পথের দাবী

ডাক্তার বলিলেন, তা হবে বৈ কি।

অপূর্ব কহিল, আচ্ছা, নমস্কার, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এই বলিয়া সে চলিতে উদ্যত হইয়া কহিল, আচ্ছা, এমন ত হতে পারে, সে ব্যাটারা আজ আর কোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে?

ডাক্তার সায় দিয়া কহিলেন, বিচিত্র নয়।

অপূর্ব কহিল, নয়ই ত! আছেই!—আচ্ছা, নমস্কার! কিন্তু মজা দেখেছেন, যেখানে আসল দরকার সেখানে পুলিশের ছায়াটি পর্যন্ত দেখবার জো নেই। এই হল তাঁদের কর্তব্যজ্ঞান! আর এর জন্যই আমরা ট্যাক্স জুগিয়ে মরি। সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কি বলেন?

তাতে আর সন্দেহ কি! বলিয়া ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন। কহিলেন, চলুন, কথা কইতে কইতে আর খানিকটে আপনার সঙ্গে এগিয়ে যাই।

অপূর্ব লজ্জায় একেবারে ম্লান হইয়া গেল। একমুহূর্ত মাটির দিকে চাহিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি বড্ড ভীতু লোক ডাক্তারবাবু, আমার কিচ্ছু সাহস নেই। আর কেউ হলে অনায়াসে যেতে পারতো, এত রাত্রে আপনাকে কষ্ট দিত না।

তাহার এই বিনয়-নম্র নিরভিমান সত্য-কথায় ডাক্তার নিজের হাসির জন্য নিজেও যেন লজ্জা পাইলেন। সস্নেহে তাহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, সঙ্গে যাবার জন্যেই আমি এসেচি অপূর্ববাবু, নইলে প্রেসিডেন্ট আমাকে এ জিনিসটা হাতে গুঁজে দিতেন না। এই বলিয়া তিনি বাঁ হাতের মোটা কালো লাঠিটা দেখাইলেন।

অপূর্ব চকিত হইয়া কহিল, সুমিত্রা? তিনি কি আপনাকেও আদেশ করতে পারেন?

ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন, পারেন বৈ কি।

অপূর্ব বলিল, কিন্তু তিনি ত অন্য লোকও সঙ্গে দিতে পারতেন?

ডাক্তার কহিলেন, তার মানে সবাইকে দল বেঁধে পাঠানো। তার চেয়ে এই ব্যবস্থাই সোজা হয়েছে অপূর্ববাবু।

চলিতে চলিতে কথা হইতেছিল। ডাক্তার কহিলেন, সুমিত্রা আমাদের দলের কর্ত্রী, তাঁকে সকল দিক চেয়ে দেখে কাজ করতে হয়। যেখানে ছুরি-ছোরা খুন-জখম লেগেই আছে সেখানে যাকে-তাকে ত পাঠানো যায় না। আমি উপস্থিত না থাকলে আজ আপনাকে থাকতে হতো,—তিনি কোনমতেই আসতে দিতেন না।

এই অন্ধকার জনহীন পথে ছুরি-ছোরার কথায় অপূর্বর সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া গেল। আস্তে আস্তে কহিল, কিন্তু এই পথেই যে আপনাকে একাকী ফিরতে হবে!

ডাক্তার বলিলেন, তা হবে।

অপূর্ব আর প্রশ্ন করিল না। তাহাদের নিভৃত আলাপের গুঞ্জনশব্দ পাছে অবাঞ্ছিত কাহাকেও আকৃষ্ট করিয়া আনে এ খেয়াল তাহার মনের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সে তাহার চক্ষু কর্ণ ও মনকে একই কালে রাস্তার দক্ষিণে বামে ও সম্মুখে একান্ত নিবিষ্ট করিয়া নিঃশব্দ দ্রুতপথে পথ চলিতে লাগিল। মিনিট-পনের এইভাবে চলিয়া শহরের প্রথম পুলিশ-স্টেশনটা ডানহাতে রাখিয়া লোকালয়ে প্রবেশ করিয়া অপূর্ব আবার কথা কহিল, বলিল, ডাক্তারবাবু, আমার বাসা ত বেশী দূরে নয়, আজ রাত্রিটা ওখানে থাকলে ক্ষতি কি?

ডাক্তার তাহার মনের কথা অনুমান করিয়া সহাস্যে কহিলেন, ক্ষতি ত অনেক জিনিসেই হয় না অপূর্ববাবু, কিন্তু বিনা প্রয়োজনেও কোন কাজ করা আমাদের বারণ। শুধু কেবল প্রয়োজন নেই বলেই আমাকে ফিরে যেতে হবে।

আপনারা কি অপ্রয়োজনে জগতে কিছুই করেন না?

করা বারণ। আমি তাহলে বিদায় হই অপূর্ববাবু?

অপূর্ব কটাক্ষে পশ্চাতের সমস্ত অন্ধকার পথটার প্রতি চাহিয়া এই লোকটিকে একাকী ফিরিয়া যাইতে কল্পনা করিয়া আর একবার কণ্টকিত হইয়া উঠিল। কহিল, ডাক্তারবাবু, মানুষের মর্যাদা রক্ষা করাও কি আপনাদের বারণ?

ডাক্তার আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, হঠাৎ এ কথা কেন?

অপূর্ব ক্ষুণ্ণ অভিমানের সুরে বলিল, তা ছাড়া আর কি বলুন? আমি ভীতু লোক, দলবদ্ধ গুণ্ডাদের মধ্যে দিয়ে একলা যেতে পারিনে,—আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে সেই বিপদের ভেতর দিয়ে আপনি যদি আজ একাকী ফিরে যান, আর কি আমি মুখ দেখাতে পারবো?

ডাক্তার চক্ষের নিমিষে তাহার দুই হাত সস্নেহে ধরিয়া ফেলিয়া কহিলেন, আচ্ছা চলুন তবে আজ রাত্রির মত আপনার বাসাতে গিয়েই অতিথি হই গে। কিন্তু এ-সব হাঙ্গামা কি সহজে নিতে আছে ভাই !

কথাটা অপূর্ব ঠিক বুঝিল না, কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই হাতের মধ্যে কেমনতর একপ্রকার টান অনুভব করিয়া ফিরিয়া চাহিয়াই কহিল, আপনার জুতোয় বোধ করি লাগছে ডাক্তারবাবু, আপনি খোঁড়াচ্চেন!

ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ও কিছু না। লোকালয়ে আমার পা-দুটো কেমন আপনিই খুঁড়িয়ে চলে। গিরীশ মহাপাত্রের চলন মনে পড়ে?

অপূর্ব থমকিয়া দাঁড়াইল। কহিল, আপনাকে যেতে হবে না, ডাক্তারবাবু।

ডাক্তার তেমনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু আপনার মর্যাদা?

অপূর্ব বলিল, আপনার কাছে আবার মর্যাদা কি? পায়ের ধূলোর যোগ্যও ত নই। আপনি ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কারও এতবড় সাহস আছে!

এই ডাক্তার-ব্যক্তিটির জীবন-ইতিহাসের সহিত অপূর্বর প্রত্যক্ষ পরিচয় কিছুই ছিল না। থাকিলে সে এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার লইয়া এতখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতে লজ্জায় মরিয়া যাইত। সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের ন্যায় এই পথটুকুতে একাকী হাঁটা এই লোকটির কাছে কি! পুলিশের লোকে যাহাকে সব্যসাচী বলিয়া জানে, দশ-বারোজন দুর্বৃত্তে মিলিয়া তাহার পথরোধ করিবে কি করিয়া?

ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া শেষে ভাল মানুষটির মত কহিলেন, আচ্ছা, তার চেয়ে চলুন না কেন দুজনেই আবার একসঙ্গে ফিরে যাই? আমাকে একলা যদি বা কেউ আক্রমণ করতে সাহস করে আপনি কাছে থাকলে ত সে সম্ভাবনা থাকবে না!

অপূর্ব অনিশ্চিতকন্ঠে বলিল, আবার ফিরে যাবো?

ডাক্তার বলিলেন, দোষ কি? আমার একলা যাবার বিপদের শঙ্কাও থাকবে না।

থাকবো কোথায়?

আমার কাছে।

আফিস হইতে ফিরিয়া আজ অপূর্বর খাওয়া হয় নাই, তাহার অত্যন্ত ক্ষুধাবোধ হইতেছিল, একটু লজ্জিত হইয়া কহিল, দেখুন, আমার কিন্তু এখনো খাওয়া হয়নি,—আচ্ছা, তা না হয় আজ—

ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, চলুন না, ভাগ্য পরীক্ষা করে আজ দেখাই যাক। কিন্তু একটা কথা, তেওয়ারী বেচারা বড় চিন্তিত হয়ে থাকবে।

তেওয়ারীর উল্লেখে অপূর্বর মনের মধ্যে হঠাৎ একটা হিংস্র প্রতিশোধের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল, রাগ করিয়া বলিল, মরুক গে ব্যাটা ভেবে,—চলুন যাই। এই বলিয়া সে একরকম জোর করিয়াই তাঁহাকে বাধা দিয়া সেই আলো-আঁধারের জনশূন্য-পথে উভয়ে হাঁটিতে হাঁটিতে আবার ফিরিয়া চলিল। এবার কিন্তু ভয়ের কথা তাহার মনেই হইল না। পুলিশ থানা পার হইয়া সহসা একসময়ে সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি কি এ্যানার্কিস্ট?

ডাক্তার অন্ধকারে তাহার মুখের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার কাকাবাবু কি বলেন?

অপূর্ব কহিল, তিনি বলেন সব্যসাচী একজন ভয়ানক এ্যানার্কিস্ট।

আমি যে সব্যসাচী এ-সম্বন্ধে আপনার কোন সন্দেহ নেই?

না।

এ্যানার্কিস্ট বলতে আপনি কি বুঝেন?

অপূর্ব এ প্রশ্নের হঠাৎ জবাব দিতে পারিল না। একটু ভাবিয়া কহিল, অর্থাৎ কিনা রাজদ্রোহী—যিনি রাজার শত্রু।

ডাক্তার বলিলেন, আমাদের রাজা এদেশে থাকেন না, থাকেন বিলাতে। লোকে বলে অতিশয় ভদ্রলোক। আমি তাঁকে কখনো চোখে দেখিনি, তিনিও আমার কখনো লেশমাত্র ক্ষতি করেন নি। তাঁর প্রতি বৈরীভাব আসবে আমার কোথা থেকে অপূর্ববাবু!

0 Shares