পরোপকার, সেবা-শুশ্রূষা করিয়াও কাটে, আবার সব ভুলিয়া ধ্যানমগ্না যোগিনীর মতো কাটে। কেহ কহে লক্ষ্মীস্বরূপা অন্নপূর্ণা! কেহ কহে অন্যমনস্কা উদাসিনী! কিন্তু কাল সকাল হইতে তাহার অন্য একরকমের পরিবর্তন দেখা দিয়াছে। যেন কিছু তীব্র, কিছু কঠোর। সেই পরিপূর্ণ থমথমে জোয়ার-গঙ্গায় যেন হঠাৎ কোথা হইতে ভাটার টান ধরিয়াছে। বাড়ির কেহ কারণ জানে না, শুধু আমরা জানি। মনোরমা কাল গ্রাম হইতে একখানা পত্র লিখিয়াছে। যাহা লিখিয়াছে, তাহা এইরূপ—

পার্বতী, অনেকদিন হইতে দু’জনের কেহ কাহাকেও পত্র লিখি নাই, সেজন্য দোষটা উভয়তঃ হইয়াছে। আমার ইচ্ছা একটা মিটমাট হইয়া যায়। দু’জনেই দোষ স্বীকার করিয়া অভিমানটা কম করি। কিন্তু আমি বড়, তাই আমি মানভিক্ষা চাহিয়া লইলাম। ভরসা করি শীঘ্র উত্তর দিবে। আজ প্রায় একমাস হইল এখানে আসিয়াছি। আমরা গৃহস্থঘরের মেয়েরা শারীরিক ভালমন্দটা তেমন বুঝি না।

মরিলে বলি গঙ্গায় গিয়াছে; আর বাঁচিয়া থাকিলে বলি, ভাল আছে। আমিও তাই ভাল আছি। কিন্তু এ তো গেল নিজের কথা, বাজে কথা। কাজের কথাও এমন যে কিছু আছে, তাও নয়। তবে একটা সংবাদ দিতে বড় ইচ্ছা হইয়াছে। কাল হইতে ভাবিতেছি দিব কি না। দিলে তোমার ক্লেশ হইবে, না দিলেও আমি বাঁচি না—যেন মারীচের দশা হইয়াছে। দেবদাসের কথা শুনিয়া তোমার তো দুঃখ হইবেই, কিন্তু আমিও যে তোমার কথা মনে করিয়া না কাঁদিয়া থাকিতে পারি না। ভগবান রক্ষা করিয়াছেন, না হইলে তুমি যে অভিমানিনী, তার হাতে পড়িলে এতদিন হয় জলে ডুবিতে, না হয় বিষ খাইতে। আর তার কথা আজ শুনিলেও শুনিবে, দু’দিন পরে হইলেও শুনিবে, কেননা, যে কথা সংসারসুদ্ধ লোকে জানে, তার আর চাপাচাপি কি?

0 Shares