নিষ্কৃতি

সিদ্ধেশ্বরী বলিলেন, টাকাটা কি তবে দেবে না নাকি?

নিশ্চয় না। তুমি বল কি, আবার নাকি আমি টাকা দিই তাকে?

তবে এমন কথা বলাই বা কেন?

হরিশ কহিলেন, বললেই যে দিতে হবে তার কোন মানে নাই বৌঠান। আমিও ত দাদার সহোদর, আমারও ত একটা মতামত নেওয়া চাই। সংসারে টাকা নষ্ট হলে আমারও ত গায়ে লাগে!

সেইটেই তোমার আসল কথা ঠাকুরপো, বলিয়া সিদ্ধেশ্বরী রাগ করিয়া উঠিয়া গেলেন।

ছয়

সিদ্ধেশ্বরীর সেবার ভার নয়নতারা গ্রহণ করিয়াছিল। সে সেবা এমনি নিরেট, এমনি ভরাট যে, তাহার কোন এতটুকু ফাঁক দিয়া আর কাহারও কাছে ঘেঁষিবার জো ছিল না। সিদ্ধেশ্বরী এমন সেবা তাঁর এতখানি বয়সে কখনও কাহারও কাছে পান নাই। তবুও কেন যে তাঁহার অশান্ত মন অনুক্ষণ শুধু ছল ধরিয়া কলহ করিবার জন্য উন্মুখ হইয়াছিল এ

রহস্য জানিত শুধু অন্তর্যামী। সেদিন সকালে সিদ্ধেশ্বরী ছয়মাসের রোগীর মত টলিয়া টলিয়া রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়া ধপ্‌ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শ্রান্ত-দুর্বলকণ্ঠে, বোধ করি বা সুমুখের দেয়ালটাকেই উপলক্ষ করিয়া বলিতে লাগিলেন, আপনার জন বটে মেজবৌ, সে না থাকলে আমাকে দেখচি বেঘোরে মরতে হয়। এমনি সেবাযত্ন আমার মায়ের পেটের বোন থাকলে করতে পারত না।

শৈল ঘরের ভিতরে রাঁধিতেছিল, সমস্তই শুনিতে পাইল। এই কয়টা দিন সে বড়জায়ের ঘরেও যায় নাই, তাঁহার সঙ্গে কথাও কহে নাই। এখনো চুপ করিয়া রহিল।

সিদ্ধেশ্বরী পুনরায় শুরু করিলেন, আর অপরকে খাওয়ানো-পরানো শুধু অধর্মের ভোগ—ভস্মে ঘি ঢালা। অসময়ে কোন কাজেই আসে না। আর এই আমার মেজবৌ। মুখের কথাটি খসাতে হয় না, হাঁ-হাঁ করে এসে পড়ে। আমি হেঁটে গেলে তার বুকে বাজে। আমার পোড়া কপাল যে, এমন মানুষকেও আমি পরের ভাঙ্‌চি শুনে পর মনে করেছিলুম।

শৈলর চুড়ির শব্দ, হাতা-বেড়ি নাড়ার শব্দ সবই তাঁহার কানে আসিতেছে। এত কাছে থাকিয়াও সে যখন এতবড় মিথ্যা অভিযোগের কোন জবাব দিল না, তখন আর তাঁহার অধৈর্যের সীমা রহিল না। তাঁর চিঁচিঁ কণ্ঠস্বর একমুহূর্তেই প্রবল ও সতেজ হইয়া উঠিল; মায়ের কাছ থেকে একখানা চিঠি এসেচে তা যে কারুকে দিয়ে একটুখানি পড়িয়ে শুনব, আমার সে জোটি পর্যন্ত নেই। পরকে খাওয়ান-পরান আমার কিসের জন্যে?

নীলা ছোটখুড়ীর কাছে বসিয়া তাহাকে সাহায্য করিতেছিল; সেইখান হইতে কহিল, সে চিঠি যে মেজখুড়ীমা তোমাকে দু-তিনবার পড়ে শোনালেন মা! আবার কবে নতুন চিঠি এল?

তুই সব কথায় গিন্নীপনা করতে যাসনে নীলা, বলিয়া মেয়েকে একটা ধমক দিয়া সিদ্ধেশ্বরী বলিলেন, চিঠি শুনলেই হ’লো। তার জবাব দিতে হবে না? কেন তোর ছোটখুড়ী কি মরেছে যে আমি ও-পাড়ার লোক ডেকে এনে চিঠির জবাব লেখাব?

নীলাও রাগ করিয়া বলিল, চিঠি লেখবার কি আর কেউ নেই মা, যে আজ সংক্রান্তির দিনটায় তুমি খুড়ীমাকে মরিয়ে দিচ্চ?

আজ সংক্রান্তি, সে কথাটা সিদ্ধেশ্বরীর স্মরণ ছিল না। তিনি একমুহূর্তেই একেবারে পাংশু হইয়া বলিলেন, তুই যে অবাক করলি নীলা? বালাই, ষাট! মরবার কথা আমি তাকে আবার কখন বললুম লা? পেটের মেয়ে আমাকে মুখনাড়া দেয়! কাল যার বিয়ে দিয়ে এনে কোলেপিঠে মানুষ করলুম, সে আমার ছায়া মাড়ায় না; এত যে রোগে ভুগচি, তবুও ত আমার মরণ হয় না! আজ থেকে আর যদি একফোঁটা ওষুধ খাই ত আমার অতি বড়—

কান্নায় সিদ্ধেশ্বরীর কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। তিনি আঁচলে চোখ মুছিতে মুছিতে নিজের ঘরে গিয়া একেবারে মড়ার মত বিছানায় শুইয়া পড়িলেন।

নয়নতারা পাশের বারান্দায় জানালার আড়ালে দাঁড়াইয়া সমস্তই দেখিতেছিল; এখন ধীরে ধীরে সিদ্ধেশ্বরীর ঘরে ঢুকিয়া তাঁহার পায়ের কাছে গিয়া বসিল। আস্তে আস্তে বলিল, একখানা চিঠির জবাব দেবার জন্য আবার তার খোশামোদ করতে যাওয়া কেন দিদি? আমাকে হুকুম করলে ত দশখানা জবাব লিখে দিতে পারতুম।

সিদ্ধেশ্বরী কথা কহিলেন না; পাশ ফিরিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়া শুইলেন।

নয়নতারা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তাহলে এখনি কি সেটা লিখে দিতে হবে দিদি?

সিদ্ধেশ্বরী হঠাৎ রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিলেন, তুমি বড় বকাও মেজবৌ। বলচি, সে এখন থাক—সে তুমি পারবে না। তা না—

নয়নতারা রাগ করিল না। যেখানে কাজ আদায় করিতে হয়, সেখানে তার ক্রোধ অভিমান প্রকাশ পাইত না। সে নীরবে উঠিয়া গেল।

বেলা দুটা-আড়াইটার সময় সিদ্ধেশ্বরী মেয়েকে ডাকিয়া চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর খুড়ীমা ভাত খেয়েছে রে?

নীলা আশ্চর্য হইয়া বলিল, খাবেন না কেন? রোজ যেমন খান, তেমনিই ত খেয়েছেন।

সিদ্ধেশ্বরী হুঁ বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

পূর্বেই বলিয়াছি, শৈল চিরকালই অত্যন্ত অভিমানী। সামান্য কারণেই সে খাওয়া বন্ধ করিত এবং তাই লইয়া সিদ্ধেশ্বরীর যন্ত্রণার অবধি ছিল না। হাতে ধরিয়া খোশামোদ করিয়া গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া নানা প্রকারে তাহাকে প্রসন্ন করিতে হইত। অথচ, সেই শৈল এবার খাওয়া-পরা সম্বন্ধে এত গঞ্জনাতেও কেন যে বিন্দুমাত্র ক্রোধ প্রকাশ করিতেছে না, ইহার কোন কারণই তিনি ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না। তাহার এই ব্যবহার তাঁহার কাছে যতই অপরিচিত এবং অস্বাভাবিক ঠেকিতে লাগিল, ততই তিনি অন্তরের মধ্যে ভয়ে ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিলেন। কোনমতে একটা প্রকাশ্য কলহ হইয়া গেলেই তিনি বাঁচেন—কিন্তু তাহার ধার দিয়াও শৈল যায় না। প্রভাত হইতে রাত্রি পর্যন্ত সে তাহার নির্দিষ্ট কাজ করিয়া যায়। তাহার আচরণে বাড়ির কেহ কিছুই দেখিতে পায় না; শুধু যিনি দশ বছরের মেয়েটিকে বুক দিয়া মানুষ করিয়া আজ এত বড় করিয়া তুলিয়াছেন তিনিই কেবল ভয়ার্তচিত্তে অনুক্ষণ অনুভব করেন শৈলর চারিপাশে এমটা নির্মম ঔদাসীন্যের গাঢ় মেঘ প্রতিদিনই পুঞ্জীভূত হইয়া তাহাকে শুধু ঝাপসা দুর্নিরীক্ষ্য করিয়াই আনিতেছে।

0 Shares