তাহার উচ্চকণ্ঠ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে বোধ হয় চট্টগ্রামী মুসলমান এবার ভয় পাইয়া থামিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল লোকটার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পার হইয়াছে, কিন্তু শখ যায় নাই। পরনে লতাপাতা-ফুল-কাটা লুঙ্গি, কিন্তু তেলে ও ময়লায় অত্যন্ত মলিন। গায়ে মূল্যবান মিলিটারি ফ্রক-কোট, জরির পাড়, কিন্তু যেমন নোংরা তেমনি জীর্ণ। বোধ হয় কোন পুরাতন জামা-কাপড়ের দোকান হইতে কেনা। মাথায় বেলদার ন্যাকড়ার টুপি, কপাল পর্যন্ত টানা। এই মূর্তির প্রতি রোষদৃপ্তচক্ষে চাহিয়া ভারতী কয়েক মুহূর্ত পরেই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, দাদা, চেহারা যাই হোক, কিন্তু গলার আওয়াজটাকে পর্যন্ত বদলে মুসলমান করে ফেলেচ!
মাঝি কহিল, যাবো, না পুলিশ ডাকবে?
ভারতী বলিল, পুলিশ ডেকে তোমাকে ধরিয়ে দেওয়াই উচিত। অপূর্ববাবুর ইচ্ছেটা আর অপূর্ণ রাখি কেন!
মাঝি কহিল, তার কথাই বলচি! এসো। জোয়ার আর বেশী নেই, এখনো কোশ-দুই যেতে হবে।
ভারতী নৌকায় উঠিলে, ঠেলিয়া দিয়া ডাক্তার পাকা মাঝির মতই দ্রুতবেগে অগ্রসর হইলেন। যেন দুইহাতে দুখানা দাঁড় টানাই তাঁহার পেশা। কহিলেন, লামা জাহাজ চলে গেল দেখলে?
ভারতী কহিল, হাঁ।
ডাক্তার কহিলেন, অপূর্ব এই দিকের ফার্স্ট ক্লাস ডেকে দাঁড়িয়েছিল দেখতে পেলে?
ভারতী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না।
ডাক্তার কহিলেন, তার বাসায় কিংবা আফিসে আমার যাবার জো ছিল না, তাই জেটির একধারে শাম্পান বেঁধে আমি ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হাত তুলে সেলাম করতেই—
ভারতী ব্যাকুল হইয়া কহিল, কার জন্যে কিসের জন্যে এতবড় ভয়ানক কাজ তুমি করতে গেলে দাদা? প্রাণটা কি তোমার একেবারেই ছেলেখেলা?
ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, একেবারেই না। আর গেলাম কিসের জন্যে? ঠিক সেই জন্যেই, যে জন্যে তুমি চুপটি করে এখানে একলা বসে আছো, বোন।
ভারতী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন কিছুতেই চাপিতে পারিল না। কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, কখখনো না। এখানে আমি এমনি এসেছি—প্রায় আসি। কারও জন্যে আমি কখখনো আসিনি। তোমাকে চিনতে পারলেন?
ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, না, একেবারেই না। এ বিদ্যে আমার খুব ভাল করেই শেখা,—এ দাড়ি-গোঁফ ধরা সহজ কর্ম নয়, কিন্তু আমার ভারী ইচ্ছে ছিল অপূর্ববাবু যেন আমাকে চিনতে পারেন। কিন্তু এত ব্যস্ত যে তার সময় ছিল কৈ?
ভারতী নীরবে চাহিয়া ছিল, সেই অত্যন্ত উৎসুক মুখের প্রতি চাহিয়া ক্ষণকালের জন্য ডাক্তার নির্বাক হইয়া গেলেন।
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তার পরে কি হল?
ডাক্তার বলিলেন, বিশেষ কিছুই না।
ভারতী চেষ্টা করিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিল, বিশেষ কিছু যে হয়নি সে শুধু আমার ভাগ্য। চিনতে পারলেই তোমাকে ধরিয়ে দিতেন, আর সে অপমান এড়াবার জন্যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হতো। চাকরি যাক, কিন্তু প্রাণটা বাঁচলো! এই বলিয়া সে দূর পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া নিঃশ্বাস মোচন করিল।
ডাক্তার নীরবে নৌকা বাহিয়া চলিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া ভারতী সহসা মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, কি ভাবচ দাদা?
বল ত দেখি?
বলব? তুমি ভাবচো এই ভারতী মেয়েটা আমার চেয়ে ঢের বেশী মানুষ চিনতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোন শিক্ষিত লোকই যে এতবড় হীনতা স্বীকার করতে পারে,—লজ্জা নেই, কৃতজ্ঞতা নেই, মায়া-দয়া নেই,—খবর দিলে না, খবর নেবার এতটুকু চেষ্টা করলে না,—ভয়ের তাড়নায় একেবারে জন্তুর মত ছুটে পালিয়ে গেল, এ কথা আমি কল্পনা করতেও পারিনি, কিন্তু ভারতী একেবারে নিঃসংশয়ে জেনেছিল! ঠিক এই না? সত্যি বোলো?
ডাক্তার ঘাড় ফিরাইয়া নিরুত্তরে দাঁড় টানিয়া চলিতে লাগিলেন, কিছুই বলিলেন না।
আমার দিকে একবার চাও না, দাদা।
ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া চাহিতেই ভারতীর দুই ঠোঁট থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, কহিল, মানুষ হয়ে মনুষ্য-জন্মের কোথাও কোন বালাই নেই এমন কি করে হয় দাদা? এই বলিয়া সে দাঁত দিয়া জোর করিয়া তাহার ওষ্ঠাধরের কম্পন নিবারণ করিল, কিন্তু দুই চোখের কোণ বাহিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
ডাক্তার সায় দিলেন না, প্রতিবাদ করিলেন না, সান্ত্বনার একটি বাক্যও তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। কেবল পলকের জন্য যেন মনে হইল তাঁহার সুর্মাটানা চোখের দীপ্তি ঈষৎ স্তিমিত হইয়া আসিল।
ইরাবতীর এই ক্ষুদ্র শাখানদী অগভীর ও অপ্রশস্ত বলিয়া স্টীমার বা বড় নৌকা সচরাচর চলিত না। জেলেদের মাছ ধরার পানসি কিনারায় বাঁধা মাঝে মাঝে দেখা গেল, কিন্তু লোকজন কেহ ছিল না। মাথার উপরে তারা দেখা দিয়াছে, নদীর জল কালো হইয়া উঠিয়াছে, নির্জন ও পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার মধ্যে ডাক্তারের সতর্কচালিত দাঁড়ের সামান্য একটুখানি শব্দ ভিন্ন আর কোন শব্দ কোথাও ছিল না। উভয় তীরের বৃক্ষশ্রেণী যেন সম্মুখে এক হইয়া মিশিয়াছে। তাহারই ঘনবিন্যস্ত শাখা-পল্লবের অন্ধকার-অভ্যন্তরে সজল দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ভারতী নীরবে স্থির হইয়া বসিয়া ছিল। তাহাদের শাম্পান যে কোন্ ঠিকানায় চলিয়াছিল ভারতী জানিত না, জানিবার মত উৎসুক সচেতন মনের অবস্থাও তাহার ছিল না, কিন্তু সহসা প্রকাণ্ড একটা গাছের অন্তরালে গুল্ম-লতা-পাতা-সমাচ্ছন্ন অতি সঙ্কীর্ণ খাদের মধ্যে তাহাদের ক্ষুদ্র তরী প্রবেশ করিল দেখিয়া সে চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্চো?
ডাক্তার কহিলেন, আমার বাসায়।
সেখানে আর কে থাকে?
কেউ না।
কখন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে?
পৌঁছে দেব? আজ রাত্রির মধ্যে যদি না দিতে পারি কাল সকালে যেয়ো।
ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, না দাদা, সে হবে না। তুমি আমাকে যেখান থেকে এনেছ সেখানে ফিরে রেখে এস।
কিন্তু আমার যে অনেক কথা আছে ভারতী !
ভারতী ইহার জবাব দিল না, তেমনি মাথা নাড়িয়া আপত্তি জানাইয়া বলিল, না, তুমি আমাকে ফিরে রেখে এস।
কিন্তু কিসের জন্য ভারতী? আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয় না?
ভারতী অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া রহিল।
ডাক্তার কহিলেন, এমন কত রাত্রি ত তুমি একাকী অপূর্বর সঙ্গে কাটিয়েছ, সে কি আমার চেয়েও তোমার বেশী বিশ্বাসের পাত্র?
ভারতী তেমনি নির্বাক হইয়াই রহিল, হাঁ না কোন কথাই কহিল না। খালের এই স্থানটা যেমন অন্ধকার তেমনি অপ্রশস্ত। দু’ধারের গাছের ডাল মাঝে মাঝে তাহার গায়ে আসিয়া ঠেকিতে লাগিল। এদিকে নদীতে ভাটার উলটা টান শুরু হইয়া গেছে,—ডাক্তার খোলের মধ্যে হইতে লন্ঠন বাহির করিয়া জ্বালিয়া সম্মুখে রাখিলেন, এবং দাঁড় রাখিয়া দিয়া একটা সরু বাঁশ হাতে লইয়া ঠেলিতে ঠেলিতে বলিলেন, আজ যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্চি ভারতী, দুনিয়ার কেউ নেই সেখান থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু আমার মনের কথা বুঝতে বোধ হয় তোমার আর বাকী নেই? এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া যেন জোর করিয়া হাসিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার মুখের চেহারা ভারতী দেখিতে পাইল না, কিন্তু তাঁহার হাসির স্বরে কে যেন অকস্মাৎ তাহার ভিতর হইতে তাহাকে ধিক্কার দিয়া উঠিল। মুখ তুলিয়া নিঃশঙ্ককণ্ঠে কহিল, তোমার মনের কথা বুঝতে পারি এত বুদ্ধি আমার নেই। কিন্তু, তোমার চরিত্রকে আমি চিনি। একলা থাকা আমার উচিত নয় বলেই ও-কথা বলেচি দাদা, আমাকে তুমি ক্ষমা কর।