দেবদাস

বড়বৌ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, আমার কাছে সব বাঁধা। ঠাকুরপো একেবারে বয়ে গেছে! কলকাতায় মদ-বেশ্যা এই নিয়েই আছে। কত টাকা উড়িয়ে দিলে তার কি আদি-অন্ত আছে!

চন্দ্রমুখীর মুখ শুকাইল, একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ মা, ছোটবাবু কি তা হলে বাড়িও আসেন না?

বড়বৌ বলিলেন, আসবে না কেন ! যখন টাকার দরকার হয়, আসে। ধার করে, বিষয় দেয়—চলে যায়। এই মাস-দুই হল এসে বারো হাজার টাকা নিয়ে গেছে। বাঁচবার আকারও নেই, গা-ময় কুচ্ছিত রোগ জন্মেচে—ছিঃ—ছিঃ—

চন্দ্রমুখী শিহরিয়া উঠিল—মলিন-মুখে জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কলকাতায় কোথায় থাকেন?

বড়বৌ কপালে একটা করাঘাত করিয়া হাসিমুখে কহিলেন, পোড়া দশা! তা কেউ কি জানে? কোথায় কোন্‌ হোটেলে খায়—যার-তার বাড়িতে পড়ে থাক—সেই জানে,—আর যম জানে।

চন্দ্রমুখী সহসা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি—যাই—

বড়বৌ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, যাবে? ওরে ও বিন্দু—

চন্দ্রমুখী বাধা দিয়া বলিল, থাক্‌ মা, আমি আপনিই কাছারিতে যেতে পারব, বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। বাটীর বাহির হইয়া দেখিল, ভৈরব অপেক্ষা করিয়া আছে—গো-শকট প্রস্তুত। সেই রাত্রে চন্দ্রমুখী বাটী ফিরিয়া আসিল। সকালবেলা ভৈরবকে আবার ডাকিয়া কহিল, ভৈরব, আমি আজ কলকাতায় যাব; তুমি তো যেতে পারবে না, তাই তোমার ছেলেকে সঙ্গে নেব, কি বল?

তোমার ইচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় কেন মা, বিশেষ কোন কাজ আছে কি?

হাঁ ভৈরব, বিশেষ কাজ আছে।

আবার কবে আসবে মা?

সে কথা বলতে পারিনে ভৈরব। হয়ত শীঘ্র ফিরে আসব, হয়ত বা দেরি হবে। আর যদি না আসি, এ-সব ঘরবাড়ি তোমার রইল।

প্রথমে ভৈরব অবাক হইয়া গেল। তাহার পর তাহার দু’চোখ জলে ভরিয়া গেল। কহিল, ও কি কথা মা! তুমি না এলে এ গাঁয়ের লোক যে কেউ বাঁচবে না।

চন্দ্রমুখী সজলচক্ষে মৃদু হাসিয়া বলিল, সেকি ভৈরব, আমি দু’বছর হল এখানে এসেচি। তার পূর্বে কি তোমরা বেঁচে ছিলে না?

ইহার উত্তর মূর্খ ভৈরব দিতে পারিল না, কিন্তু চন্দ্রমুখী অন্তরে সমস্তই বুঝিল। ভৈরবের ছেলে কেব্‌লা শুধু সঙ্গে যাইবে। গাড়িতে আবশ্যক দ্রব্যাদি বোঝাই করিয়া উঠিবার সময় পাড়ার মেয়ে-পুরুষ সবাই দেখিতে আসিল, দেখিয়া কাঁদিতে লাগিল। চন্দ্রমুখীর নিজের চোখেও জল ধরে না। ছাই কলিকাতা! দেবদাসের জন্য না হইলে কলিকাতার রানীগিরি পাইবার জন্যও চন্দ্রমুখী এত ভালবাসা তুচ্ছ করিয়া যাইতে পারিত না।

পরদিন সে ক্ষেত্রমণির বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পূর্বের বাসাতে এখন অন্য লোক আসিয়াছে। ক্ষেত্রমণি অবাক হইয়া গেল—দিদি যে! কোথায় ছিলে এতদিন?

চন্দ্রমুখী সত্য কথা গোপন করিয়া বলিল, এলাহাবাদে ছিলাম।

ক্ষেত্রমণি ভাল করিয়া নজর দিয়া তাহার সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, তোমার গহনাগাঁটি কি হল দিদি?

চন্দ্রমুখী হাসিয়া সংক্ষেপে বলিল, সব আছে।

সেই দিন মুদীর সহিত দেখা করিয়া কহিল, দয়াল, কত টাকা আমি পাব?

দয়াল বিপদে পড়িল—তা বাছা, প্রায় ষাট-সত্তর টাকা। আজ না হোক দু’দিন পরে দিব।

তোমাকে কিছুই দিতে হবে না। যদি আমার কিছু কাজ করে দাও।

কি কাজ?

দু’দিন খাটতে হবে এই মাত্র। আমাদের পাড়ায় একটা বাড়ি ভাড়া করবে—বুঝলে?

দয়াল হাসিয়া বলিল, বুঝেছি বাছা।

ভাল বাড়ি। বেশ ভাল বিছানা, বালিশ, চাদর, আলো, ছবি, দুটো চেয়ার, একটা টেবিল—বুঝলে?

দয়াল মাথা নাড়িল।

আরশি, চিরুনি, রং-করা দু’জোড়া কাপড়, গায়ের জামা, আর—ভাল গিল্টির গয়না কোথায় পাওয়া যায় জান?

দয়াল মুদী ঠিকানা বলিয়া দিল।

চন্দ্রমুখী কহিল, তবে তাও এক সেট ভাল দেখে কিনতে হবে—আমি সঙ্গে গিয়ে পছন্দ করে নেব। তারপর হাসিয়া কহিল, আমাদের যা চাই, জানো তো সব,—একজন ঝিও ঠিক করতে হবে।

দয়াল কহিল, কবে চাই বাছা?

যত শীঘ্র হয়। দু’তিন দিনের মধ্যে হলেই ভাল হয়। বলিয়া চন্দ্রমুখী তাহার হাতে একশত টাকার নোট দিয়া কহিল,—ভালো জিনিস নিয়ো, সস্তা করো না।

তৃতীয় দিবসে সে নূতন বাটীতে চলিয়া গেল। সমস্ত দিন ধরিয়া কেবলরামকে লইয়া মনের মতো করিয়া ঘর সাজাইল এবং সন্ধ্যার পূর্বে আপনি সাজিতে বসিল। সাবান দিয়া মুখ ধুইয়া তাহাতে পাউডার দিল, আলতা গুলিয়া পায়ে দিল, পান খাইয়া ওষ্ঠ রঞ্জিত করিল। তাহার পর সর্বাঙ্গে গহনা পরিয়া জামা আঁটিয়া রং-করা কাপড় পরিল; বহুদিন পরে চুল বাঁধিয়া আবার টিপ পরিল। আয়নায় মুখ দেখিয়া মনে মনে হাসিয়া বলিল, পোড়া অদৃষ্টে আরও কি আছে!

পাড়াগাঁয়ের ছেলে কেবলরাম সহসা এই অভিনব সাজ-সজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ দেখিয়া ভীত হইয়া কহিল, দিদি, এ কি!

চন্দ্রমুখী হাসিয়া বলিল, কেবল, আজ আমার বর আসবে।

কেবলরাম বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল।

সন্ধ্যার পর ক্ষেত্রমণি বেড়াইতে আসিল,—দিদি, এ আবার কি?

চন্দ্রমুখী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, এ-সব চাই তো আবার।

ক্ষেত্রমণি কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া কহিল, দিদির যত বয়স বাড়চে, রূপও তত বাড়চে।

সে চলিয়া গেলে চন্দ্রমুখী বহুদিন পূর্বের মতো আবার জানলার পার্শ্বে উপবেশন

করিল। নির্নিমেষচক্ষে রাস্তার পানে চাহিয়া রহিল। এই তাহার কাজ; এই করিতে সে আসিয়াছে—যতদিন এখানে থাকিবে, ততদিন ইহাই করিবে। নূতন লোক কেহ হয়ত আসিতে চায়, দ্বার ঠেলাঠেলি করে; কেবলরাম মুখস্থর মতো ভিতর হইতে কহে—এখানে নয়।

পুরাতন পরিচিত কেহ বা আসিয়া উপস্থিত হয়। চন্দ্রমুখী বসাইয়া হাসিয়া কথা কহে; কথায় কথায় দেবদাসের কথা জিজ্ঞাসা করে; তাহারা বলিতে পারে না—অমনি বিদায় করিয়া দেয়। রাত্রি অধিক হইলে নিজে বাহির হইয়া পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়ায়। অলক্ষ্যে দ্বারে দ্বারে কান পাতিয়া কথাবার্তা শুনিতে চায়—নানা লোকে নানা কথা বলে, যাহা শুনিতে চায়, তাহা কিন্তু শোনা যায় না—কেহ বা মুখ ঢাকিয়া হঠাৎ মুখের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয়—স্পর্শ করিবার জন্য হাত বাড়ায়—শশব্যস্তে চন্দ্রমুখী সরিয়া যায়। দুপুরবেলা পুরাতন পরিচিত সঙ্গিনীদের বাড়ি বেড়াইতে যায়। কথায় কথায় প্রশ্ন করে,—কেহ দেবদাসকে জান?

0 Shares