নিষ্কৃতি

কানাই অগ্রজের অধিকার লইয়া হুঙ্কার দিয়া উঠিল, পটল! বড়ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক করো না বলচি! মাকে বলে দেব।

পটল বেচারা অত্যন্ত বেগতিক দেখিয়া এবার জ্যাঠাইমার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া নালিশ করিল, বড়মা, আমি কখন থেকে শুয়ে আছি যে!

কানাই ছোটভাইয়ের স্পর্ধায় চোখ পাকাইয়া ‘পটল’ বলিয়া গর্জিয়া উঠিয়াই হঠাৎ থামিয়া গেল।

ঠিক এইসময়ে ঘরের বাহিরের বারান্দার একপ্রান্ত হইতে শৈলজার কণ্ঠস্বর আসিল, ওরে বাপ রে! দিদির ঘরে কি ডাকাত পড়েচে!

সঙ্গে সঙ্গে কি পরিবর্তন! ও-বিছানায় হরিচরণ পাঠ্যপুস্তকটা ধাঁ করিয়া বালিশের তলায় গুঁজিয়া দিয়া এবার বোধ করি একখানা অপাঠ্য পুস্তক খুলিয়া বসিয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল—চোখে তাহার জ্বলন্ত মনোযোগ। কানাই বাঁদিক ডানদিকের সমস্যা আপাততঃ নিষ্পত্তি না করিয়াই চীৎকার জুড়িয়া দিল—’যে বিস্তীর্ণ জলরাশি—’, আর সবচেয়ে আশ্চর্য ওই শিশুর দলটি! ভোজবাজির মত কোথায় তাহারা যে একমুহূর্তে অন্তর্ধান হইয়া গেল তাহার চিহ্ন পর্যন্ত রহিল না। শৈলজা কলিকাতা হইতে এইমাত্র ফিরিয়া বড়জার জন্য একবাটি গরম দুধ হাতে করিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন কানাইলালের ‘মহাসমুদ্রের গভীর কল্লোল’ ব্যতীত ঘর সম্পূর্ণ স্তব্ধ। ওদিকে হরিচরণ এমন পড়াই পড়িতে লাগিল যে, তাহার পিঠের উপর দিয়া হাতি চলিয়া গেলেও সে ভ্রূক্ষেপ করিত না। কারণ ইতিপূর্বে সে ‘আনন্দমঠ’ পড়িতেছিল। তাহার ভবানন্দ জীবানন্দ ছোটখুড়ীমার আকস্মিক শুভাগমনে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। সে ভাবিতেছিল, তাহার হাতের কসরতটা তিনি দেখিতে পাইয়াছেন কি না এবং তাহাই ঠিক অবগত না হওয়া পর্যন্ত তাহার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করিতে লাগিল।

শৈলজা কানাইয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ওরে ওই ‘বিস্তীর্ণ জলরাশি’ এতক্ষণ হচ্ছিল কি?

কানাই মুখ তুলিয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত-কণ্ঠে চিঁচিঁ করিয়া বলিল, আমি নয় মা, বিপিন আর পটল।

কারণ ইহারাই তাহার বাঁ দিক ডান দিকের মকদ্দমায় প্রধান শত্রু। সে অসঙ্কোচে এই দুটি নিরপরাধীকে বিমাতার হস্তে অর্পণ করিল।

শৈলজা বলিল, কাউকে ত দেখচি নে, এরা সব পালাল কোথা দিয়ে?

এবারে কানাই বিপুল উৎসাহে দাঁড়াইয়া উঠিয়া হাত বাড়াইয়া বিছানা দেখাইয়া বলিল, কেউ পালায় নি মা, সব ঐ নেপের মধ্যে ঢুকেচে।

তাহার কথা ও মুখচোখের চেহারা দেখিয়া শৈলজা হাসিয়া উঠিল। দূর হইতে সে ইহার গলাটাই বেশী শুনিতে পাইয়াছিল। এবার বড়জাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, দিদি, খেয়ে ফেললে যে তোমাকে! হাত তোমার না ওঠে, একবার ধমকাতেও কি পার না? ওরে, ওই সব ছেলেরা—বেরো—চল্‌ আমার সঙ্গে।

সিদ্ধেশ্বরী কিছুক্ষণ চুপ করিয়াই ছিলেন, এখন মৃদুকণ্ঠে ঈষৎ বিরক্তভাবে বলিলেন, ওরা নিজের মনে খেলা কচ্চে, আমাকে বা খেয়ে ফেলবে কেন, আর তোর সঙ্গেই বা যাবে কেন? না না, আমার সামনে কাউকে তোর মারধর কত্তে হবে না। যা, তুই এখান থেকে—লেপের ভেতর ছেলেরা হাঁপিয়ে উঠচে।

শৈলজা একটুখানি হাসিয়া বলিল, আমি কি শুধুই মারধর করি দিদি?

বড্ড করিস শৈল। ছোট বোনের মত তিনি নাম ধরিয়া ডাকিতেন। বলিলেন, তোকে দেখলে ওদের মুখ যেন কালিবর্ণ হয়ে যায়—আচ্ছা যা না বাপু তুই সুমুখ থেকে—ওরা বেরুক।

আমি ওদের নিয়ে যাব। অমন করে দিবারাত্রি জ্বালাতন করলে তোমার অসুখ সারবে না। পটল সবচেয়ে শান্ত, সে শুধু তার বড়মার কাছে শুতে পাবে, আর সবাইকে আজ থেকে আমার কাছে শুতে হবে, বলিয়া শৈলজা জজ-সাহেবের মত রায় দিয়া বড়জায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, তুমি এখন ওঠো—দুধ খাও—হাঁ রে হরি, সাড়ে-ছ’টার সময় তোর মাকে ওষুধ দিয়াছিলি ত?

প্রশ্ন শুনিয়া হরিচরণের মুখ পাণ্ডুর হইয়া গেল। সে সন্তানদিগের সঙ্গে এতক্ষণ বনেজঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, দেশ উদ্ধার করিতেছিল, তুচ্ছ ঔষধ-পথ্যের কথা তাহার মনেও ছিল না। তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না।

কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী রুষ্টস্বরে বলিয়া উঠিলেন, ওষুধ-টুষুধ আর আমি খেতে পারব না শৈল।

তোমাকে বলিনি দিদি, তুমি চুপ কর, বলিয়া হরিচরণের বিছানার অত্যন্ত সন্নিকটে সরিয়া আসিয়া বলিল, তোকে জিজ্ঞেস কচ্চি, ওষুধ দিয়েছিলি?

তিনি ঘরে ঢুকিবার পূর্বেই হরিচরণ জড়সড় হইয়া উঠিয়া বসিয়াছিল, ভীতকণ্ঠে বলিল, মা খেতে চান না যে!

শৈলজা ধমক দিয়া উঠিল, ফের কথা কাটে! তুই দিয়েছিলি কি না, তাই বল?

খুড়ীর কঠোর শাসন হইতে ছেলেকে উদ্ধার করিবার জন্য সিদ্ধেশ্বরী উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, কেন তুই এত রাত্তিরে হাঙ্গামা কত্তে এলি বল ত শৈল? ওরে ও হরিচরণ, দিয়ে যা না শিগ্‌গির কি ওষুধ-টষুধ আমাকে দিবি!

হরিচরণ একটু সাহস পাইয়া ব্যস্তভাবে শয্যার অপর প্রান্তে নামিয়া পড়িল এবং দেরাজের উপর হইতে একটা শিশি ও ছোট গেলাস হাতে করিয়া জননীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ছিপি খুলিবার উদ্যোগ করিতেই শৈলজা সেইখান হইতে বলিল, গেলাসে ওষুধ ঢেলে দিলেই হলো, না রে হরি? জল চাইনে, মুখে দেবার কিছু চাইনে, না? এ ব্যাগারঠ্যালা কাজ তোমাদের আমি বা’র কচ্চি।

ঔষধের শিশিটা হাতে করিতে পাইয়া হরিচরণের হঠাৎ ভরসা হইয়াছিল। বোধ করি ফাঁড়াটা আজিকার মত কাটিয়া গেল। কিন্তু এই ‘মুখে দিবার কিছু’র প্রশ্নে তাহা উবিয়া গেল। সে নিরুপায়ের মত এদিকে ওদিকে চাহিয়া করুণকণ্ঠে বলিল, কোথাও কিছু নেই যে খুড়ীমা!

না আনলে কোথাও কিছু কি উড়ে আসবে রে?

সিদ্ধেশ্বরী রাগ করিয়া বলিলেন, ও কোথায় কি পাবে যে দেবে? এসব কি পুরুষমানুষের কাজ? শৈলর যত শাসন এই ছেলেদের ওপরে। নীলিকে বলে যেতে পারিস নি? সে মুখপোড়া মেয়ে তুই আসা পর্যন্ত এ ঘর একবার মাড়ায় না—একবার চেয়ে দেখে না, মা মরচে কি বেঁচে আছে।

সে কি ছিল দিদি, সে আমার সঙ্গে পটলডাঙায় গিয়েছিল যে।

0 Shares