পথের দাবী

সে কহিল, তা আর জানিনে! এই রাস্তায় সোজা গাঙের ধারে গিয়ে জিজ্ঞেসা করবেন নতুন ইস্কুল-ঘর কোথায়,—কচি ছেলেটা পর্যন্ত দেখিয়ে দেবে। ডাক্তারবাবু থাকেন কিনা! মানুষ ত নয়,— দেব্‌তা! মরা বাঁচাতে পারেন!—এই বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল। সেই পথে সোজা আসিয়া অপূর্ব লাল রঙের একখানি কাঠের বাড়ি দেখিতে পাইল।

বাড়িটি দ্বিতল, একেবারে নদীর উপরে। তখন রাত্রি হইয়াছে, পথে লোক নাই—উপরের খোলা জানালা হইতে আলো আসিতেছে,—কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিবার জন্য সে সেইখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার সন্দেহ রহিল না যে এইখানেই ভারতী থাকে, এবং ওই জানালাতেই তাহার দেখা মিলিবে।

মিনিট-পনেরো পরে জন দুই-তিন লোক বাহির হইয়া তাহাকে দেখিয়া সহসা যেন চকিত হইয়া উঠিল। একজন প্রশ্ন করিল, কে? কাকে চান?

তাহার সন্দিগ্ধ কণ্ঠস্বরে অপূর্ব সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, মিস জোসেফ বলে কোন স্ত্রীলোক থাকেন এখানে?

সে তৎক্ষণাৎ বলিল, থাকেন বৈ কি—আসুন।

অপূর্বর ঠিক যাইবার সঙ্কল্প ছিল না, কিন্তু দ্বিধা করিতেই লোকটি কহিল, আপনি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন? কিন্তু তিনি ত ঘরেই আছেন,—আসুন। আমরা আপনাকে নিয়ে যাচ্চি, এই বলিয়া সে অগ্রসর হইল।

তাহার ত্বরা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা গেল ইহারা তাহাকে যাচাই করিয়া লইতে চায়। অতএব দ্বার হইতে এখন না বলিয়া ফিরিতে চাহিলে সন্দেহ ইহাদের এমনিই বিশ্রী হইয়া উঠিবে যে সে তাহা ভাবিতেই পারিল না। তাই চলুন বলিয়া সে লোকটির অনুসরণ করিয়া একমুহূর্ত পরেই এই কাঠের বাড়ির নীচেকার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহারই এক পাশ দিয়া উপরে উঠিবার সিঁড়ি। ঘরটি হলের মত প্রশস্ত। ছাদ হইতে ঝুলানো একটা মস্ত আলো, গোটা-কয়েক টেবিল চেয়ার, একটা কালো বোর্ড এবং সমস্ত দেয়াল জুড়িয়া নানা আকারের ও নানা রঙের ম্যাপ টাঙানো। ইহাই যে নূতন ইস্কুল-ঘর অপূর্ব তাহা দেখিয়াই চিনিল। তথায় চার-পাঁচজন স্ত্রীলোক ও পুরুষে মিলিয়া বোধ হয় একটা তর্কই করিতেছিল, সহসা একজন অপরিচিত লোককে প্রবেশ করিতে দেখিয়া চুপ করিল। অপূর্ব একবার মাত্র তাহাদের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া যে তাহাকে আনিয়াছিল তাহারই পিছনে পিছনে উপরে উঠিয়া গেল। ভারতী ঘরেই ছিল, অপূর্বকে দেখিয়া তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কাছে আসিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া চেয়ারে বসাইয়া কহিল, এতদিন আমার খোঁজ নেননি যে বড়?

অপূর্ব বলিল, আপনিও ত আমাদের খোঁজ নেননি! কিন্তু কথাটা যে জবাব হিসাবে ঠিক হইল না তাহা সে বলিয়াই বুঝিল। ভারতী শুধু একটু হাসিল, কহিল, তেওয়ারী বাড়ি যেতে চাচ্চে, যাক। না গেলে সে সারবে না।

অপূর্ব কহিল, অর্থাৎ আপনি যে আমাদের খবর নেন না এ অভিযোগ সত্য নয়।

ভারতী পুনশ্চ একটু হাসিয়া কহিল, কাল রবিবার, কাল কিছু আর হবে না, কিন্তু পরশু বারোটার মধ্যেই কোর্টে গিয়ে টাকা আর জিনিসগুলো আপনার ফিরিয়ে আনবেন। একটু দেখে শুনে নেবেন যেন ঠকায় না।

আপনার কিন্তু একটা সই চাই।

তা জানি।

অপূর্ব প্রশ্ন করিল, আপনার সঙ্গে তেওয়ারীর বোধ হয় দেখা হয়, না?

ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। কিন্তু আপনি যেন গিয়ে তার ওপর মিছে রাগ করবেন না।

অপূর্ব কহিল, মিছে না হোক, সত্যি রাগ করা উচিত। আপনি তার প্রাণ দিয়েছেন এটুকু কৃতজ্ঞতা তার থাকা উচিত ছিল।

ভারতী বলিল, নিশ্চয়ই আছে। নইলে, সে ত আমাকে জেলে পাঠাবার একবার অন্ততঃ চেষ্টা করেও দেখতো।

অপূর্ব এ ইঙ্গিত বুঝিল। আনতমুখে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে বলিল, আপনি আমার উপর ভয়ানক রাগ করে আছেন।

ভারতী বলিল, কখখনো না। সারাদিন ইস্কুলে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে, ঘরে ফিরে আবার সমিতির সেক্রেটারির কাজে অসংখ্য চিঠিপত্র লিখে, বিছানায় শুতে-না শুতেই ত ঘুমিয়ে পড়ি,—রাগ করবার সময় কোথায় আমার?

অপূর্ব কহিল, ওঃ—রাগ করবারও সময়টুকু নেই!

ভারতী বলিল, কৈ আর আছে? আপনি বরঞ্চ কোন দিন সকাল থেকে এসে দেখবেন সত্যি না মিছে!

অপূর্বর মুখ দিয়া অলক্ষিতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কহিল, দেখবার আমার দরকার কি! একটুখানি থামিয়া কহিল, ইস্কুলে আপনাকে কত মাইনে দেয়?

ভারতী হাসি চাপিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, বেশ ত আপনি! মাইনের কথা বুঝি কাউকে জিজ্ঞাসা করতে আছে? এতে তার অপমান হয় না?

অপূর্ব ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিল, অপমান করবার জন্যে ত আর বলিনি। চাকরিই যখন করছেন—

ভারতী কহিল, না করে কি শুকিয়ে মরতে বলেন?

অপূর্ব বলিল, এ যা চাকরি, এই ত শুকিয়ে মরা! তার চেয়ে বরঞ্চ আমাদের আফিসে একটা চাকরি আছে, মাইনে একশ’ টাকা,—হয়ত দু-এক ঘণ্টার বেশী খাটতেও হবে না।

ভারতী প্রশ্ন করিল, আমাকে সেই চাকরি করতে বলেন?

অপূর্ব কহিল, দোষই বা কি?

ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, আমি করব না। আপনি ত তার কর্তা, কাজে ভুলচুক হলেই লাঠি হাতে দরজায় এসে দাঁড়াবেন।

অপূর্ব জবাব দিল না। সে মনে মনে বুঝিল ভারতী শুধু পরিহাস করিয়াছে, তথাপি তাহার সেই একটা দিনের আচরণের ইঙ্গিত করায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল। কিছুক্ষণ হইতেই একটা তর্ক-বিতর্কের কলরোল নীচে হইতে শুনা যাইতেছিল, সহসা তাহা উদ্দাম হইয়া উঠিল। অপূর্ব ভাল মানুষটির মত জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের ইস্কুল বসলো বোধ হয়—ছেলেরা সব পড়ায় মন দিয়েছে।

ভারতী গম্ভীরমুখে কহিল, তাহলে হাঁকাহাঁকিটা কিছু কম হতো। তাদের শিক্ষকেরা বোধ করি বিষয় নির্বাচনে মন দিয়েছেন।

আপনি যাবেন না?

যাওয়া ত উচিত, কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যেতে যে মন সরে না। এই বলিয়া সে মুখ টিপিয়া হাসিল। কিন্তু অপূর্বর কান পর্যন্ত রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে আর একদিকে চোখ ফিরাইয়া পাশের দেয়ালের গায়ে সাজানো কাঁচা ঝাউপাতা দিয়া লেখা কয়েকটা অক্ষরের প্রতি সহসা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিয়া উঠিল, ওটা কি লেখা ওখানে?

ভারতী কহিল, পড়ুন না।

অপূর্ব ক্ষণকাল মনঃসংযোগ করিয়া বলিল, পথের-দাবী। তার মানে?

ভারতী কহিল, ওই আমাদের সমিতির নাম, ওই আমাদের মন্ত্র, ওই আমাদের সাধনা! আপনি আমাদের সভ্য হবেন?

অপূর্ব বলিল, আপনি নিজে একজন সভ্য নিশ্চয়ই, কিন্তু কি আমাদের করতে হবে?

ভারতী বলিল, আমরা সবাই পথিক। মানুষের মনুষ্যত্বের পথে চলবার সর্বপ্রকার দাবী অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙ্গেচুরে চলবো। আমাদের পরে যারা আসবে তারা যেন নিরুপদ্রবে হাঁটতে পারে, তাদের অবাধ মুক্ত গতিকে কেউ যেন না রোধ করতে পারে, এই আমাদের পণ। আসবেন আমাদের দলে?

অপূর্ব কহিল, আমরা পরাধীন জাতি, ইংরেজ নই, ফরাসী নই, আমেরিকান নই,—কোথায় পাবো আমরা অপ্রতিহত গতি? স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসবার আমাদের অধিকার নেই, অপমানিত হয়ে নালিশ করবার পথ নেই,—বলিতে বলিতে সেদিনের সমস্ত লাঞ্ছনা,— ফিরিঙ্গী ছোঁড়াদের বুটের আঘাত হইতে স্টেশন মাস্টারের বাহির করিয়া দেওয়া অবধি সকল অপমান স্পষ্ট অনুভব করিয়া তাহার দুই চক্ষু প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, আমরা বসলে বেঞ্চ অপবিত্র হয়, আমরা গেলে ঘরের হাওয়া কলুষিত হয়,—আমরা যেন মানুষ নই! আমাদের যেন মানুষের প্রাণ, মানুষের রক্ত-মাংস গায়ে নেই! এই যদি আপনাদের সাধনা হয়, আছি আমি আপনাদের দলে।

0 Shares