পথের দাবী

না, না, সে হল—

ভারতী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না না বলছ কিসের জন্যে দাদা? শশীবাবু তোমার স্নেহের পাত্র, তুমি এই ভেবেই খুশী হয়ে উঠেছ যে, নির্বোধ তাঁকে ফাঁদের মধ্যে ফেলে নবতারা অনেক দুঃখ দিত। ভবিষ্যতের সেই দুঃখের হাত থেকে তিনি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎই কি মানুষের সব? আজকের এই একটিমাত্র দিন যে ব্যথার ভারে তাঁর সমস্ত ভবিষ্যৎকে ডিঙিয়ে গেল এ তুমি কি করে জানবে বল? তুমি ত কখনো ভালোবাসো নি!

শশী অতিশয় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। সে কোনমতে বলিতে চাহিল যে তাহারই অন্যায়, তাহারই ভুল, সাংসারিক সাধারণ বুদ্ধি না থাকার জন্যই—

ভারতী ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, লজ্জা কিসের শশীবাবু? এ ভুল কি সংসারে একা আপনিই করেছেন? আপনার শতগুণ ভুল আমি করিনি? তারও সহস্রগুণ বেশী ভুল করে যে দুর্ভাগিনী নিঃশব্দে এ দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে উদ্যত হয়েছে, তাকে কি ডাক্তার চেনেন না? নবতারা ঠকিয়েছে? ঠকাক্‌ না। তবু ত আমাদেরই বঞ্চনার গান গেয়ে জগতের অর্ধেক কাব্য অমর হয়ে আছে।

ডাক্তার বিস্মিতচক্ষে তাহার প্রতি চাহিলেন, কিন্তু ভারতী গ্রাহ্য করিল না। বলিতে লাগিল, শশীবাবু, সাংসারিক বুদ্ধি আপনার কম? কিন্তু আমার ত কম ছিল না? সুমিত্রাদিদির বুদ্ধির তুলনাই হয় না। অথচ, কিছুই ত কারও কাজে লাগেনি। এ শুধু পরাভূত হল, দাদা, তোমার বুদ্ধির কাছে। যে চিরদিন অজেয়, পথ যার কখনো বাধা পায়নি, সেও তোমারই পাষাণ-দ্বারে কেবল আছাড় খেয়ে খানখান হয়ে পড়ে গেল,—প্রবেশ করবার এতটুকু পথ পেলে না!

ডাক্তার এ অভিযোগের উত্তর দিলেন না, শুধু তাহার মুখপানে চাহিয়া একটুখানি হাসিলেন। ভারতী বলিল, শশীবাবু, আমি আপনার প্রতি মহা অপরাধ করেছি, আজ তার ক্ষমা চাই—

শশী বুঝিতে পারিল না, কিন্তু কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। ভারতী নিমেষমাত্র মৌন থাকিয়া বলিতে লাগিল, একদিন দাদার কাছে বলেছিলাম, কোন মেয়েমানুষেই কোনদিন আপনাকে ভালবাসতে পারে না। সেদিন আপনাকে আমি চিনিনি। আজ মনে হচ্চে অপূর্ববাবুকে যে ভালবেসেছিল সে আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যেতো। সবাই আপনাকে উপেক্ষা করে এসেছে, শুধু একটি লোক করেনি, সে এই ডাক্তার।

ডাক্তার অধোমুখে একটুকরা মাংস হইতে হাড় পৃথক করিবার কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন, মুখ তুলিবার অবকাশ পাইলেন না। ভারতী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, দাদা, মানুষকে চিনে নিতে তোমার ভুল হয় না, তাই সেদিন দুঃখ করে আমার কাছে বলেছিলে, শশী যদি আর কাউকে ভালবাসত! কিন্তু একটা দিনও কি তুমি আমাকে সাবধান করে বলে দিতে পারতে না, ভারতী, এতবড় ভুল তুমি করো না! পুরুষের দুই আদর্শ তোমরা দুজনে আমার সুমুখে বসে,—আজ আমার বিতৃষ্ণার আর অবধি নেই!

ডাক্তার মাংসখণ্ড মুখে পুরিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, অপূর্ব কি বললে শশী?

জবাব দিল ভারতী। কহিল, মা পীড়িত। চিকিৎসার প্রয়োজন, অতএব, টাকা চাই। ফিরে এসে লুকিয়ে গোলামি করলে কেউ জানতে পারবে না। ভয় তলওয়ারকরকে, ভয় ব্রজেন্দ্রকে। কিন্তু, কাকা পুলিশ কর্মচারী,—সে ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে দাদা। তুমি-আমিও বোধ হয় এখন আর বাদ যাবো না। ক্ষুদ্র! লোভী! সঙ্কীর্ণচিত্ত ভীরু! ছি!

ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, যথার্থ ভাল না বাসলে এমন প্রাণ খুলে যশোগান করা যায় না। কবি, এবার তোমার পালা। বাগে্‌দেবীকে স্মরণ করে তুমি এবার নবতারার গুণকীর্তন শুরু কর—আমার অবহিত হই!

ভারতী চকিত হইয়া কহিল, দাদা, তুমি আমাকে তিরস্কার করলে?

ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তাই হবে হয়ত।

অভিমানে, ব্যথায়, ক্রোধে ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কখখনো আমাকে বকতে পাবে না। ভেবেছ, সবাই শশীবাবুর মত মুখ বুজে সইতে পারে? তুমি কি জানো কি হয় মানুষের! উচ্ছ্বসিত বেদনায় কণ্ঠস্বর তাহার অবরুদ্ধ হইয়া আসিস, কহিল, তিনি ফিরে এসেছেন, এবার আমাকে তুমি কোথাও সরিয়া নিয়ে যাও দাদা,—আমি এ কোন্‌ দুর্ভাগার পায়ে আমার সমস্ত বিসর্জন দিয়ে বসে আছি! বলিতে বলিতেই মেঝের উপর মাথা রাখিয়া ভারতী ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া ফেলিল।

ডাক্তার স্মিতমুখে নীরবে আহার করিতে লাগিলেন। তাঁহার নির্বিকার ভাব দেখিয়া মনে হয় না যে, এই-সকল প্রণয়-উচ্ছ্বাস তাঁহাকে লেশমাত্র বিচলিত করিয়াছে। মিনিট পাঁচ-সাত পরে ভারতী উঠিয়া পাশের ঘরে গিয়া চোখ-মুখ ভাল করিয়া ধুইয়া মুছিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, আর তোমাদের কিছু দেব?

ডাক্তার পকেটে হইতে রুমাল বাহির করিয়া বলিলেন, বামুনের ছেলে, কিছু ছাঁদা বেঁধে দাও, দিন-দুই যেন নিশ্চিন্ত হতে পারি।

ময়লা রুমালটা ফিরাইয়া দিয়া ভারতী খোঁজ করিয়া একখানা ধোয়া তোয়ালে বাহির করিল, এবং রকমারি খাদ্যবস্তুর একটি পুঁটলি বাঁধিয়া ডাক্তারের পাশে রাখিয়া দিয়া কহিল, এই ত হল বামুনের ছেলের ছাঁদা। আর ঐ টাকার ছোট্ট থলিটি?

ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ওটি হল বামুনের ছেলের ভোজন-দক্ষিণা।

ভারতী বলিল, অর্থাৎ তুচ্ছ বিবাহ-ব্যাপারটা ছাড়া আসল দরকারী কাজগুলা সমস্তই নির্বিঘ্নে সমাধা হল।

অকস্মাৎ, হাঃ হাঃ করিয়া আরম্ভ করিয়াই ডাক্তার সজোরে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া হাসি থামাইলেন, গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কি যে ভগবানের অভিশাপ, ভারতী, হাসতে গেলেই মুখ দিয়ে আমার অট্টহাসি ছাড়া আর কিছু বার হতেই চায় না। অট্টকান্না কাঁদবার জন্যে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে এলে আজ মুখ দেখানোই ভার হতো।

দাদা, আবার জ্বালাতন করচ?

জ্বালাতন করচি? আমি ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করচি।

ভারতী রাগ করিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইল, জবাব দিল না।

শশী বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, এতক্ষণে কথা কহিল। অকস্মাৎ অতিশয় গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, আপনি যদি রাগ না করেন ত একটা কথা বলতে পারি। কেউ কেউ ভয়ানক সন্দেহ করে যে, আপনার সঙ্গেই একদিন ভারতীর বিবাহ হবে।

ডাক্তার মুহূর্তের জন্য চমকিত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া উল্লাসভরে বলিয়া উঠিলেন, বল কি হে শশী, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক, এমন সুদিন কি কখনো এতবড় দুর্ভাগার অদৃষ্টে হবে? এ যে স্বপ্নের অতীত, কবি!

শশী কহিল, কিন্তু অনেকে ত তাই ভাবেন।

ডাক্তার কহিলেন, হায়! হায়! অনেকে না ভেবে যদি একটিমাত্র লোক একটি পলকের জন্যও ভাবতেন!

ভারতী হাসিয়া ফেলিল। মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দুর্ভাগার ভাগ্য ত একটি পলকেই বদলাতে পারে দাদা। তুমি হুকুম করে যদি বল, ভারতী, কালই আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে, আমি তোমার দিব্যি করে বলচি, বলব না যে আর একটা দিন সবুর কর।

ডাক্তার কহিলেন, কিন্তু অপূর্ব বেচারা যে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ফিরে এল, তার উপায়টা কি হবে?

ভারতী বলিল, তাঁর কনে-বৌ দেশে মজুদ আছে, তাঁর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিনি বুক ফেটে মারা যাবেন না।

ডাক্তার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাও, তোমার ভরসা ত কম নয় ভারতী!

0 Shares