পথের দাবী

শুধু একবার যদি তোমাদের ঘুম ভাঙ্গে, কেবল একটিবার মাত্র যদি এই সত্য কথাটা বুঝতে পারো যে তোমরাও মানুষ, তোমরা যত দুঃখী, যত দরিদ্র, যত অশিক্ষিতই হও তবুও মানুষ, তোমাদের মানুষের দাবী কোন ওজুহাতে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, তা হলে, এই গোটাকতক কারখানার মালিক তোমাদের কাছে কতটুকু? এই সত্য কি তোমরা বুঝবে না? এ যে কেবল ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের আত্মরক্ষার লড়াই! এতে দেশ নেই, জাত নেই, ধর্ম নেই, মতবাদ নেই—হিন্দু নেই, মুসলমান নেই,—জৈন, শিখ কোন কিছুই নেই,—আছে শুধু ধনোন্মত্ত মালিক আর তার অশেষ প্রবঞ্চিত অভুক্ত শ্রমিক! তোমাদের গায়ের জোরকে তারা ভয় করে, তোমাদের শিক্ষার শক্তিকে তারা অত্যন্ত সংশয়ের চোখে দেখে, তোমাদের জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষায় তাদের রক্ত শুকিয়ে যায়! অক্ষম, দুর্বল, মূর্খ, দুর্নীতিপরায়ণ তোমরাই যে তাদের বিলাস-ব্যসনের একমাত্র পাদপীঠ! তাই, মাত্র তোমাদের জীবনধারণটুকুর বেশী তিলার্ধ যে তারা স্বেচ্ছায় কোন দিন দেবে না—এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করা কি তোমাদের এতই কঠিন! আর সেই কথা মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করার অপরাধেই কি আজ এই গোরাগুলোর কাছে আমার লাঞ্ছনাই সার হবে! দরিদ্রের এই বাঁচবার লড়াইয়ে তোমরা কি সকল শক্তি দিয়ে যোগ দিতে পারবে না?

সর্দার-গোরা এদেশে যেটুকু হিন্দি-ভাষা জ্ঞানলাভ করিয়াছিল তাহাতে বক্তৃতার মর্ম প্রায় কিছুই বুঝিল না, কিন্তু সমবেত শ্রোতৃবর্গের মুখে-চোখে উত্তেজনার চিহ্ন লক্ষ্য করিয়া নিজেও উত্তেজিত হইয়া উঠিল। তাহার রিস্টওয়াচের প্রতি বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিল, আর পাঁচ মিনিট মাত্র সময় আছে, আপনি শেষ করুন।

তলওয়ারকর কহিল, শুধু পাঁচ মিনিট! তার বেশী এক মুহূর্তও নয়! তবুও এই অমূল্য ক’টি মিনিট আমি কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। ভাই বঞ্চিতের দল! তোমাদের কাছে আমার মিনতি—আমাদের তোমরা অবিশ্বাস করো না। শিক্ষিত বলে, ভদ্রবংশের বলে, কারখানায় দিনমজুরি করিনে বলে আমাদের সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে নিজেদের সর্বনাশ তোমরা নিজেরাই করো না। তোমাদের ঘুম ভাঙ্গাবার প্রথম শঙ্খধ্বনি সর্বদেশে সর্বকালে আমরাই করে এসেছি। আজ হয়ত না বুঝতেও পারো, কিন্তু নিশ্চয় জেনো, এই পথের-দাবীর চেয়ে বড় বন্ধু এ-দেশে তোমাদের আর কেউ নেই। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও কঠিন হইয়া আসিতেছিল, তথাপি প্রাণপণে চিৎকার করিয়া কহিতে লাগিল, আমি বহুদিন তোমাদের মধ্যে কাজ করে এসেছি, আমাদের তোমরা চেনো না, কিন্তু আমি তোমাদের চিনি। যাদের তোমরা মনিব বলে জানো, একদিন আমি তাদেরই একজন ছিলাম,। তারা কিছুতেই তোমাদের মানুষ হ’তে দেবে না। কেবল পশুর মত করে রেখেই তোমাদের মনুষ্যত্বের অধিকার তারা আটকে রাখতে পারে, আর কোন মতেই না—এই কথাটা আজ তোমাদের না বুঝলেই নয়। তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াসক্ত—তাদের মুখ থেকে এই-সকল অপবাদই তোমরা চিরদিন শুনে এসেছ। তাই, যখনই তোমরা তোমাদের দাবী জানিয়েছ, তখনই তোমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকেই দায়ী করে তারা তোমাদের সর্বপ্রকার উন্নতিকে নিবারিত করে এসেছে,—কেবল এই মিথ্যেই তোমাদের তারা অনুক্ষণ বুঝিয়ে এসেছে,—ভাল না হলে কারও উন্নতিই কোন দিন হতে পারে না। কিন্তু, আজ আমি তোমাদের অসঙ্কোচে এবং একান্ত অকপটে জানাতে চাই ঐ উক্তি তাদের কখনই সম্পূর্ণ সত্য নয়। তোমাদের চরিত্রই শুধু তোমাদের অবস্থার জন্য দায়ী নয়; তোমাদের এই প্রবঞ্চিত হীন অবস্থাও তোমাদের চরিত্রের জন্য দায়ী।

তাদের অসত্যকে আজ তোমাদের নির্ভয়ে প্রতিবাদ করতেই হবে। প্রবলকণ্ঠে তোমাদের ঘোষণা করতেই হবে কেবল টাকাই সবটুকু নয়। বলিতে বলিতে তাহার নীরস কণ্ঠ অত্যন্ত প্রখর হইয়া উঠিল, কহিল, বিনাশ্রমে সংসারে কিছুই উৎপন্ন হয় না—তাই, শ্রমিকও ঠিক তোমাদেরই মত মালিক,—ঠিক তোমাদের মতই সকল বস্তু, সকল কারখানার অধিকারী। এমনি সময়ে কে একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক সর্দার-গোরার কানে কানে কি একটা কথা বলিতেই তাহার রক্তচক্ষু জ্বলন্ত অঙ্গারের মত উগ্র হইয়া উঠিল। সে গর্জন করিয়া বলিল, স্টপ্‌! এ চলবে না। এতে শান্তি ভঙ্গ হবে।

অপূর্ব চমকিয়া উঠিল। রামদাসের জামার খুঁট ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল,—থামো, রামদাস থামো। এই নিঃসহায় নির্বান্ধব বিদেশে যে তোমার স্ত্রী আছে,—তোমার ছোট্ট একফোঁটা মেয়ে আছে!

রামদাস কর্ণপাতও করিল না। চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল—এরা অন্যায়কারী! এরা ভীরু! সত্যকে এরা কোনমতেই তোমাদের শুনতে দিতে চায় না! কিন্তু এরা জানে না সত্যকে গলা টিপে মারা যাবে না। সে চিরজীবী! সে অমর! গোরা ইহার অর্থ বুঝিল না। কিন্তু অকস্মাৎ সহস্র লোকের সর্বাঙ্গ হইতে ঠিকরিয়া আসিয়া যেন তীক্ষ্ণ উত্তাপের ঝাঁজ তাহার মুখে লাগিল। সে হুঙ্কার দিয়া উঠিল, এ চলবে না। এ রাজদ্রোহ!

চক্ষের পলকে পাঁচ-ছয়জন ঘোড়া হইতে লাফাইয়া পড়িয়া রামদাসের দুই হাত ধরিয়া তাহাকে সবলে টানিয়া নীচে নামাইল। তাহার দীর্ঘদেহ ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের মাঝখানে এক মুহূর্তে অন্তর্হিত হইল কিন্তু তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর তাহার কিছুতেই চাপা পড়িল না, এই বিক্ষুব্ধ বিপুল জনতার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ধ্বনিত হইতে লাগিল,—ভাই সকল, কখনো হয়ত আর আমাকে দেখবে না, কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাবার মর্যাদা যদি না মনিবের পায়ে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে থাকো ত এতবড় উৎপীড়ন, এতবড় অপমান তোমরা সহ্য করো না!

কিন্তু কথা তাহার শেষ না হইতেই যেন দক্ষযজ্ঞ বাধিয়া গেল।ঘোড়া ছুটিল, চাবুক চলিল, এবং অবমানিত অভিভূত উত্রস্ত শ্রমিকের দল ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে কে যে কাহার ঘাড়ে পড়িল এবং কে যে কাহার পদতলে গড়াইতে লাগিল তাহার ঠিকানা রহিল না।

জন-কয়েক দলিত পিষ্ট আহত লোক ছাড়া সমস্ত মাঠ জনশূন্য হইতে বিলম্ব ঘটিল না। কোনমতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে যাহারা তখনও চলিয়াছিল তাহাদেরই প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া সুমিত্রা স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, এবং তাহারই অনতিদূরে বসিয়া অপূর্ব ও আর একজন নির্বাক নতমুখে তেমনি বিমূঢ়ের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।

যে ব্যক্তি গাড়ি ডাকিতে গিয়াছিল, মিনিট-দশেক পরে গাড়ি লইয়া আসিলে সুমিত্রা নিঃশব্দে ভারতীর হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন। নিজে হইতে কথা না কহিলে তাঁহার চিন্তার ব্যাঘাত করিতে কেহ তাঁহাকে ব্যর্থ প্রশ্ন করিত না। বিশেষতঃ, আজ তিনি অসুস্থ, শ্রান্ত ও উৎপীড়িত। ভারতী ফিরিয়া আসিয়া কহিল, চলুন।

অপূর্ব মুখ তুলিয়া চাহিল, ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় আমাকে যেতে বলেন?

ভারতী কহিল, আমার বাড়িতে।

অপূর্ব কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া রহিল। শেষে আস্তে আস্তে বলিল, আপনারা ত জানেন সমিতির আমি অযোগ্য।ওখানে আর ত আমার ঠাঁই হতে পারে না।

ভারতী প্রশ্ন করিল, তা হলে কোথায় এখন যাবেন? বাসায়?

বাসায়? একবার যেতে হবে,—এই বলিয়াই অপূর্বর চক্ষু সজল হইয়া আসিল; তাহা কোনমতে সংবরণ করিয়া বলিল, কিন্তু এই বিদেশে আর একটা জায়গায় যে কি করে যাব আমি ভেবে পাইনে ভারতী!

0 Shares