পথের দাবী

লেখা চিঠিগুলি ডাক্তার তাহার হাতে দিয়া হাসিয়া কহিলেন, একখানি তোমার, একখানি সুমিত্রার, অন্যখানি তোমাদের পথের-দাবীর। আমার উপদেশ বল, আদেশ বল, সবই এর মধ্যে পাবে।

চিঠিগুলি মুঠার মধ্যে লইয়া ভারতী মুখ মলিন করিয়া বলিল, এবার কি আপনি বেশী দিনের জন্যে যাচ্চেন?

দেবা ন জানন্তি,—বলিয়া ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন।

ভারতী কহিল, আমাদের মুশকিল হয়েছে, না মুখ দেখে, না কথা শুনে আপনার মনের কথা জানবার জো আছে। ঠিক করে বলে যান কবে ফিরবেন?

ঐ যে বললাম, দেবা ন জানন্তি—

না তা হবে না, সত্যি করে বলুন কবে ফিরবেন?

এত তাগাদা কেন বল ত?

ভারতী কহিল, কি জানি এবার যেন ভয় করচে। মনে হচ্চে যেন সব ভেঙ্গেচুরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। বলিতে বলিতে সহসা তাহার চক্ষু অশ্রুপরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া ডাক্তার রহস্যভরে কহিলেন, হবে না গো, হবে না,—সব ঠিক হয়ে যাবে। বলিয়াই হঠাৎ ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, কিন্তু এই মানুষটির সঙ্গে এমন মিছেমিছি ঝগড়া করলে কিন্তু সত্যিই কাঁদতে হবে তা’ বলে রাখচি। অপূর্ববাবু রাগ করেন বটে কিন্তু ভাল যাকে বাসেন তাকে ভালবাসতেও জানেন। মানুষের মধ্যে যে হৃদয় বস্তুটি আছে সে আমাদের সংসর্গে এখনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়নি। ফুটন্ত পদ্মটির মত ঠিক তাজা আছে।

ভারতী কি একটা জবাব দিতে যাইতেছিল কিন্তু অপূর্ব হঠাৎ মুখ তুলিতেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার নিজের মুখ বন্ধ হইয়া গেল।

এমনি সময়ে দ্বারের কাছে আসিয়া একখানা ঘোড়ার গাড়ি থামিল, এবং অনতিকাল মধ্যেই দুইজন লোক ভিতরে প্রবেশ করিল। একজনের পরিধানে আগাগোড়া সাহেবি পোশাক, ডাক্তার ভিন্ন বোধ করি সকলেরই অপরিচিত; আর একজন রামদাস তলওয়ারকর। অপূর্বর মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু কলরব করিয়া সে বন্ধুকে সংবর্ধনা করিতে গেল না। রামদাস অগ্রসর হইয়া ডাক্তারের পদধূলি গ্রহণ করিল। অপূর্বর কাছে ইহা অদ্ভুত ঠেকিল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের প্রতি সে শুধু নীরবে নেত্রপাত করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

ইংরাজি পোশাক-পরা লোকটি ইংরাজিতেই কথা কহিলেন, বলিলেন, জামিনের জন্যই এত বিলম্ব ঘটিল। কেস্‌ বোধ হয় গবর্নমেন্ট চালাবে না।

ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তার মানে গবর্নমেন্টকে তুমি আজও চেনোনি কৃষ্ণ আইয়ার।

এই কথায় রামদাস সহাস্যে যোগ দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাঠ থেকে থানা পর্যন্ত আপনাকে সকল সময়েই সঙ্গে দেখেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কখন যে অন্তর্হিত হয়েছিলেন সেইটাই জানতে পারিনি!

ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, অন্তর্ধানের গভীর কারণ ঘটেছিল রামদাসবাবু। এমন কি রাতারাতি এখান থেকেও অন্তর্হিত হ’তে হ’ল।

রামদাস কহিল, সেদিন রেলওয়ে স্টেশনে আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।

ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, জানি। কিন্তু সোজা বাসায় না গিয়ে এত রাত্রে এখানে কেন?

রামদাস কহিল, আপনাকে প্রণাম করতে। পুনার সেন্ট্রাল জেলে আমি যাবার পরেই আপনি চলে গেলেন। তখন সুযোগ পাইনি। নীলকান্ত যোশীর কি হ’ল জানেন? সে ত আপনার সঙ্গেই ছিল।

ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, হাঁ। ব্যারাকের পাঁচিল টপকাতে পারলে না বলে সিঙ্গাপুরে তার ফাঁসি হ’ল।

অপূর্বর কাছে এই সকল অচিন্তনীয়, অত্যদ্ভুত দুঃস্বপ্নের মত বোধ হইতে লাগিল। সে আর থাকিতে না পারিয়া অকস্মাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু, আপনারও কি তাহলে ফাঁসি হতো?

ডাক্তার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিলেন। এই হাসি দেখিয়া অপূর্বর মাথার চুল পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল।

রামদাস উৎসুক হইয়া কহিল, তার পরে?

ডাক্তার বলিলেন, একবার এই সিঙ্গাপুরেই আমাকে বছর-তিনেক আটকে থাকতে হয়েছিল, কর্তৃপক্ষরা আমাকে চেনেন। তাই সোজা রাস্তাটা এড়িয়ে ব্যাঙ্ককের পথে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে টেভয়ে এসে পৌঁছুলাম। জোর কপাল! হঠাৎ বনের মধ্যে একটা হাতির বাচ্চাও ভগবান পাইয়ে দিলেন। সেটা সঙ্গে থাকায় বরাবর ভারী সুবিধে হয়ে গেল। শেষে হাতির বাচ্চা বিক্রি করে দিশি জাহাজে নারকেল চালানের সঙ্গে নিজেকে চালান দিয়ে মাসতিনেকের মধ্যে একেবারে আরাকানে এসে পাড়ি জমালাম। খাসা থাকা গিয়েছিল রামদাসবাবু, হঠাৎ থানার মধ্যে আজ এক পরম বন্ধুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা-সাক্ষাৎ। ভি. এ. চেলিয়া তাঁর নাম, বড্ড স্নেহ করেন আমাকে। বহুদিনের অদর্শনে খুঁজতে খুঁজতে একেবারে সিঙ্গাপুর থেকে বর্মা মুলুকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভাবে বোধ হয় খোঁজ পেয়েছেন। তবে, ভিড়ের মধ্যে তেমন নজর দিতে পারেন নি, নইলে পৈতৃক গলাটার,—এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে গিয়া অকস্মাৎ অপূর্বর মুখের দিকে চাহিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিলেন,—ও কি অপূর্ববাবু? কি হল আপনার?

অপূর্ব দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া আপনাকে সামলাইবার চেষ্টা করিতেছিল, তাঁহার কথা শেষ না হইতেই সে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া সবেগে ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – আঠারো

অপূর্বর এমন করিয়া বাহির হইয়া যাওয়াটা সকলকেই বিস্মিত করিল। ঘরে আলো বেশী ছিল না, কিন্তু তাহার অস্বাভাবিক মুখের ভাব ও অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠস্বর যেন অতিশয় বে-মানান দেখাইল। ব্যারিস্টার কৃষ্ণ আইয়ার ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ইনি কে ডাক্তার? অত্যন্ত সেন্টিমেন্টাল! তাঁহার শেষ কথাটার উপরে স্পষ্ট একটা অভিযোগের খোঁচা ছিল। অর্থাৎ, এ-সকল লোক এখানে কেন?

ডাক্তার শুধু একটুখানি হাসিলেন, কিন্তু তাড়াতাড়ি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন তলওয়ারকর। কহিলেন, ইনি মিস্টার হালদার—অপূর্ব হালদার। এক আফিসে আমরা কাজ করি, আমার সুপিরিয়র অফিসর। একটু থামিয়া সশ্রদ্ধ স্নেহের সহিত বলিলেন, কিন্তু আমার একান্ত অন্তরঙ্গ,—আমার পরম বন্ধু। সেন্টিমেন্টাল? ই—য়েস্‌। ডাক্তারবাবু আপনি বোধ করি হালদারের রেঙ্গুনের প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প শোনেন নি? সে এক—

সহসা ভারতীর প্রতি চোখ পড়িতেই তিনি সলজ্জে থামিয়া গিয়া কহিলেন, সে যাই হোক, প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই কিন্তু আমরা বন্ধু,—বাস্তবিক পরম বন্ধু।

তলওয়ারকরের ব্যগ্রতায় ও বিশেষ করিয়া তাঁহার পরম বন্ধু শব্দটার পুনঃ পুনঃ প্রয়োগে সেন্টিমেন্টালিস্‌মের প্রতি খোঁচা দিতে ব্যারিস্টার সাহেব আর সাহস করিলেন না, কিন্তু তাঁহার মুখের চেহারাটা যেন সন্দিগ্ধ এবং অপ্রসন্ন হইয়া রহিল।

ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, সেন্টিমেন্ট জিনিসটা নিছক মন্দ নয় কৃষ্ণ আইয়ার। এবং সবাই তোমার মত শক্ত পাথর না হলেই চলবে না মনে করাও ঠিক নয়।

কৃষ্ণ আইয়ার খুশী হইলেন না, বলিলেন, তা আমি মনেও করিনে, কিন্তু এটুকু মনে করাও বোধ হয় দোষের নয় ডাক্তার, এই ঘরটা ছাড়াও তাঁদের চলে বেড়াবার যথেষ্ট প্রশস্ত জায়গা পৃথিবীতে খোলা আছে।

তলওয়ারকর মনে মনে ক্রুদ্ধ হইলেন। যাঁহাকে তিনি পরম বন্ধু বলিয়া বারংবার অভিহিত করিতেছেন, তাঁহাকে তাঁহারই সম্মুখে অবাঞ্ছিত প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টায় নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করিয়া কহিলেন, মিস্টার আইয়ার, অপূর্ববাবুকে আমি চিনি। আমাদের মন্ত্রে দীক্ষা তাঁর বেশী দিনের নয় সত্য, কিন্তু বন্ধুর অভাবিত মুক্তিতে সামান্য বিচলিত হওয়া আমাদের পক্ষেও মারাত্মক অপরাধ নয়। সংসারে চলে বেড়াবার স্থান অপূর্ববাবুর যথেষ্টই আছে, এবং আশা করি এ ঘরেও স্থান তাঁর কোনদিন সঙ্কীর্ণ হবে না।

0 Shares