পথের দাবী

সুমিত্রা গাড়ির মধ্যে হইতে ক্ষীণকণ্ঠে ডাকিয়া কহিলেন, তোমরা এস।

ভারতী পুনশ্চ কহিল, চলুন।

অপূর্ব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, পথের-দাবীতে আর আমার স্থান নেই।

ভারতী হঠাৎ যেন তাহার হাত ধরিতে গেল, কিন্তু সামলাইয়া লইয়া একমুহূর্ত তাহার মুখের পরে দুই চক্ষের সমগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া চুপি চুপি কহিল, পথের-দাবীতে স্থান নাও থাকতে পারে, কিন্তু আর একটা দাবী থেকে আপনাকে স্থানচ্যুত করতে পারে সংসারে এমন ত কিছুই নেই, অপূর্ববাবু!

গাড়ি হইতে সুমিত্রা পুনশ্চ অসহিষ্ণুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তোমাদের আসতে কি দেরি হবে ভারতী?

ভারতী হাত নাড়িয়া গাড়োয়ানকে যাইতে ইঙ্গিত করিয়া দিয়া কহিল, আপনি যান, এটুকু আমরা হেঁটেই যাবো।

পথে চলিতে চলিতে অপূর্ব হঠাৎ বলিয়া উঠিল, তুমি আমার সঙ্গে চল ভারতী!

ভারতী কহিল, সঙ্গেই ত যাচ্ছি।

অপূর্ব বলিল, সে নয়। তলওয়ারকরের স্ত্রীর কাছে আমি কি করে যাবো, কি গিয়ে তাঁকে বলব, কি তাঁর উপায় করব আমি ত কোন মতেই ভেবে পাইনে। রামদাসকে এখানে সঙ্গে করে আনবার দুর্বুদ্ধি আমার কেন হল?

ভারতী চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব কহিতে লাগিল, এই বিদেশে হঠাৎ কি সর্বনাশই হয়ে গেল! আমি ত কূলকিনারা দেখতে পাইনে।

ভারতী কোন মন্তব্যই প্রকাশ করিল না। উভয়ে কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিবার পরে অপূর্ব উপায়হীন দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হইয়া সহসা গর্জিয়া উঠিল, আমার দোষ কি? বারবার সাবধান করে দিলেও কেউ যদি গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলে তাকে বাঁচাবো আমি কি করে? আমি কি বলেছিলাম যা-তা বক্তৃতা দিতে! স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে, ঘর-সংসার আছে এ হুঁশ যার নেই—সে মরবে না তো মরবে কে? খাটুক আবার দু’বছর জেল!

ভারতী বলিল, আপনি কি তাঁর স্ত্রীর কাছে এখন যাবেন না?

অপূর্ব তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, যেতে হবে বৈ কি! কিন্তু, সাহেবকেই বা কাল কি জবাব দেব? তোমাকে কিন্তু বলে রাখছি ভারতী, সাহেব একটা কথা বললেই আমি চাকরি ছেড়ে দেব।

দিয়ে কি করবেন?

বাড়ি চলে যাবো। এদেশে মানুষ থাকে?

ভারতী বলিল, তাঁর উদ্ধারের চেষ্টাও করবেন না?

অপূর্ব থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, চল না একজন ভাল ব্যারিস্টারের কাছে যাই ভারতী। আমার প্রায় এক হাজার টাকা আছে,—এতে হবে না? আমার ঘড়িটড়িগুলো বিক্রি করলে হয়ত, আরও পাঁচ-ছ’শ টাকা হবে। চল না যাই।

ভারতী বলিল, কিন্তু তাঁর স্ত্রীর কাছে যাওয়া যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অপূর্ববাবু! আমার সঙ্গে আর যাবেন না, এইখান থেকেই একটা গাড়ি নিয়ে স্টেশনে চলে যান। তাঁর কি চাই, কি অভাব, অন্ততঃ একটা খবর দেওয়াও যে বড় দরকার।

অপূর্ব ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, কিন্তু তথাপি সঙ্গে সঙ্গেই চলিতে লাগিল। ভারতী বলিল, এটুকু আমি একাই যেতে পারবো, আপনি ফিরুন।

জবাব দিতে বোধ হয় অপূর্বর বাধিতেছিল, কিন্তু ক্ষণেকমাত্র। তাহার পরেই কহিল, আমি একলা যেতে পারব না।

ভারতী বলিল, বাসা থেকে তেওয়ারীকে না হয় সঙ্গে নেবেন।

না, তুমি সঙ্গে চল।

আমার যে জরুরি কাজ আছে!

তা হোক, চল।

কিন্তু কেন আমাকে এত করে জড়াচ্চেন অপূর্ববাবু?

অপূর্ব চুপ করিয়া রহিল।

ভারতী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটুখানি হাসিল, কহিল, আচ্ছা, চলুন আমার সঙ্গে। নিজের কাজটুকু আগে সেরে নিই।

পথের মধ্যে ভারতী সহসা এক সময়ে কহিল, যে আপনাকে চাকরি করতে বিদেশে পাঠিয়েছে সে আপনাকে চেনে না। তিনি মা হলেও, না। তেওয়ারী দেশে যাচ্চে, আমি নিজে গিয়ে উদ্যোগ করে তার সঙ্গে আপনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

অপূর্ব মৌন হইয়া রহিল। ভারতী বলিল, কৈ, উত্তর দিলেন না যে বড়?

অপূর্ব কহিল, উত্তর দেবার কিছু ত নেই। মা বেঁচে না থাকলে আমি সন্ন্যাসী হতুম।

ভারতী আশ্চর্য হইয়া বলিল, সন্ন্যাসী? কিন্তু মা ত বেঁচে আছেন?

অপূর্ব কহিল, হাঁ। দেশের পল্লীগ্রামে আমাদের একটা ছোট বাড়ি আছে, মাকে আমি সেইখানে নিয়ে যাবো।

তারপরে?

আমার যে এক হাজার টাকা আছে তাই দিয়ে একটা ছোট্ট মুদির দোকান খুলবো। আমাদের দুজনের চলে যাবে।

ভারতী কহিল, তা যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এর দরকার হ’ল কিসে?

অপূর্ব বলিল, আজ আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি। শুধু মা ছাড়া সংসারে আমার দাম নেই। ভগবান করুন এর বেশী যেন না আমি কারো কাছে কিছু চাই।

ভারতী পলকমাত্র তাহার মুখের পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা আপনাকে বুঝি বড্ড ভালবাসেন?

অপূর্ব কহিল, হাঁ। চিরকাল মা’র দুঃখে-দুঃখেই কাটলো, কেবল ভয় হয় তা আর যেন না বাড়ে। আমার সকল কাজেকর্মে আমার আধখানা যেন মা হয়ে আমার আর আধখানাকে দিবারাত্র আঁকড়ে ধরে থাকে। এ থেকে আমি একমুহূর্ত ছাড়া পাইনে, ভারতী, তাই আমি ভীতু, তাই আমি সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র। এই বলিয়া তাহার মুখ দিয়া সহসা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল।

ইহার জবাব ভারতী দিল না, কেবল হাতখানি তাহার ধীরে ধীরে অপূর্বর হাতের মধ্যে ধরা দিয়া নীরবে পথ চলিতে লাগিল।

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, অপূর্ব উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, রামদাসের পরিবারের কি উপায় করবে ভারতী? শুধু দাসী ছাড়া এদেশে তাদের দেশের লোক বোধ করি কেউ নেই। থাকলেই বা কেউ কি তাদের ভার নেবে?

ভারতী নিজেও কিছু ভাবিয়া পায় নাই, শুধু সাহস দিবার জন্যই কহিল, চলুন ত গিয়ে দেখি। উপায় একটা হবেই।

অপূর্ব বুঝিল ইহা ফাঁকা কথা। তাহার মন কোন সান্ত্বনাই মানিল না । কহিল, তোমাকে হয়ত সেখানে থাকতে হবে।

কিন্তু আমি ত ক্রীশ্চান, তাঁদের কি কাজেই বা লাগবো?

তা বটে। কথাটা নূতন করিয়া অপূর্বর বিঁধিল।

উভয়ে বাসায় আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেছে। এই রাত্রে কেমন করিয়া যে কি হইবে চিন্তা করিয়া মনে মনে তাহাদের ভয় ও উদ্বেগের সীমা ছিল না। নীচের ঘর খোলা ছিল, ভিতরে পা দিয়াই ভারতী দেখিতে পাইল ওদিকের খোলা জানালার ধারে ইজিচেয়ারে কে একজন শুইয়া আছে। সে মুখ তুলিয়া চাহিতেই ভারতী চিনিতে পারিয়া উল্লাসে কলরব করিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু, কখন এলেন আপনি? সুমিত্রাদিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না।

অপূর্ব কহিল, ভয়ানক কাণ্ড হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু, আমাদের একাউন্টেন্ট রামদাস তলওয়ারকরকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

ভারতী বলিল, ইন্‌সিনে তাঁর বাসা। সেখানে স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে, তাঁরা এখনো কিছুই জানেন না।

অপূর্ব বলিল, অত দূরে এই অন্ধকার রাতে—কি ভয়ানক বিপদই ঘটলো ডাক্তারবাবু!

ডাক্তার হাই তুলিয়া সোজা হইয়া বসিয়া হাসিলেন, ভারতীকে কহিলেন, আমি বড় শ্রান্ত, আমাকে একটু চা তৈরি করে খাওয়াতে পারো ভাই?

ভারতী বলিল, পারি, কিন্তু আমাদের যে এখুনি বেরোতে হবে ডাক্তারবাবু।

কোথায়?

ইন্‌সিনে। তলওয়ারকরবাবুর বাসায়।

কোন প্রয়োজন নেই।

অপূর্ব সবিস্ময়ে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, প্রয়োজন নেই কিরকম ডাক্তারবাবু? তাঁর বিপন্ন পরিবারের ব্যবস্থা করা, অন্ততঃ একটা খোঁজখবর নেওয়া ত প্রয়োজন বলেই মনে হয়।

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু সে ভার আমার; আপনারা বড় জোর এই অন্ধকারে সারারাত্রি ধরে ইন্‌সিনে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারবেন,—শেষ পর্যন্ত হয়ত বাড়িটাও চিনে বার করতে পারবেন না।

0 Shares