পথের দাবী

ভারতী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, জল দেবেন।

অপূর্ব কহিল, আর যদি পাশ ফিরে শুতে চায়?

ভারতী বলিল, পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দেবেন।

বলা ত সহজ। আমি শোব কোথায় শুনি? তাহার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ চাপা রহিল না, কহিল, বিছানা ত রইল পড়ে ওপরের ঘরে!

ভারতী কি মনে করিল তাহার মুখ দেখিয়া বুঝা গেল না। একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া তেমনি শান্ত-মৃদুকণ্ঠে কহিল, আর একটা বিছানা ত আপনার খাটের উপরে আছে, তাতে ত অনায়াসে শুতে পারবেন।

অপূর্ব কহিল, আপনি ত বলবেনই ও-কথা। আর আমার খাবার বন্দোবস্ত কি-রকম হবে?

ভারতী চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু এই অসঙ্গত ও অত্যন্ত খাপছাড়া প্রশ্নে গোপন হাসির আবেগে তাহার চোখের পাতা-দুটি যেন কাঁপিতে লাগিল। খানিক পরে পরম গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, আপনার শোওয়া এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করার ভার কি আমার উপরে আছে?

তাই কি আমি বলচি?

এইমাত্র ত বললেন। এবং ভাল করে নয়, রাগ করে।

অপূর্ব ইহার আর উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। তাহার মলিন বিপন্ন-মুখের প্রতি চাহিয়া ভারতী ধীরে ধীরে কহিল, আপনার বলা উচিত ছিল, দয়া করে আমার এই-সব বিলি-ব্যবস্থা আপনি করে দিন।

অপূর্ব কোন দিকে না চাহিয়া কহিল, তা বলা আর শক্ত কি?

ভারতী কহিল, বেশ ত, তাই বলুন না!

তাই ত বলচি, বলিয়া অপূর্ব মুখ ভারী করিয়া আর একদিকে চোখ ফিরাইয়া রহিল।

ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কখনো কি কারও রোগে সেবা করেন নি?

না।

আর কখনো বিদেশেও আসেন নি?

না। মা আমাকে কোথাও যেতে দেন না।

তবে, এবারে যে বড় আপনাকে ছেড়ে দিলেন?

অপূর্ব চুপ করিয়া রহিল। কেমন করিয়া এবং কি কারণে যে তাহার বিদেশে আসায় মা সম্মত হইয়াছিলেন এ কথা সে পরের কাছে বলিতে চাহিল না। ভারতী কহিল, এতবড় চাকরি,—না ছেড়ে দিলেই বা চলবে কেন? কিন্তু তিনি সঙ্গে এলেন না কেন?

তাহার এই প্রকার তীক্ষ্ণ মন্তব্য প্রকাশে অপূর্ব ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আমার মাকে আপনি দেখেন নি, নইলে এ কথা বলতে পারতেন না। অনেক দুঃখেই আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু বিধবা মানুষ, এই ম্লেচ্ছদেশে তিনি নিজে আসবেন কেমন করে?

ভারতী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, ম্লেচ্ছদের প্রতি আপনাদের ভয়ানক ঘৃণা। কিন্তু রোগ ত শুধু গরীবের জন্য সৃষ্টি হয়নি, আপনারও হতে পারতো। এখনো ত হতে পারে,—মা কি তাহলে আসেন না?

অপূর্বর মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল, কহিল, এমন করে ভয় দেখালে আমি কি করে একলা থাকবো?

ভারতী কহিল, ভয় না দেখালেও আপনি একলা থাকতে পারবেন না। আপনি অত্যন্ত ভীতু মানুষ।

অপূর্ব প্রতিবাদ করিতে সাহস পাইল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

ভারতী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেসা করি আমি। আমার হাতে জল খেয়ে তেওয়ারীর ত জাত গেছে, ভাল হয়ে সে কি করবে?

অপূর্ব ইহার শাস্ত্রোক্ত বিধি জানিত না, একটু চিন্তা করিয়া কহিল, সে ত আর সজ্ঞানে খায়নি, মরণাপন্ন ব্যারামে খেয়েচে, না খেলে হয়ত মরে যেত। এতে বোধ হয় জাত যায় না, একটা প্রায়শ্চিত্ত করলেই হতে পারে।

ভারতী ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, হুঁ। তার খরচ বোধ হয় আপনাকেই দিতে হবে,—নইলে, আপনি বা তার হাতে খাবেন কি করে?

অপূর্ব তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিল, আমিই দেব বৈ কি, নিশ্চয় দেব। ভগবান করুন সে শীঘ্র ভাল হয়ে উঠুক!

ভারতী বলিল, আর আমিই শুশ্রূষা করে তাকে ভাল করে তুলি, না?

তাহার শান্ত কঠিন কণ্ঠস্বর অপূর্ব লক্ষ্যই করিল না, কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হইয়া উত্তর দিল, সে আপনার দয়া। তেওয়ারী বাঁচুক, কিন্তু আপনিই ত তার প্রাণ দিলেন।

ভারতী একটুখানি হাসিল। কহিল, ম্লেচ্ছতে প্রাণ দিলে দোষ নেই, মুখে জল দিলেই তার প্রায়শ্চিত্ত চাই, না? এই বলিয়া সে পুনরায় একটু হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, এখন আমি চললাম। কাল যদি সময় পাই ত একবার দেখে যাবো। এই কথা বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইয়া হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আর যদি আসতে না পারি ত তেওয়ারী ভাল হলে তাকে বলবেন, আপনি না এসে পড়লে আমি যেতাম না, কিন্তু ম্লেচ্ছদেরও একটা সমাজ আছে, আপনার সঙ্গে একঘরে রাত্রি কাটালে তারাও ভাল বলে না। কাল সকালে আপনার পিয়ন এলে তলওয়ারকরবাবুকে খবর দেবেন। তিনি পাকা লোক, সমস্ত ব্যবস্থাই করে দিতে পারবেন। আচ্ছা, নমস্কার।

অপূর্ব কহিল, পাশ ফিরিয়ে দিলে ওর লাগবে না?

ভারতী বলিল, না।

রাত্রে যদি বিছানা বদলে দেবার দরকার হয়? কি করে দেব?

ভারতী কহিল, সাবধানে দেবেন। আমি মেয়েমানুষ হয়ে যদি পেরে থাকি আপনি পারবেন না?

অপূর্ব শঙ্কিতমুখে স্থির হইয়া রহিল। ভারতী যাইবার জন্য দ্বার খুলিতেই অপূর্ব সভয়ে বলিয়া উঠিল, আর যদি হঠাৎ বসে? যদি কাঁদে?

ভারতী এ-সকল প্রশ্নের আর কোন জবাব দিবার চেষ্টা না করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া সাবধানে দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া চলিয়া গেল। তাহার মৃদু পদশব্দ কাঠের সিঁড়ির উপরে যতক্ষণ শুনা গেল ততক্ষণ পর্যন্ত অপূর্ব কাঠের মূর্তির মত বসিয়া রহিল, কিন্তু শব্দ থামিবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাহার চোখের উপরে কোথা হইতে একটা কালো জাল নামিয়া আসিয়া সমস্ত দেহ কি করিয়া যে উঠিল সে জীবনে কখনো অনুভব করে নাই। ভয়ে ছুটিয়া গিয়া বারান্দার কবাট খুলিয়া ফেলিয়া নীচে চাহিয়া দেখিল ভারতী দ্রুতপদে রাস্তায় চলিয়াছে। মিস্‌ জোসেফ নামটা সে মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতেই পারিল না, উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল, ভারতী!

ভারতী মাথা তুলিয়া চাহিতে অপূর্ব দুই হাত জোড় করিয়া কহিল, একবার আসুন—মুখ দিয়া আর তাহার কথা বাহির হইল না। ভারতী দ্বিরুক্তি না করিয়া ফিরিল। মিনিট-দুই পরে দ্বার খুলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল অপূর্ব নাই, তেওয়ারী একাকী পড়িয়া আছে।

আগাইয়া আসিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল বারান্দায় সে নাই—কোথাও নাই। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, স্নানের ঘরের কবাট খোলা। কিন্তু মিনিট পাঁচ-ছয় অপেক্ষা করিয়াও যখন কেহ আসিল না, তখন সে সন্দিগ্ধচিত্তে দরজার ভিতরে গলা বাড়াইয়া যাহা দেখিতে পাইল তাহাতে ভয়ের আর সীমা রহিল না। অপূর্ব মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া, দুপুরবেলা যাহা কিছু খাইয়াছিল সমস্ত বমি করিয়াছে, তাহার চোখ মুদিত এবং সর্বাঙ্গ ঘামে ভাসিয়া যাইতেছে। কাছে গিয়া ডাকিল, অপূর্ববাবু!

প্রথম ডাকেই অপূর্ব চোখ মেলিয়া চাহিল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার চোখ বুজিয়া তেমনি স্থির হইয়া রহিল। ভারতী মুহূর্তকালমাত্র দ্বিধা করিল, তাহার পরেই সে অপূর্বর কাছে বসিয়া মাথায় হাত দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, উঠে বসতে হবে যে। মাথায় মুখে জল না দিলে ত শরীর শোধরাবে না অপূর্ববাবু!

অপূর্ব উঠিয়া বসিলে সে হাত ধরিয়া তাহাকে কলের কাছে আনিয়া জল খুলিয়া দিলে সে হাত-মুখ ধুইয়া ফেলিল। তখন ধীরে ধীরে তাহাকে তুলিয়া আনিয়া খাটের উপরে শোয়াইয়া দিয়া ভারতী গামছার অভাবে নিজের আঁচল দিয়া তাহার হাত ও পায়ের জল মুছাইয়া দিল এবং একটা হাতপাখা খুঁজিয়া আনিয়া বাতাস করিতে করিতে কহিল, এইবার একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আপনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি যাবো না।

অপূর্ব লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে কহিল, কিন্তু আপনার যে এখনো খাওয়া হয়নি।

0 Shares