পথের দাবী

নীচের ঘড়িতে টং-টং করিয়া চারিটা বাজিল। সম্মুখের খোলা জানালার বাহিরে রাত্রিশেষের অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া আসিল, সেইদিকে নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া ভারতী স্তব্ধ, স্থির হইয়া বসিয়া কত কি যে ভাবিতে লাগিল তাহার স্থিরতা নাই, কিন্তু একটা সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে এতবড় অভিযোগ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে কিছুতেই তাহার প্রবৃত্তি হইল না।

পরিচ্ছেদ – উনিশ

কাল সারারাত্রি ভারতী ঘুমাইতে পায় নাই। দিনের বেলায় তাহার শরীর ও মন দুই-ই খারাপ ছিল, তাই ইচ্ছা করিয়াছিল, আজ একটু সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া শয্যাগ্রহণ করিবে। এইজন্য সন্ধ্যার প্রাক্কালেই সে রাঁধাবাড়ায় মন দিয়াছিল। এমন সময়ে দলের একজন আসিয়া তাহার হাতে একখানা পত্র দিল। সুমিত্রার লেখা, তিনি একটি ছত্রে শুধু এই বলিয়া আহ্বান করিয়াছেন যে, যে-কোন অবস্থায়, যে-কোন কাজ ফেলিয়া রাখিয়াও সে যেন এই পত্রবাহকের সঙ্গে চলিয়া আসে।

সুমিত্রার আদেশ লঙ্ঘন করিবার জো নাই, কিন্তু ভারতী অত্যন্ত বিস্মিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর কি হঠাৎ কোন অসুখ করেছে? উত্তরে পত্রবাহক জানাইল, না। নীচে নামিয়া দেখিল দরজায় দাঁড়াইয়া তাহাদের অত্যন্ত সুপরিচিত ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি, কিন্তু গাড়োয়ান বদল হইয়াছে। ইহাকে দেখিয়া মনে হয় না গাড়ি চালানো ইহার পেশা। তা ছাড়া গাড়ি কেন? সুমিত্রার বাসায় যাইতে ত মিনিট-তিনেকের অধিক সময় লাগে না। অধিকতর বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, ব্যাপার কি হীরা সিং? সুমিত্রা কোথায়?

এই হীরা সিং লোকটি তাহাদের পথের-দাবীর সভ্য না হইলেও অতিশয় বিশ্বাসী। জাতিতে পাঞ্জাবী শিখ, পূর্বে হংকঙে পুলিশে চাকরি করিত, এখন রেঙ্গুনে টেলিগ্রাফ আফিসে পিয়নের কাজ করে। সে চুপি চুপি কহিল যে, মাইল চার-পাঁচ দূরে অত্যন্ত গোপন এবং অত্যন্ত জরুরি সভা বসিয়াছে, তাঁহার না যাইলেই নয়। ভারতী আর কোন প্রশ্ন না করিয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে গাড়ির সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া যাত্রা করিল। এবং হীরা সিং সরকারী পিয়নের পোশাকে সরকারী দু–চাকার গাড়িতে অন্য পথে প্রস্থান করিল। পথে ভারতীর অনেকবার মনে হইল সে গাড়ি ফিরাইয়া তাহার রিভলভার সঙ্গে লইয়া আসে, কিন্তু দেরি হইবার ভয়ে আর ফিরিতে পারিল না, অস্ত্রহীন অরক্ষিতভাবেই তাহাকে অনিশ্চিত স্থানের উদ্দেশে অগ্রসর হইয়া যাইতে হইল। গাড়ি যে অত্যন্ত ঘুর-পথে চলিয়াছে তাহা ভিতরে থাকিয়াও ভারতী বুঝিল, এবং কিছুক্ষণেই পথের অসমতলতা ও অসংস্কৃত দুরবস্থা অনুভব করিয়া বুঝিতে পারিল তাহারা শহর ছাড়াইয়া গেছে, কিন্তু ঠিক কোথায় তাহা জানা কঠিন। সঙ্গে ঘড়ি ছিল না কিন্তু অনুমান রাত্রি দশটার কাছাকাছি গাড়ি গিয়া একটা বাগানে প্রবেশ করিয়া থামিল। হীরা সিং পূর্বেই পৌঁছিয়াছিল, সে গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল। মাথার উপরে বড় বড় গাছ মিলিয়া অন্ধকার এমনি দুর্ভেদ্য করিয়াছে যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না, নীচে দীর্ঘ ও অত্যন্ত ঘন ঘাসের মধ্যে পায়ে-হাঁটা পথের একটা চিহ্নমাত্র আছে, এই ভয়ানক পথে হীরা সিং তাহার দু-চাকার গাড়ির ক্ষুদ্র লণ্ঠনের আলোকে পথ দেখাইয়া আগে আগে চলিতে লাগিল। পথে চলিতে ভারতীর সহস্রবার মনে হইতে লাগিল—সে ভাল করে নাই, ভাল করে নাই। এই ভীষণ স্থানে আসিয়া সে ভাল করে নাই। অনতিকাল পরে তাহারা একটা জীর্ণ ভগ্ন অট্টালিকায় আসিয়া পৌঁছিল, অন্ধকারে তাহার আভাসমাত্র দেখিয়াই ভারতী বুঝিল ইহা বহুদিন-পরিত্যক্ত একটা চাউঙ্‌। কোন্‌ সুদূর অতীতে বৌদ্ধ-শ্রমণগণ এখানে বাস করিতেন সম্ভবতঃ, কোথাও একটা লোকালয় পর্যন্ত ইহার কাছাকাছি নাই।

এতবড় ভাঙ্গা বাড়ি, এতটুকু আলো নাই, মানুষ নাই, মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত লুপ্ত হইয়াছে—দরজা-জানালা চোরে চুরি করিয়া লইয়া গেছে,—সুমুখের ঘরে ঢুকিতেই বাদুড় ও চামচিকার ভয়ানক গন্ধে ভারতীর দম আটকাইয়া আসিল,—তাহারই মধ্যে দিয়া পথ, বোধ করি কত যে বিষধর সর্প তথায় আশ্রয় লইয়া আছে তাহার ইয়ত্তা নাই।

মস্ত হল-ঘরের এককোণে উপরে উঠিবার সিঁড়ি। কাঠের সিঁড়ির মাঝে মাঝে কাঠ নাই, এই দিয়া ভারতী হীরার হাত ধরিয়া দ্বিতলে উঠিয়া সুমুখের বারান্দা পার হইয়া এতক্ষণে এত দুঃখের পরে নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরের মধ্যে চাটাই পাতা, একধারে গোটা-দুই মোমবাতি জ্বলিতেছে, এবং তাহারই পার্শ্বে সভানেত্রীর আসনে বসিয়া সুমিত্রা। অপর প্রান্তে ডাক্তার বসিয়া ছিলেন, তিনিই সস্নেহ-কণ্ঠে ডাকিয়া কহিলেন, এস ভারতী, আমার কাছে এসে ব’স।

অজানা শঙ্কায় ভারতীর বুকের মধ্যে গুরগুর করিয়া উঠিল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, কিন্তু একটুখানি যেন দ্রুতপদেই সে কাছে গিয়া ডাক্তারের বুক ঘেঁষিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার কাঁধের উপর বাঁ হাতখানি রাখিয়া যেন তিনি নিঃশব্দে তাহাকে ভরসা দিলেন। হীরা সিং ঘরে ঢুকিল না; দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল, যাহারা বসিয়া আছে পাঁচ-ছয়জনকে সে একেবারেই চেনে না। পরিচিতের মধ্যে ডাক্তার ও সুমিত্রা ব্যতীত রামদাস তলওয়ারকর ও কৃষ্ণ আইয়ার। একজন ভীষণাকৃতি লোককে সর্বাগ্রেই চোখে পড়ে—পরনে তাহার গেরুয়া রঙের আলখাল্লা এবং মাথায় সুবৃহৎ পাগড়ি। মুখখানা বড় হাঁড়ির মত গোলাকার এবং দেহ গণ্ডারের মত স্থূল, মাংসল ও কর্কশ। ভাঁটার মত চোখের উপর ভ্রূর চিহ্নমাত্র নাই, কঠিন শলার মত গোঁফের রোম বোধ করি দূর হইতে গণিয়া বলা যায়, রঙ তামার মত, লোকটা যে অনার্য মোঙ্গল-জাতীয় দৃষ্টিপাতমাত্র তাহাতে সংশয় থাকে না। এই বীভৎস ভয়ানক লোকটার প্রতি ভারতী চোখ তুলিয়া চাহিতেই পারিল না। মিনিট-দুই সমস্ত ঘরটা একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল, তখন সুমিত্রা ডাকিয়া কহিলেন, ভারতী, তোমার মনের ভাব আমি জানি, তাই তোমাকে ডেকে এনে দুঃখ দেবার আমার ইচ্ছাই ছিল না, কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই হতে দিলেন না। অপূর্ববাবু কি করেছেন জানো?

ভারতীর নিভৃত হৃদয়ে এমনিই কি যেন একটা তাহাকে সারাদিন ধরিয়া বলিতেছিল। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, শুধু সে নীরবে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

সুমিত্রা কহিলেন, বোথা কোম্পানী রামদাসকে আজ ডিস্‌মিস্‌ করেছে। অপূর্বরও সেই দশা হতো শুধু পুলিশ কমিশনারের কাছে আমাদের সমস্ত কথা অকপটে ব্যক্ত করেই তাঁর চাকরিটা বেঁচেছে। মাইনে ত কম নয়, বোধ হয় পাঁচ শ।

রামদাস ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

সুমিত্রা কহিলেন, শুধু এই নয়। পথের-দাবী যে বিদ্রোহীর দল, এবং আমরা যে লুকিয়ে পিস্তল রিভলভার রাখি সে সংবাদও তিনি গোপন করেন নি। এর শাস্তি কি ভারতী?

সেই ভীষণাকৃতি লোকটা গর্জন করিয়া উঠিল, ডেথ্‌!

এতক্ষণে ভারতী নির্নিমেষ দুই চক্ষু তাহার মুখের প্রতি তুলিয়া স্থির হইয়া রহিল।

রামদাস কহিল, সব্যসাচীই যে ডাক্তার এ খবর তারা জানে। হোটেলের ঘরের মধ্যেই তাঁকে ধরা যেতে পারে অপূর্ববাবু এ কথা জানাতেও ত্রুটি করেন নি। এমন কি, আমি ইতিপূর্বে যে পোলিটিক্যাল অপরাধে বছর-দুই জেল খেটেছি,—তাও।

0 Shares