পথের দাবী

না।

তাঁহার মুখের এই সংশয়লেশহীন অকুণ্ঠিত উওর শুনিয়া ভারতী হতবুদ্ধি হইয়া গেল, কিন্তু এই ভয়ঙ্কর ‘না’ সে সত্যই সহ্য করিতে পারিল না। ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ছাড়া আর পথ নেই, এমন কিন্তু হতেই পারে না দাদা।

ডাক্তার মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, না, পথ আছে বৈ কি! আপনাকে ভোলাবার অনেক রাস্তা খোলা আছে, ভারতী, কিন্তু সত্যে পৌঁছাবার আর দ্বিতীয় পথ নেই।

ভারতী স্বীকার করিতে পারিল না। শান্ত, মৃদুকণ্ঠে কহিল, দাদা, তুমি অশেষ জ্ঞানী। এই একটিমাত্র লক্ষ্য স্থির রেখে তুমি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েচ, তোমার অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। তোমার মত এতবড় মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি। আমার মনে হয়, কেবল তোমার সেবা করেই আমি সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। তোমার সঙ্গে তর্ক সাজে না, কিন্তু বল, আমার অপরাধ নেবে না?

ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, কি বিপদ! অপরাধ নেব কিসের জন্যে?

ভারতী তেমনি স্নিগ্ধ সবিনয়ে কহিতে লাগিল, আমি ক্রীশ্চান, শিশুকাল থেকে ইংরাজকেই আত্মীয় জেনে, বন্ধু জেনে বড় হয়ে উঠেছি, আজ তাদের প্রতি মন ঘৃণায় পূর্ণ করে তুলতে আমার ভারী কষ্ট হয়। কিন্তু তুমি ছাড়া এ কথা আমি কারও সুমুখে বলতে পারিনে। অথচ, তোমাদের মতই আমি ভারতবর্ষের,—বাঙলা দেশের মেয়ে। আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না।

তাহার কথা শুনিয়া ডাক্তার আশ্চর্য হইলেন।

সস্নেহে ডান হাতখানি তাহার মাথার উপরে রাখিয়া কহিলেন, এ আশঙ্কা কেন ভারতী? তুমি ত জানো তোমাকে আমি কত স্নেহ, কত বিশ্বাস করি।

ভারতী বলিল, জানি। আর তুমিও কি আমার ঠিক এই কথাই জান না দাদা? তোমার ভয় নেই, ভয় তোমাকে দেখানো যায় না, শুধু সেইজন্যেই কেবল তোমাকে বলতে পারিনি, এ বাড়িতে আর তুমি এসো না। কিন্তু এও জানি, আজকে রাত্রির পরে আর কখনো,—না না, তা নয়, হয়ত, অনেকদিন আর দেখা হবে না। সেদিন যখন তুমি সমস্ত ইংরাজ জাতির বিরুদ্ধে ভীষণ অভিযোগ করলে তখন প্রতিবাদ আমি করিনি, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে নিরন্তর এই প্রার্থনাই করেচি, এতবড় বিদ্বেষ যেন না তোমার অন্তরের সমস্ত সত্য আচ্ছন্ন করে রাখে। দাদা, তবুও আমি তোমাদেরই।

ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, হাঁ আমি জানি, তুমি আমাদেরই।

তা হলে এ পথ তুমি ছাড়।

ডাক্তার চমকিয়া উঠিলেন, কোন্‌ পথ?

বিপ্লবীদের এই নির্মম পথ।

কেন ছাড়তে বল?

ভারতী কহিল, তোমাকে মরতে দিতে আমি পারব না। সুমিত্রা পারে, কিন্তু আমি পারিনে। ভারতের মুক্তি আমরা চাই—অকপটে, অসঙ্কোচে, মুক্তকণ্ঠে চাই। দুর্বল, পীড়িত, ক্ষুধিত ভারতবাসীর অন্নবস্ত্র চাই। মনুষ্য-জন্ম নিয়ে মানুষের একমাত্র কাম্য স্বাধীনতার আনন্দ উপলব্ধি করতে চাই। ভগবানের এতবড় সত্যে উপস্থিত হবার এই নিষ্ঠুর পথ ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই এ আমি কোন মতেই ভাবতে পারিনে। পৃথিবী ঘুরে তুমি শুধু এই পথের খবরটাই জেনে এসেছ, সৃষ্টির দিন থেকে স্বাধীনতার তীর্থযাত্রী শত-সহস্র লোকের পায়ে পায়ে এই পথের চিহ্নটাই হয়ত তোমার চোখে স্পষ্ট হয়ে পড়েচে, কিন্তু বিশ্বমানবের একান্ত শুভবুদ্ধি, তার অনন্ত বুদ্ধির ধারা কি এমনিই নিঃশেষ হয়ে গেছে যে এই রক্তরেখা ছাড়া আর কোন পথের সন্ধানই কোন দিন তার চোখে পড়বে না? এমন বিধান কিছুতেই সত্য হতে পারে না। দাদা, মনুষ্যত্বের এতবড় পরিপূর্ণতা তুমি ছাড়া আর কোথাও আমি দেখিনি,—নিষ্ঠুরতার এই বারংবার চলা-পথে তুমি আর চলো না। দুয়ার হয়ত আজও রুদ্ধ আছে, তাই তুমি আমাদের জন্যে খুলে দাও—এ জগতের সবাইকে ভালবেসে আমরা তোমাকে অনুসরণ করে চলি।

ডাক্তার ম্লানমুখে একটুখানি হাসিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর ভারতীর মাথার পরে হাত রাখিয়া বার-দুই ধীরে ধীরে চাপড়াইয়া কহিলেন, আমার আর সময় নেই ভাই, আমি চললাম।

কোন উত্তর দিয়ে গেলে না, দাদা?

প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু কহিলেন, ভগবান যেন তোমার ভাল করেন।—এই বলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গেলেন।

পরিচ্ছেদ – বাইশ

জলপথে শত্রুপক্ষীয় জাহাজের গতিরোধ করিবার উদ্দেশ্যে নদীর ধারে, শহরের শেষ প্রান্তে একটি ছোটরকমের মাটির কেল্লা আছে, এখানে সিপাহি-সান্ত্রী অধিক থাকে না, শুধু ব্যাটারি চালনা করিবার জন্য কিছু গোরা-গোলন্দাজ ব্যারাকে বাস করে। ইংরেজের এই নির্বিঘ্ন শান্তির দিনে বিশেষ কড়াকড়ি এখানে ছিল না। নিষেধ আছে, অন্যমনস্ক পথিক কেহ তাহার সীমানার মধ্যে গিয়া পড়িলে তাড়া করিয়াও আসে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ইহারই একধারে গাছপালার মধ্যে পাথরে বাঁধানো একটা ঘাটের মত আছে, হয়ত কোন উচ্চ রাজকর্মচারীর আগমন উপলক্ষে ইহার সৃষ্টি হইয়া থাকিবে, কিন্তু এখন ইহার কাজও নাই, প্রয়োজনও নাই। ভারতী মাঝে মাঝে একাকী আসিয়া এখানে বসিত। কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার যাহাদের প্রতি ছিল তাহাদের কেহ যে দেখে নাই তাহা নহে, সম্ভবত স্ত্রীলোক বলিয়া, এবং ভদ্র স্ত্রীলোক বলিয়াই তাহারা আপত্তি করিত না। বোধ করি এইমাত্র সূর্যাস্ত হইয়া থাকিবে, কিন্তু অন্ধকার হইতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। নদীর কতক অংশে, এবং পরপারবর্তী গাছপালার উপরে শেষ স্বর্ণাভা ছড়াইয়া পড়িয়াছে; দলে দলে পাখির সারি এদিক হইতে ওদিকে উড়িয়া চলিয়াছে,—কাকের কালো দেহে, বকের সাদা পালকে, ঘুঘুর বিচিত্র পাণ্ডুর সর্বাঙ্গে আকাশের রাঙ্গা আলো মিশিয়া হঠাৎ যেন তাহাদিগকে কোন্‌ অজানা দেশের জীব করিয়া তুলিয়াছে। তাহাদের অবাধ স্বচ্ছন্দ গতি অনুসরণ করিয়া ভারতী নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিল। কি জানি, কোথায় ইহাদের বাসা, কিন্তু সে অলক্ষ্য আকর্ষণ কাহারও এড়াইয়া যাইবার জো নাই। এই কথা মনে করিয়া দুই চক্ষু তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া চাহিয়া দেখিল, দূর বৃক্ষশ্রেণীর সোনার দীপ্তি নিবিয়া আসিতেছে এবং মাথার উপরে গাছপালা নদীতে দীর্ঘতর ছায়াপাত করিয়া জল কালো করিয়া আনিয়াছে এবং তাহারই মধ্যে হইতে অন্ধকার যেন সুদীর্ঘ জিহ্বা মেলিয়া সম্মুখের সমস্ত আলোক নিঃশব্দে লেহন করিয়া লইতেছে।

সহসা নদীর ডানদিকের বাঁক হইতে একখানি ক্ষুদ্র শাম্পান নৌকা সুমুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। নৌকায় মাঝি ভিন্ন অন্য আরোহী ছিল না। সে চট্টগ্রামী মুসলমান। ক্ষণকাল ভারতীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার চট্টগ্রামের দুর্বোধ্য মুসলমানী বাংলায় কহিল, আম্মা, ওপারে যাবে? একআনা পয়সা দিলেই পার করে দিই।

ভারতী হাত নাড়িয়া কহিল, না, ওপারে আমি যাবো না।

মাঝি বলিল, আচ্ছা দুটো পয়সা দাও, চল।

ভারতী কহিল, না বাপ্‌ তুমি যাও। বাড়ি আমার এপারে, ওপারে যাবার আমার দরকার নেই।

মাঝি গেল না, একটু হাসিয়া কহিল, পয়সা না হয় নাই দেবে, চল তোমাকে একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি। এই বলিয়া সে ঘাটের একধারে নৌকা ভিড়াইতে উদ্যত হইল। ভারতী ভয় পাইল। গাছপালার মধ্যে স্থানটা অন্ধকার এবং নির্জন। দীর্ঘদিন এদেশে থাকার জন্য ইহাদের ভাষা বলিতে না পারিলেও ভারতী বুঝিত। এবং ইহাও জানিত, চট্টগ্রামের এই মুসলমান মাঝি-সম্প্রদায় অতিশয় দুর্বৃত্ত। তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, তুমি যাও বলচি এখান থেকে, নইলে পুলিশ ডাকবো।

0 Shares