পথের দাবী

আর ওই যে লোকটি টিকিটের পরিবর্তে একদিন অনায়াসে মদ কিনিয়া খাইয়া তাহারই চোখের সম্মুখে ধরা পড়িয়াছিল,—আর সকলের বড় এই নবতারা!—স্বামী ত্যাগ করিয়া দেশের কাজ করিতে আসিয়াছে,—সতীত্ব-রক্ষার কথা ভাবিবার এখন যাহার সময় নাই,—অথচ এই লোকগুলা এত বড় অন্যায়কে শুধু সমর্থন নয়, প্রাণপণে প্রশয় দিতেছে। এবং যিনি ইহাদের কর্ত্রী, স্ত্রীলোক হইয়াও তিনি প্রকাশ্য সভায় এতগুলি পুরুষের সমক্ষে সতীধর্মের প্রতি তাঁহার একান্ত অবজ্ঞা অসঙ্কোচে প্রকাশ করিতে লজ্জাবোধটুকুও করিলেন না।

কিছুক্ষণ অবধি সমস্ত ঘরটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল; বাহিরে অন্ধকার, অপ্রশস্ত রাজপথ তেমনি জনহীন নীরব, কেমন যেন একপ্রকার উদ্বিগ্ন আশঙ্কায় অপূর্বর মনের ভিতরটা ভার হইয়া উঠিল।

হঠাৎ সুমিত্রার কণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া উঠিল, অপূর্ববাবু!

অপূর্ব চকিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল।

সুমিত্রা কহিলেন, আপনি আমাদের চেনেন না, কিন্তু ভারতীর কাছ থেকে আমরা সবাই আপনাকে চিনি। শুনলাম আপনি আমাদের সমিতির মেম্বর হতে চান। সত্য?

অপূর্ব না বলিতে পারিল না, ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। যে লোকটি এক মনে লিখিতেছিল, সুমিত্রা তাহাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ডাক্তার, অপূর্ববাবুর নামটা লিখে নেবেন। অপূর্বকে হাসিয়া বলিলেন, আমাদের কোন রকম চাঁদা নেই,—টাকাকড়ি দিতে হয় না এইটে আমাদের সমিতির বিশেষত্ব।

প্রত্যুত্তরে অপূর্ব নিজেও একটু হাসিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। একটা মোটা বাঁধানো খাতায় যথার্থই তাহার নাম লেখা হইয়া গেল দেখিয়া মনে মনে সে অস্বস্তিতে ভরিয়া উঠিল এবং চুপ করিয়া থাকিতে আর না পারিয়া বলিয়া ফেলিল, কিন্তু কি উদ্দেশ্য, কি আমাকে করতে হবে কিছুই ত জানতে পারলাম না।!

ভারতী আপনাকে জানান নি?

অপূর্ব ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, কিছু জানিয়েছেন, কিন্তু একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, নবতারার আচরণ আপনারা কি সত্যই অন্যায় মনে করেন না?

সুমিত্রা কহিলেন, অন্ততঃ আমি করিনে। কারণ, দেশের বড় আমার কাছে কিছুই নেই।

অপূর্ব শ্রদ্ধাভরে কহিল, দেশকে আমিও প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। এবং দেশের সেবা করবার অধিকার স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই সমান, কিন্তু এঁদের কর্মক্ষেত্র ত এক নয়; আমরা পুরুষে বাইরে এসে কাজ করব, কিন্তু নারী গৃহের মধ্যে, শুদ্ধান্তঃপুরে স্বামী-পুত্রের সেবার মধ্যে দিয়াই সার্থক হবেন। তাঁদের সত্যকার কল্যাণে দেশের যতবড় কাজ হবে বাইরে এসে পুরুষের সঙ্গে ভিড় করে দাঁড়ালে ত সে কাজ কিছুতেই হবে না।

সুমিত্রা হাসিলেন। অপূর্ব লক্ষ্য করিয়া দেখিল সকলেই যেন তাঁহার প্রতি চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসি গোপন করিল। সুমিত্রা কহিলেন, অপূর্ববাবু, এটা অনেক দিনের এবং অনেকের মুখের কথা তা আমরা অস্বীকার করিনে। কিন্তু আপনি ত জানেন কোন একটা কথা কেবলমাত্র বহুদিন ধরে বহু লোকে বলতে থাকলেই তা সত্য হয়ে ওঠে না। এ ফাঁকির কথা। যারা কোনদিন দেশের কাজ করেনি এ তাদের কথা, দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থ যাদের ঢের বড় এ তাদের কথা। এর মধ্যে এতটুকু সত্য নেই। আপনি নিজে যখন কাজে লাগবেন, তখনই এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করবেন যে যাকে আপনি নারীর বাইরে এসে ভিড় করা বলচেন সে যদি কখনো ঘটে, তখনি দেশের কাজ হবে, নইলে কেবলমাত্র পুরুষের ভিড়ে শুকনো বালির মত সমস্ত ঝরে ঝরে পড়বে, কোনদিন জমাট বাঁধবে না।

অপূর্ব মনে মনে লজ্জা পাইয়া কহিল, কিন্তু এতে কি দুর্নীতি বাড়বে না? চরিত্র কলুষিত হবার ভয় থাকবে না?

সুমিত্রা বলিলেন, ভয় কি ভিতরেই কম থাকে নাকি? অপূর্ববাবু, ওটা বাইরে আসার দোষ নয়, দোষ বিধাতার, যিনি নর-নারী সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে অনুরাগের আকর্ষণ দিয়েছেন, তাঁর। অপূর্ববাবু, মনের মধ্যে একটুখানি বিনয় রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে একবার চেয়ে দেখুন দিকি?

এই মন্তব্য শুনিয়া অপূর্ব খুশী হইতে পারিল না, বরঞ্চ, একটুখানি তীব্রতার সঙ্গেই বলিয়া উঠিল, অন্য দেশের কথা অন্য দেশ ভাবুক, আমি নিজেদের কল্যাণ-চিন্তা করতে পারলেই যথেষ্ট মনে করব। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু এখানে একটা বস্তু আমি লক্ষ্য না করে পারিনি যে, বিবাহিত-জীবনের প্রতি আপনাদের আস্থা নাই, এমন কি নারীত্বের যা চরম উৎকর্ষ, সেই সতীত্ব ও পতিব্রতা-ধর্মকেও আপনারা অবহেলার চক্ষে দেখেন। এর থেকে আসবে দেশের কল্যাণ?

সুমিত্রা ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া সকৌতুক স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, অপূর্ববাবু, আপনি একটু রাগ করে বলচেন, নইলে ঠিক ও-ভাব ত আমি প্রকাশ করিনি। তবে আগাগোড়াই যে আপনি ভুল বুঝেছেন তাও নয়। যে সমাজে কেবলমাত্র পুত্রার্থেই ভার্যা গ্রহণের বিধি আছে, নারী হয়ে তাকে ত আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারিনে। আপনি সতীত্বের চরম উৎকর্ষের বড়াই করছিলেন, কিন্তু, এই যে-দেশে বিবাহের ব্যবস্থা, সে-দেশে ও-বস্তু বড় হয় না, ছোটই হয়। সতীত্ব ত শুধু দেহেই পর্যবসিত নয়, অপূর্ববাবু, মনেরও ত দরকার? কায়মনে ভালবাসতে না পারলে ত ওর উচ্চস্তরে পৌঁছান যায় না? আপনি কি সত্যই মনে করেন মন্ত্র পড়ে বিয়ে দিলেই যে-কোন বাঙালী মেয়ে যে-কোন বাঙালী পুরুষকে ভালবাসতে পারে? একি পুকুরের জল যে, যে-কোন পাত্রে ঢেলে মুখ বন্ধ করে দিলেই কাজ চলে যাবে?

অপূর্ব হঠাৎ কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কহিল, কিন্তু চিরকাল চলেও ত যাচ্ছে?

সুমিত্রা তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া মাথা নাড়িয়া কহিলেন, তা যাচ্ছে। প্রাণাধিক স্বামী বলে পাঠ লিখতেও তার বাধে না, কর্তব্যবোধে শ্রদ্ধাভক্তি করতেও হয়ত তার আটকায় না। বস্তুতঃ, ঘরকন্নার কাজে এর বেশি তার প্রয়োজন হয় না। আপনি ত গল্প পড়েছেন, কোন্‌ এক ঋষিপুত্রের দুধের বদলে চালের গুঁড়োর জল খেয়েই আরামে দিন কাটতো। কিন্তু, আরাম যেমনই হোক, যা নয় তাকে তাই বলে গর্ব করা ত যায় না।

এই আলোচনা অপূর্বর অত্যন্ত বিশ্রী ঠেকিল, কিন্তু এবারেও সে জবাব দিতে না পারিয়া কহিল, আপনি কি বলতে চান এর অধিক কারও ভাগ্যেই জোটে না?

সুমিত্রা কহিলেন, না, তা আমি বলিতেই পারিনে। কারণ, সংসারে দৈবাৎ বলেও একটা শব্দ আছে।

অপূর্ব কহিল, ওঃ—দৈবাৎ! কিন্তু কথা যদি আপনার সত্যও হয়, তবুও আমি বলি সমাজের মঙ্গলের জন্য, উত্তর-পুরুষের কল্যাণের জন্য আমাদের এই-ই ভাল।

সুমিত্রা তেমনি শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, না অপূর্ববাবু, সমাজ এবং আপনার উত্তর-পুরুষ কোনটারই এতে শেষ পর্যন্ত কল্যাণ হবে না। সমাজ ও বংশের নাম করে ব্যক্তিকে একদিন বলি দেওয়া হতো, কিন্তু ফল তার ভাল হয়নি,—আজ তা অচল। ভালবাসার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন উত্তর-পুরুষের জন্য না হলে এমন ভয়ানক স্নেহের ব্যবস্থা তার মাঝখানে স্থান পেত না। এই ব্যর্থ বিবাহিত-জীবনের মোহ নারীকে কাটাতেই হবে। তাকে বুঝাতেই হবে, এতে তার লজ্জাই আছে গৌরব নেই।

অপূর্ব ব্যাকুল হইয়া কহিল, কিন্তু ভেবে দেখুন আপনাদের এই সকল শিক্ষায় আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত সমাজে অশান্তি এবং বিপ্লব এসেই উপস্থিত হবে।

0 Shares