পথের দাবী

দু’জনে সিঁড়ি বাহিয়া নিঃশব্দে উপরে উঠতেই খোলা দরজার সম্মুখে প্রথমেই চোখে পড়িল,—শশী মন দিয়া কি একখানা কাগজ পড়িতেছে। ভারতী আনন্দিত কলকণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল, শশীবাবু, এই যে আমরা এসে পড়েছি,—খাবার বন্দোবস্ত করুন, নবতারা কৈ? নবতারা! নবতারা!

শশী মুখ তুলিয়া চাহিল, কহিল, আসুন। নবতারা এখানে নেই।

ডাক্তার স্মিতমুখে কহিলেন, গৃহিণীশূন্য গৃহ কিরকম কবি? ডাকো তাকে, আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাক, নইলে দাঁড়িয়ে থাকবো। হয়ত খাবোও না।

শশী বিষণ্ণমুখে বলিল, নবতারা এখানে নেই ডাক্তার। তারা সব বেড়াতে গেছে।

সহসা তাহার মুখের চেহারায় ভীত হইয়া ভারতী প্রশ্ন করিল, কোথায় বেড়াতে গেলো? আজকের দিনে? কি চমৎকার বিবেচনা!

শশী বলিল, তারা বিয়ের পরে রেঙ্গুনে বেড়াতে গেছে। না না, আমার সঙ্গে নয়,—সেই যে আহমেদ,—ফর্সা মতন,—চমৎকার দেখতে,—কুট সাহেবের মিলের টাইম-কিপার,—দেখেছেন না? আজ দুপুরবেলা তারই সঙ্গে নবতারার বিয়ে হয়েছে। সমস্তই তাদের ঠিক ছিল—আমাকে বলেনি।

আগন্তুক দুইজনে বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন,—বল কি শশী?

শশী উঠিয়া গিয়া ঘরের একটা নিভৃত স্থান হইতে একটা ন্যাকড়ার থলি আনিয়া ডাক্তারের পায়ের কাছে রাখিয়া দিয়া কহিল, টাকা পেয়েছি ডাক্তার। নবতারাকে পাঁচ হাজার দেব বলেছিলাম, দিয়ে দিয়েছি। বাকী আছে সাড়ে চার হাজার, পঞ্চাশ টাকা আমি নিলাম, কিন্তু—

ডাক্তার কহিলেন, এই টাকা কি আমাকে দিচ্চ?

শশী কহিল, হাঁ। আমার আর কি হবে? আপনি নিন। কাজে লাগবে।

ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু তাকে কবে টাকা দিলেন?

শশী কহিল, কাল টাকা পেয়েই তাকে দিয়ে এসেছি।

নিলে?

শশী মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ। আমেদ ত মোটে ত্রিশটি টাকা মাইনে পায়। তারা একটা বাড়ি কিনবে।

নিশ্চয়ই কিনবে! এই বলিয়া ডাক্তার সহাস্যে ফিরিয়া দেখিলেন, চোখে আঁচল দিয়া ভারতী বারান্দার একদিকে নিঃশব্দে সরিয়া যাইতেছে।

শশী কহিল, প্রেসিডেন্ট আপনাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। তিনি সুরাবায়ায় চলে যাচ্চেন।

ডাক্তার বিস্ময়ে প্রকাশ করিলেন না, তবু প্রশ্ন করিলেন, কবে যাবেন?

শশী কহিল, বললেন ত শীঘ্রই। তাঁকে লোক এসেছে নিতে।

কথা ভারতীর কানে গেল, সে ফিরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সুমিত্রাদিদি কি সত্যিই চলে যাবেন বলেছেন শশীবাবু?

শশী বলিল, হাঁ সত্যি। তাঁর মায়ের খুড়োর অগাধ সম্পত্তি। সম্প্রতি মারা গেছেন,— ইনি ছাড়া উত্তরাধিকারী আর কেউ নেই। তাঁর না গেলেই নয়।

ডাক্তার কহিলেন, না গেলেই যখন নয়, তখন যাবেন বৈ কি।

শশী ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, অনেক খাবার আছে, খাবেন কিছু? কিন্তু ভারতীর ইতস্ততঃ করিবার পূর্বেই ডাক্তার সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়,— চল, কি আছে দেখি গে। এই বলিয়া তিনি শশীর হাত ধরিয়া একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতরে টানিয়া লইয়া গেলেন। যাবার পথে শশী আস্তে আস্তে বলিল, আর একটা খবর আছে ডাক্তার, অপূর্ববাবু ফিরে এসেছেন।

ডাক্তার বিস্ময়ে থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, সে কি শশি, কে বললে তোমাকে?

শশী কহিল, কাল বেঙ্গল ব্যাঙ্কে একেবারে মুখোমুখি দেখা। তাঁর মা নাকি বড় পীড়িত।

পরিচ্ছেদ – সাতাইশ

শশী অতিশয়োক্তি করে নাই। ভিতরে প্রবেশ করিয়াই দেখা গেল খাদ্যবস্তুর অত্যন্ত বাহুল্যে ঘরের দক্ষিণ ধারটা একেবারে ভারাক্রান্ত হইয়া রহিয়াছে। ছোট-বড় ডেকচি, প্লেট, কাগজের ঠোঙা, মাটির বাসন পরিপূর্ণ করিয়া নানাবিধ আহার্য-দ্রব্যসম্ভার দোকানদার ও হোটেলওয়ালার দল নিজেদের রুচি ও মর্জি মত ওপার হইতে এপারে অবিশ্রাম সরবরাহ করিয়া স্তূপাকার করিয়াছে,— অভাব বা ত্রুটি কিছুরই ঘটে নাই, ঘটিয়াছে কেবল সেগুলি উদরসাৎ করিবার লোকের। ডাক্তার ক্ষণকালমাত্র নিরীক্ষণ করিয়াই সোল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, তোফা! তোফা! চমৎকার! শশী কি হিসেবী লোক দেখেচ ভারতী, কে কি খাবে না-খাবে সমস্ত চিন্তা করে দেখেচে! বহুৎ আচ্ছা!

ভারতী অন্য দিকে চাহিয়া রহিল, এবং শশী হাসিবার একটুখানি বিফল চেষ্টা করিল মাত্র। কোন দিক হইতে কোন সাড়া না পাইয়াও ডাক্তারের উল্লাস অকস্মাৎ অট্টহাস্যে ফাটিয়া পড়িল, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! গৃহস্থের জয়জয়কার হোক,— শশি! কবি! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

ভারতী আর সহিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া সজলচক্ষে রুষ্ট দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, তোমার মনের মধ্যে কি একটু দয়ামায়াও নেই দাদা? কি করচ বলত?

বাঃ! যাদের কল্যাণে আজ ভাল ভাল জিনিস পেট পুরে খাবো,— তাদের একটু আশীর্বাদ— বাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

ভারতী রাগ করিয়া বারান্দায় চলিয়া গেল। মিনিট দুই-তিন পরে শশী গিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিলে সে প্লেটে করিয়া মাংস, পোলাও, ফলমূল, মিষ্টান্নাদি সযত্নে সাজাইয়া ডাক্তারের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া কৃত্রিম কুপিতস্বরে কহিল, নাও, এবার দশহাত বার করে রাক্ষসের মত খাও। হাসি বন্ধ হোক, পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

ডাক্তার নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আহা! উপাদেয় খাদ্য! এর স্বাদ-গন্ধও ভুলে গেছি।

কথাটা ভারতীর বুকে গিয়া বিঁধিল। তাহার সে রাত্রের শুকনা ভাত ও পোড়া-মাছের কথা মনে পড়িল।

ডাক্তার আহারে নিযুক্ত হইয়া কহিলেন, কবিকে দিলে না ভারতী?

এই যে দিচ্চি, এই বলিয়া সে প্লেট সাজাইয়া আনিয়া শশীর কাছে রাখিয়া দিয়া ডাক্তারের সম্মুখে বসিয়া বলিল, কিন্তু সমস্ত খেতে হবে দাদা, ফেলতে পারবে না।

নাঃ—কিন্তু, তুমি খাবে না?

আমি? কোন মেয়েমানুষ এ-সব খেতে পারে? তুমিই বল?

কিন্তু রেঁধেছে যেন অমৃত।

ভারতী কহিল, এর চেয়ে ভাল অমৃত রেঁধে আমি রোজ রোজ তোমাকে খাওয়াতে পারি দাদা।

ডাক্তার বাঁ হাতটা নিজের কপালে ঠেকাইয়া কহিলেন, কি করবে দিদি, অদৃষ্ট! যাকে খাওয়াবার কথা, সে এ-সব খাবে না, যে খাবে তাকে একদিনের ওপর দু’দিন খাওয়াবার চেষ্টা করলেই সুখ্যাতিতে তোমার দেশ ভরে যাবে। ভগবানের এমনি উলটো বিচার! কি বল কবি, ঠিক না? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

এবার ভারতী নিজেও হাসিয়া ফেলিল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনাকে সংবরণ করিয়া লজ্জিত হইয়া বলিল, তোমার দুষ্টুমির জ্বালায় না হেসে পারা যায় না, কিন্তু এ তোমার ভারী অন্যায়। তার পর পেট পুরে খেয়ে-দেয়ে টাকার থলিটিও নিয়ে চলে যাবে নাকি?

ডাক্তার মুখের গ্রাস গিলিয়া লইয়া কহিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়,—অর্ধেকটা ত গেছে নবতারার বাড়ি তৈরির খাতায়, বাকীটা কি রেখে যাবো আহমেদ-আবদুল্লা সাহেবের গাড়ি-জুড়ি কিনতে? তামাশা সর্বাঙ্গসুন্দর করতে নেহাত মন্দ পরামর্শ দাওনি ভারতী। কি বল শশী? হাঃ হাঃ হাঃ—

ভারতী বলিল, দাদা, তোমাকে হাসি-ঠাট্টা করতে আগেও দেখেছি বটে, কিন্তু, এমন ক্ষ্যাপার মত হাসতে আর কখনো দেখিনি।

ডাক্তার জবাব দিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না। ভারতী পুনশ্চ কহিল, নর-নারীর ভালবাসা কি তোমারই মত সকলের উপহাসের বস্তু যে, তাসের ছক্কা-পঞ্জা হারার মত এর হার-জিতে অট্টহাসি করা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই? স্বাধীনতা পরাধীনতা ছাড়া মানুষের ব্যথা পাবার কি দুনিয়ায় কিছুই তুমি ভাবতে পারবে না? দেখ ত একবার শশীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে। একটা বেলার মধ্যে উনি কি হয়ে গেছেন! অপূর্ববাবু যখন চলে গেলেন, সেদিন আমাকে উপলক্ষ করেও হয়ত তুমি এমনি করেই হেসেছ।

0 Shares