পথের দাবী

মা? মা ত পরশু রাত্তিরে যদুকাকার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে লাইনের বাইরে ঘরভাড়া করেচে। মেয়েটা আরও কি বলিতেছিল, কিন্তু বাপ গর্জন করিয়া উঠিল,—করাচ্চি! এ বাবা বিয়ে-করা পরিবার, বেউশ্যে নয়! এই বলিয়া সে অনিশ্চিত কম্পিতহস্তে স্ক্রুর অভাবে ভাঙ্গা খুন্তির ডগা দিয়া নূতন বোতলের ছিপি খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

ভারতী হঠাৎ তাহার অঞ্চলপ্রান্তে একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, অপূর্বর মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেছে। কখনো সে ভারতীকে স্পর্শ করে নাই, কিন্তু এখন সে জ্ঞানই তাহার ছিল না। কহিল, চলুন এখান থেকে।

একটু দাঁড়ান।

না, এক মিনিট না। এই বলিয়া সে একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে বাহিরে আনিল। ঘরের ভিতরে মানিক ছিপি বোতল ও খুন্তির বাঁট লইয়া বীরদর্পে গর্জাইতে লাগিল যে, খুন করিয়া ফাঁসি যাইতে হয় সে ভি আচ্ছা। সে দেশো গুণ্ডার ছেলে, সে জেল বা ফাঁসি কোনটাকেই ভয় করে না।

বাহিরে আসিয়া অপূর্ব যেন অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল,— হারামজাদা, নচ্ছার, পাজী মাতাল! যেন পিশাচের নরককুণ্ড বানিয়ে রেখেচে। এখানে পা দিতে আপনার ঘৃণা বোধ হল না?

ভারতী তাহার মুখের পানে চাহিয়া আস্তে আস্তে বলিল, না। তার কারণ এ নরককুণ্ড ত এরা বানায় নি। এরা শুধু তার প্রায়শ্চিত্ত করচে।

অপূর্ব কহিল, না এরা বানায় নি আমি বানিয়েচি। মেয়েটার কথা শুনলেন! ওর মা যেন কোন্‌ তীর্থযাত্রা করেছে! নির্লজ্জ বেহায়া শয়তান! আর কখ্‌খনো যদি এখানে আসবেন ত টের পাবেন বলে দিচ্চি।

ভারতী একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমি ম্লেচ্ছ ক্রীশ্চান, আমার এখানে আসতে দোষ কি?

অপূর্ব রাগ করিয়া বলিল, দোষ নেই? ক্রীশ্চানের জন্যে কি সৎ-অসৎ বস্তু নেই, নিজেদের সমাজের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না?

ভারতী উত্তর দিল, কে আছে আমার যে জবাবদিহি করবো? কার মাথাব্যথা পড়েচে আমার জন্যে, আপনিই বলুন?

অপূর্ব সহসা কোন প্রত্যুত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া শুধু বলিল, এ-সব আপনার চালাকি। আপনি ঘরে ফিরে চলুন।

আমাকে আরও পাঁচ জায়গায় যেতে হবে। আপনার ভাল না লাগে আপনি ফিরে যান।

ফিরে যান বললেই কি আপনাকে এখানে রেখে আমি যেতে পারি?

তাহলে সঙ্গে থাকুন। মানুষের প্রতি মানুষে কত অত্যাচার করচে চোখ মেলে দেখতে শিখুন। কেবল ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে, নিজে সাধু হয়ে থেকে ভেবেচেন পুণ্য সঞ্চয় করে একদিন স্বর্গে যাবেন? মনেও করবেন না। বলিতে বলিতে ভারতীর মুখের চেহারা কঠোর এবং গলার স্বর তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল। এই মূর্তি ও কণ্ঠে অপূর্বর অত্যন্ত পরিচিত। ভারতী কহিল, ওই মেয়েটার মা এবং যদু যে অপরাধ করেছে সে শুধু ওদের দণ্ড দিয়েই শেষ হবে? আপনি তার কেউ নয়? কখখনো না! ডাক্তারবাবুকে না-জানা পর্যন্ত আমিও ঠিক এমনি করেই ভেবে এসেচি। কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জানি, এই নরককুণ্ডে যত পাপ জমা হবে তার ভার আপনাকে পর্যন্ত স্বর্গের দোর থেকে টেনে এনে এই নরককুণ্ডে ডোবাবে। সাধ্য কি আপনার এই দুষ্কৃতির ঋণশোধ না করে পরিত্রাণ পান! আমরা নিজের গরজেই আসি অপূর্ববাবু, এই উপলব্ধিই আমাদের পথের-দাবীর সবচেয়ে বড় সাধনা। চলুন।

অপূর্ব নিরীহ ও নিঃস্পৃহের ন্যায় কহিল, চলুন। ভারতীর কথা কিন্তু সে বুঝিতেও পারিল না, বিশ্বাসও করিল না।

কিছু দূরে একটা সেগুন গাছ ছিল, ভারতী আঙুল দিয়া দেখাইয়া কহিল, ওই সামনে ক’ ঘর বাঙালী থাকে,—চলুন।

অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, বাঙালী ভিন্ন অপর জাতের মধ্যে আপনারা কাজ করেন না?

ভারতী বলিল, করি। সকলকেই আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর ত কেউ সকলের ভাষা জানে না, তিনি সুস্থ থাকলে এ কাজ তাঁরই, আমার নয়।

তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত ভাষা জানেন?

জানেন।

আর ডাক্তারবাবু?

ভারতী হাসিয়া বলিল, ডাক্তারবাবুর সম্বন্ধে আপনার ভারী কৌতূহল। এ কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না কেন যে, পৃথিবীতে যা-কিছু জানা যায় তিনি জানেন, যা-কিছু পারা যায় তিনি পারেন। কে তাঁর সব্যসাচী নাম রেখেছিল আমরা কেউ জানিনে, কিন্তু তাঁর অসাধ্য তাঁর অজ্ঞাত সংসারে কিচ্ছু নেই। এই বলিয়া সে নিজের মনে চলিতেই লাগিল, কিন্তু তাহারই পিছনে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া অপূর্বর মুখ দিয়া গভীর নিঃশ্বাস পড়িল। অকস্মাৎ এই কথাটা তাহার বুকের মধ্যে উদ্বেলিত হইয়া উঠিল যে, এই হতভাগ্য পরাধীন দেশে এতবড় একটা প্রাণের কোন মূল্য নাই, যে-কোন লোকের হাতে যে-কোন মুহূর্তে তাহা কুকুর-শিয়ালের মতই বিনষ্ট হইতে পারে! সমস্ত জগৎবিধানে এতবড় নিষ্ঠুর অবিচার আর কি আছে? ভগবান মঙ্গলময় এই যদি সত্য, এ তবে কাহার ও কোন্‌ পাপের দণ্ড?

উভয়ে একটা ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। ভারতী ডাকিল, পাঁচকড়ি কেমন আছ আজ?

অন্ধকার কোণ হইতে সাড়া আসিল, আজ একটু ভাল। এই বলিয়া একজন বুড়াগোছের লোক ডান হাতটা উঁচু করিয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার আগাগোড়া কি কতকগুলা প্রলেপ দেওয়া, কহিল, মা, মেয়েটা রক্ত-আমাশায় বোধ হয় বাঁচবে না, ছেলেটার আবার কাল থেকে বেহুঁশ জ্বর, এমন একটা পয়সা নেই যে এক ফোঁটা ওষুধ কিনে দি, কি এক বাটি সাগু-বার্লি রেঁধে খাওয়াই। তাহার দুই চোখ ছলছল করিয়া আসিল।

অপূর্বর মুখ দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া গেল, পয়সা নেই কেন?

এই অপরিচিত বাবুটিকে লোকটা কয়েক মুহূর্ত নীরবে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, পুলির শেকল পড়ে ডান হাতটাই জখম হয়ে গেছে, মাস-খানেক ধরে কাজে বার হতে পারিনি, পয়সা থাকবে কি করে বাবুমশায়?

অপূর্ব প্রশ্ন করিল, কারখানার ম্যানেজার এর ব্যবস্থা করেন না?

পাঁচকড়ি কপালে একবার বাম হাতটা স্পর্শ করিয়া কহিল, হায়! হায়! দিনমজুরদের আবার ব্যবস্থা! এতেই বলচে কাজ করতে না পার ত ঘর ছেরে দাও, আবার যখন ভাল হবে তখন এসো,—কাজ দেবো। এ অবস্থায় কোথায় যাই বলুন ত মশায়? ছোটসাহেবের হাতে-পায়ে ধরে বড়জোর আর হপ্তাখানেক থাকতে পাবো। বিশ বচ্ছর কাজ করছি মশায়, এরা এমনি নেমকহারাম!

কথা শুনিয়া অপূর্ব রাগে জ্বলিতে লাগিল। তাহার এমনি ইচ্ছা করিতে লাগিল ম্যানেজার লোকটাকে পায় ত কান ধরিয়া টানিয়া আনিয়া দেখায়, সুদিনে যাহারা লক্ষ লক্ষ টাকা-উপার্জন করিয়া দিয়াছে আজ দুর্দিনে তাহারা কি দুঃখই ভোগ করিতেছে! অপূর্বদের বাটীর কাছে গরুর গাড়ির আড্ডা, তাহার মনে পড়িল, এক জোড়া গরু সমস্ত জীবন ধরিয়া বোঝা টানিয়া অবশেষে বৃদ্ধ ও অক্ষম হইয়া পড়িলে লোকটা তাহাদের কসাইখানায় বিক্রি করিয়া দিয়াছিল। এই হৃদয়হীনতা নিবারণ করিবার উপায় নাই, লোকে করে না, কেহ করিতে চাহিলে সবাই তাকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দেয়। সেই পথ দিয়া যখনই সে গিয়াছে, তখনই এই কথা মনে করিয়া তাহার চোখে জল আসিয়াছে। গরুর জন্য নয়, কিন্তু অর্থের পিপাসায় এই বর্বর নিষ্ঠুরতায় মানুষ আপনাকে আপনি কত ছোটই না প্রতিদিন করিয়া আনিতেছে! সহসা ভারতীর কথাটা স্মরণ করিয়া সে মনে মনে কহিল, ঠিক কথাই ত! কে কোথায় করিতেছে আমি ত করি না, অথবা, এমনিই ত হয়, এই ত চিরদিন হইয়া আসিতেছে—এই বলিয়াই ত এতবড় ত্রুটির জবাবদিহি হয় না! গরু-ঘোড়া শুধু উপলক্ষ্য। এই হাত-ভাঙ্গা পাঁচকড়িটাও তাই। আপনাকে যে বাঁচাইতে পারে না তাহার হত্যায়, যে দুর্বল তাহার পীড়নে, যে নিরুপায় তাহার লজ্জাহীন বঞ্চনায় এই যে মানুষে আপনার হৃদয়বৃত্তির জীবন হরণ করিতেছে, সবলের এই যে আত্মহত্যার অহোরাত্রব্যাপী উৎসব চলিয়াছে, ইহার বাতি নিভিবে কবে? এই সর্বনাশা উন্মত্ততার পরিসমাপ্তি ঘটিবে কোন্‌ পথ দিয়া? মরণের আগে কি আর তাহার চেতনা ফিরিবে না!

0 Shares