দেবদাস

সহানুভূতি সহ্য হইবে না, আর তিরস্কার-লাঞ্ছনা?—তা তার চেয়ে তো মরণ ভাল। মনোরমার গত বৎসর বিবাহ হইয়াছে। এখনও সে শ্বশুরবাড়ি যায় নাই, তাই মাঝে মাঝে বেড়াইতে আসে। পূর্বে দুই সখীতে মিলিয়া মাঝে মাঝে এইসব কথাবার্তা হইত, এখনও হয়; কিন্তু পার্বতী আর যোগ দেয় না—হয় চুপ করিয়া থাকে, না হয় কথা উলটাইয়া দেয়।

পার্বতীর পিতা কাল রাত্রে বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয়দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন। এখন বিবাহের সমস্ত স্থির করিয়া ঘরে আসিয়াছেন। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ক্রোশ দূরে বর্ধমান জেলায় হাতীপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র। তাঁহার অবস্থা ভাল, বয়স চল্লিশের নীচেই—গত বৎসর স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে, তাই আবার বিবাহ করিবেন। সংবাদটা যে বাটীর সকলেরই চিত্তরঞ্জন করিয়াছিল, তাহা নহে, বরং দুঃখের কারণই হইয়াছিল; তবে একটা কথা এই যে, ভুবন চৌধুরীর নিকট হইতে সর্বরকমে প্রায় দু’তিন হাজার টাকা ঘরে আসিবে। তাই মেয়েরা চুপ করিয়া ছিলেন।

একদিন দুপুরবেলা দেবদাস আহারে বসিয়াছিল। মা কাছে বসিয়া কহিলেন, পারুর যে বিয়ে।

দেবদাস মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবে?

এই মাসেই। কাল মেয়ে দেখে গেছে। বর নিজেই এসেছিল।

দেবদাস কিছু বিস্মিত হইল,—কৈ, আমি তো কিছু জানিনে মা!

তুমি আর কি করে জানবে? বর দোজবরে—বয়স হয়েচে; তবে বেশ টাকাকড়ি নাকি আছে, পারু সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে।

দেবদাস মুখ নিচু করিয়া আহার করিতে লাগিল। তাহার জননী পুনরায় কহিতে লাগিলেন, ওদের ইচ্ছা ছিল এই বাড়িতে বিয়ে দেয়।

দেবদাস মুখ তুলিল—তার পর?

জননী হাসিলেন—ছিঃ, তা কি হয়! একে বেচা-কেনা ছোটঘর, তাতে আবার ঘরের পাশে বিয়ে, ছি ছি—বলিয়া মা ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিলেন। দেবদাস তাহা দেখিতে পাইল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মা পুনরায় কহিলেন, কর্তাকে আমি বলেছিলাম।

দেবদাস মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবা কি বললেন?

কি আর বলবেন! এতবড় বংশের মুখ হাসাতে পারবেন না,—তাই আমাকে শুনিয়ে দিলেন।

দেবদাস আর কথা কহিল না।

সেইদিন দ্বিপ্রহরে মনোরমা ও পার্বতীতে কথোপকথন হইতেছিল। পার্বতীর চোখে জল,—মনোরমা বোধ করি এইমাত্র মুছিয়াছে। মনোরমা কহিল,—তবে উপায় বোন?

পার্বতী চোখ মুছিয়া কহিল, উপায় আর কি? তোমার বরকে তুমি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলে?

আমার কথা আলাদা। আমার পছন্দ ছিল না, অপছন্দও হয়নি; তাই আমার কোন কষ্টই ভোগ করতে হয় না। কিন্তু তুমি যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেচ বোন!

পার্বতী জবাব দিল না,—ভাবিতে লাগিল।

মনোরমা কি ভাবিয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিল, পারু, বরটির বয়স কত?

কার বরটির?

তোর।

পার্বতী একটু হিসাব করিয়া বলিল, বোধ হয় উনিশ।

মনোরমা অতিশয় বিস্মিত হইল; কহিল, সে কি, এই যে শুনলুম প্রায় চল্লিশ!

এবারে পার্বতীও একটু হাসিল; কহিল, মনোদিদি, কত লোকের বয়স চল্লিশ থাকে, আমি কি তার হিসাব রাখি? আমার বরের বয়স উনিশ-কুড়ি এই পর্যন্ত জানি।

মুখপানে চাহিয়া মনোরমা জিজ্ঞাসা করিল, কি নাম রে?

পার্বতী আবার হাসিয়া উঠিল—এতদিনে বুঝি তাও জানো না!

কি করে জানব!

জান না? আচ্ছা বলে দিই। একটু হাসিয়া, একটু গম্ভীর হইয়া পার্বতী তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া বলিল, জানিস নে—শ্রীদেবদাস—

মনোরমা প্রথমে একটু চমকাইয়া উঠিল। পরে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, আর ঠাট্টায় কাজ নেই। নাম কি, এই বেলা বল্‌, আর তো বলতে পাবিনে—

এই ত বললুম।

মনোরমা রাগ করিয়া কহিল, যদি দেবদাস নাম—তবে কান্নাকাটি করে মরচিস কেন?

পার্বতী সহসা মলিন হইয়া গেল। কি যেন একটু ভাবিয়া বলিল, তা বটে। আর তো কান্নাকাটি করব না—

পারু।

কি?

সব কথা খুলে বল্‌ না বোন! আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না।

পার্বতী কহিল, যা বলবার সবই তো বললুম।

কিন্তু কিছুই যে বোঝা গেল না রে!

যাবেও না। বলিয়া পার্বতী আর-একদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল।

মনোরমা ভাবিল, পার্বতী কথা লুকাইতেছে,—তাহার মনের কথা কহিবার ইচ্ছা নাই। বড় অভিমান হইল; দুঃখিত হইয়া কহিল, পারু, তোর যাতে দুঃখ, আমারও তো তাতে তাই বোন। তুই সুখী হ, এই তো আমার আন্তরিক প্রার্থনা। যদি কিছু তোর লুকোন কথা থাকে, আমাকে বলতে না চাস্‌, বলিস নে। কিন্তু এমন করে আমাকে তামাশা করিস নে।

পার্বতীও দুঃখিতা হইল, কহিল, ঠাট্টা করিনি দিদি। যতদূর নিজে জানি, ততদূর তোমাকেও বলেচি। আমি জানি, আমার স্বামীর নাম দেবদাস; বয়স উনিশ-কুড়ি—সেই কথাই তো তোমাকে বলেচি।

কিন্তু এই যে শুনলুম, তোর আর-কোথায় সম্বন্ধ স্থির হয়েচে!

স্থির আর কি! ঠাকুরমার সঙ্গে তো আর বিয়ে হবে না, হলে আমারই সঙ্গে হবে; আমি তো কৈ এ খবর শুনিনি!

মনোরমা যাহা শুনিয়াছিল, তাহা এখন বলিতে গেল। পার্বতী তাহাতে বাধা দিয়া বলিল, ও-সব শুনেচি।

তবে? দেবদাস তোকে—

কি আমাকে?

মনোরমা হাসি চাপিয়া বলিল, তবে স্বয়ম্বরা বুঝি? লুকিয়ে লুকিয়ে পাকা বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে?

কাঁচা-পাকা এখনও কিছুই হয়নি।

মনোরমা ব্যথিত-স্বরে কহিল, তুই কি বলিস পারু, কিছুই তো বুঝতে পারিনে।

পার্বতী কহিল, তা হলে দেবদাসকে জিজ্ঞাসা করে তোমায় বুঝিয়ে দেব।

কি জিজ্ঞাসা করবে? সে বিয়ে করবে কি না, তাই?

পার্বতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ, তাই।

মনোরমা ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া কহিল, বলিস কি পারু? তুই নিজে একথা জিজ্ঞাসা করবি?

দোষ কি দিদি?

মনোরমা একেবারে অবাক হইয়া গেল—বলিস কি রে? নিজে?

নিজেই। নইলে আমার হয়ে আর কে জিজ্ঞাসা করবে দিদি?

লজ্জা করবে না?

লজ্জা কি? তোমাকে বলতে লজ্জা করলুম?

আমি মেয়েমানুষ—তোর সই, কিন্তু সে যে পুরুষমানুষ পারু।

এবার পার্বতী হাসিয়া উঠিল; কহিল, তুমি সই, তুমি আপনার—কিন্তু তিনি কি পর? যে কথা তোমাকে বলতে পারি, সে কথা কি তাঁকে বলা যায় না?

0 Shares