পথের দাবী

ভারতী প্রসন্ন মৌনমুখে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল, অপূর্ব ফলের খোসা ছাড়ানো বন্ধ রাখিয়া বলিতে লাগিল, ধরলে, সমস্ত জীবনই মা আমার দুঃখ পেয়ে আসছেন, এবং সমস্ত জীবনই স্বামী-পুত্রদের ম্লেচ্ছাচার বাড়ির মধ্যে নিঃশব্দে সহ্য করে আসছেন। তাঁর একটি মাত্র ভরসা আমি। অসুখে-বিসুখে কেবল আমার হাতেই দুটো হবিষ্য সিদ্ধ তিনি মুখে দেন।

ভারতী কহিল, এখন ত তাঁর কষ্ট হতে পারে।

অপূর্ব বলিল, পারেই ত। হয়ত হচ্চেও। তাইত আমাকে তিনি প্রথমে ছেড়ে দিতে চাননি। কিন্তু, আমিও ত চিরকাল ঘরে বসে থাকতে পারিনে! কেবল তাঁর একটি আশা আমার বউ এলে আর তাঁকে রেঁধে খেতে হবে না।

ভারতী একটুখানি হাসিয়া কহিল, তাঁর সেই আশাটি কেন পূর্ণ করেই এলেন না? সেই ত উচিত ছিল!

অপূর্ব তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিয়া উঠিল—ছিলই ত। মেয়ে নিজে পছন্দ করে মা যখন সমস্ত ঠিক করছিলেন তখনি আমাকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হল, সময় হল না। কিন্তু বলে এলাম, মা, যখনি চিঠি লিখবে তখনি ফিরে এসে তোমার আদেশ পালন করব।

ভারতী বলিল, তাই ত উচিত।

অপূর্ব মাতৃস্নেহে বিগলিত হইয়া কহিল, উচিত নয়? বারব্রত করবে, বিচার-আচার জানবে, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের ঘরের মেয়ে হবে,—মাকে কখনো দুঃখ দেবে না,—সেই ত আমি চাই। কাজ কি আমার গান-বাজনা-জানা কলেজে-পড়া বিদুষী মেয়ে?

ভারতী বলিল, দরকার কি!

অপূর্ব নিজেই যে একদিন ইহার বিরোধী ছিল এবং বৌদিদির স্বপক্ষে লড়াই করিয়া মাকে রাগ করিয়া বলিয়াছিল—ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের ঘর হইতে যা হউক একটা মেয়ে ধরিয়া আনিয়া ল্যাঠা চুকাইয়া দিতে, সে-কথা আজ সে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইল। বলিতে লাগিল, দেখুন আপনি আমাদের জাতও নয়, সমাজেরও নয়, জলটুকু পর্যন্ত নেওয়া যায় না, ছোঁয়াছুঁয়ি হলে কাপড়খানি অবধি ছেড়ে ফেলতে হয় এত তফাত, তবু আপনি যা বোঝেন আমার দাদারা কিংবা বৌদিদিরা তা বুঝতে চান না।

যার যা ধর্ম তাই ত তার মেনে চলা চাই? একবাড়ি লোকের মধ্যে থেকেও যে মা আমার একলা, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য কি আর আছে? তাই ভগবানের কাছে আমি শুধু এই প্রার্থনা করি, আমার কোন আচরণে আমার মা যেন না কোনদিন ব্যথা পান। বলিতে বলিতে তাহার গলা ভারী হইয়া অশ্রুভারে দুই চক্ষু টলটল করিতে লাগিল।

এই সময়ে ঘুমন্ত তেওয়ারী কি একটা শব্দ করিতে ভারতী তাড়াতাড়ি উঠিয়া চলিয়া গেল। অপূর্ব হাতের উলটা পিঠে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া পুনরায় ফল বানাইতে প্রবৃত্ত হইল। মাকে সে অতিশয় ভালবাসিত, এবং বাড়িতে থাকিতে সেই মাকে খুশী রাখিতে সে মাথার টিকি হইতে একাদশীর দিনে ভাতের বদলে লুচি খাওয়া অবধি সবই পালন করিয়া চলিত। বস্তুতঃ, ব্রাহ্মণ সন্তানের আচারভ্রষ্টতাকে সে নিন্দাই করিত, কিন্তু প্রবাসে আসিয়া আচার-বিচারের প্রতি তাহার এরূপ প্রগাঢ় অনুরাগ বোধ হয় তাহার জননীও সন্দেহ করিতে পারিতেন না। আসল কথা এই যে, আজ তাহার দেহমন ভয়ে ও ভাবনায় নিরতিশয় বিকল হইয়াছিল, মাকে কাছে পাইবার একটা অন্ধ আকুলতায় ভিতরে ভিতরে তাহার কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি করিতেছিল, সেখানে সমস্ত ভাবই যে পরিমাণ হারাইয়া বিকৃত আতিশয্যে রূপান্তরিত হইয়া উঠিতেছিল এ খবর অন্তর্যামীর অগোচর রহিল না, কিন্তু ভারতীর বুকের মধ্যেটা অপমানের বেদনায় একেবারে টনটন করিতে লাগিল।

সে খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, অপূর্ব কোনমতে ফল-কাটা শেষ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কহিল, বসে আছেন, খাননি?

অপূর্ব বলিল, না, আপনার জন্য বসে আছি।

কিসের জন্য?

আপনি খাবেন না?

না। দরকার হলে আমার আলাদা আছে।

অপূর্ব ফলের থালাটা হাত দিয়া একটুখানি ঠেলিয়া দিয়া বলিল, বাঃ—তা কি কখন হয়? আপনি সারাদিন খাননি, আর—

তাহার কথাটা তখনও শেষ হয় নাই, একটা অত্যন্ত শুষ্ক চাপা কণ্ঠস্বরে জবাব আসিল, আঃ—আপনি ভারী জ্বালাতন করেন। ক্ষিদে থাকে খান, না হয় জানালা দিয়ে ফেলে দিন। এই বলিয়া সে মুহূর্ত অপেক্ষা না করিয়া ও-ঘরে চলিয়া গেল। বস্তুতঃ, মুহূর্তমাত্রই তাহার মুখের চেহারা অপূর্ব দেখিতে পাইয়াছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তকালই তাহার বুকে মরণকাল পর্যন্ত ছাপ মারিয়া দিল। এ মুখ সে আর ভুলিল না। সেই আসার দিন হইতে অনেকবার দেখা হইয়াছে; বিবাদে, সৌহৃদ্যে, শত্রুতায়, বন্ধুত্বে, সম্পদে ও বিপদে কতবারই ত এই মেয়েটিকে সে দেখিয়াছে, কিন্তু, সে-দেখার সহিত এ-দেখার সাদৃশ্য নাই। এ যেন আর কেহ।

ভারতী চলিয়া গেল, ফলের পাত্র তেমনি পড়িয়া রহিল এবং তেমনি নির্বাক নিস্পন্দ কাঠের মত অপূর্ব বসিয়া রহিল। কিসে যে কি হইল সে যেন তাহার উপলব্ধির অতীত।

ঘণ্টা-খানেক পরে সে এ ঘরে আসিয়া দেখিল তেওয়ারীর শিয়রের কাছে একটা মাদুর পাতিয়া ভারতী বাহুতে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে। সে যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল তেমনি নিঃশব্দে ফিরিয়া গিয়া তাহার খাটে শুইয়া পড়িল, এবং শ্রান্ত চক্ষু ঘুমে মুদিত হইতে তিলার্ধ বিলম্ব হইল না। এই ঘুম যখন ভাঙ্গিল তখন ভোর হইয়াছে।

ভারতী কহিল, আমি চললুম।

অপূর্ব ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল, কিন্তু ভাল করিয়া চেতনা হইবার পূর্বেই দেখিল, সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেছে।

পরিচ্ছেদ – দশ

শেষোক্ত ঘটনার পরে মাসাধিক কাল অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। তেওয়ারী আরোগ্য লাভ করিয়াছে, কিন্তু গায়ে এখনও জোর পায় নাই। যে লোকটি সঙ্গে ভামোয় গিয়াছিল সেই রাঁধিতেছে। তেওয়ারীকে বাঁচাইবার জন্য প্রায় আফিসসুদ্ধ সকলেই অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করিয়াছে, রামদাস নিজে কতদিন ত বাসায় পর্যন্ত যাইতে পারে নাই। শহরের একজন বড় ডাক্তার চিকিৎসা করিয়াছেন, তাঁহারই সুপারিশে তাহাকে বসন্ত-হাসপাতালে লইয়া যায় নাই। এই ব্রহ্মদেশটা তেওয়ারীর কোনদিনই ভাল লাগে নাই, অপূর্ব তাহাকে ছুটি দিয়াছে, স্থির হইয়াছে আর একটু সারিলেই সে বাড়ি চলিয়া যাইবে। আগামী সপ্তাহে বোধ হয় তাহা অসম্ভব হইবে না, তেওয়ারী নিজে এইরূপ আশা করে। ভারতী সেই যে গিয়াছে, কোনদিন খবর লইতেও আসে নাই। অথচ, এত বড় একটা আশ্চর্য ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে তাহার উল্লেখ পর্যন্ত হইত না। ইহাতে তেওয়ারীর বিশেষ অপরাধ ছিল না; বরঞ্চ সে যেন ভয়ে ভয়েই থাকিত পাছে কেহ তাহার নাম করিয়া ফেলে। ভারতী শত্রুপক্ষীয়া, এখানে আসা অবধি তাহাদের অশেষ প্রকারে দুঃখ দিয়াছে, মিথ্যা সাক্ষ্যের জোরে অপূর্বকে জেল খাটাইবার চেষ্টা পর্যন্ত করিয়াছে; মনিবের অবর্তমানে তাহাকেই ঘরে ডাকিয়া আনার কথায় সে লজ্জা ও সঙ্কোচ দুই অনুভব করিত। কিন্তু সে কবে এবং কি ভাবে চলিয়া গেছে তেওয়ারী জানে না। জানিবার জন্য ছটফট করিত,—তাহার উদ্বেগ ও আশঙ্কার অবধি ছিল না, কিন্তু কি করিয়া যে জানা যায় কিছুতেই খুঁজিয়া পাইত না। কখনো ভাবিত ভারতী চালাক মেয়ে, অপূর্বর আসার সংবাদ পাইয়া সে নিজেই লুকাইয়া পলাইয়াছে; কখনো ভাবিত অপূর্ব আসিয়া পড়িয়া হয়ত তাহাকে অপমান করিয়া দূর করিয়া দিয়াছে। কিন্তু এই দূয়ের যাহাই কেন না ঘটিয়া থাক, ভারতী আপনি ইচ্ছা করিয়া যে এ বাটীতে আর তাহাকে দেখিতে আসিবে না সে বিষয়ে তেওয়ারী নিশ্চিন্ত ছিল। অপূর্ব নিজে কিছুই বলে না, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে তেওয়ারীর এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশী করিত পাছে তাহারই জিজ্ঞাসাবাদের দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত হইয়া পড়ে। ঝগড়া-বিবাদের কথা চুলায় যাক, সে যে তাহার হাতে জল খাইয়াছে, তাহার রাঁধা সাগু বার্লি খাইয়াছে,—হয়ত এমন ভয়ানক জাত গিয়াছে যে তাহার প্রায়শ্চিত্ত পর্যন্ত নাই। তেওয়ারী স্থির করিয়া রাখিয়াছিল কোনমতে এখান হইতে কলিকাতায় গিয়া সে সোজা বাড়ি চলিয়া যাইবে। সেখানে গঙ্গাস্নান করিয়া, গোপনে গোবর প্রভৃতি খাইয়া, কোন একটা ছল-ছুতায় ব্রাহ্মণাদি ভোজন করাইয়া দেহটাকে কাজচলাগোছের শুদ্ধ করিয়া লইবে। কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া কথাটাকে একবার মায়ের কানে তুলিয়া দিলে যে কিসে কি দাঁড়াইবে তাহার কিছুই বলা যায় না। হালদার বাড়ির চাকরি ত ঘুচিবেই, এমন কি তাহাদের গ্রামের সমাজ পর্যন্ত গিয়া টান ধরাও বিচিত্র নয়।

0 Shares