পথের দাবী

শশী কান খাড়া করিয়া বলিল, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ যেন—

ডাক্তার চক্ষের পলকে পকেটের মধ্যে হাত পুরিয়া দিয়া নিঃশব্দ দ্রুতপদে অন্ধকার বারান্দায় বাহির হইয়া গেলেন, কিন্তু ক্ষণেক পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ভারতী, সুমিত্রা আসছেন।

পরিচ্ছেদ – আঠাশ

এই নিশীথ রাত্রে সুমিত্রার আগমন-সংবাদ যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি অপ্রীতিকর। ভারতী কুণ্ঠিত ও ত্রস্ত হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল পরে সে প্রবেশ করিতে ডাক্তার সহজকণ্ঠে অভ্যর্থনা করিয়া কহিলেন, বসো। তুমি কি একলা এলে নাকি?

সুমিত্রা বলিল, হাঁ। ভারতীর প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ভাল আছ ভারতী?

এই মিনিট-খানেক সময়ের মধ্যেই ভারতী কত কি যে ভাবিতেছিল তাহার সীমা নাই। সেদিনকার মত আজিও যে সুমিত্রা তাহাকে গ্রাহ্য করিবে না ইহাই সে নিশ্চিত জানিত, কিন্তু শুধু এই কুশল প্রশ্নে নয়, তাহার কণ্ঠস্বরের স্নিগ্ধ কোমলতায় ভারতী সহসা যেন চাঁদ হাতে পাইল। অহেতুক কৃতজ্ঞতায় অন্তর পরিপূর্ণ করিয়া বলিল, ভালো আছি দিদি। আপনি ভাল আছেন? আজ আর তাহাকে তুমি বলিয়া ডাকিতে ভারতীর সাহস হইল না। হাঁ,আছি,—বলিয়া জবাব দিয়া সুমিত্রা একধারে উপবেশন করিল। কথোপকথন বেশী করা তাহার প্রকৃতি নয়,—একটা স্বাভাবিক ও শান্ত গাম্ভীর্যের দ্বারা চিরদিনই সে ব্যবধান রাখিয়া চলিত, আজও সে রীতির ব্যত্যয় হইল না। ইহা প্রচ্ছন্ন ক্রোধ বা বিরক্তির পরিচায়ক নহে তাহা জানিয়াও কিন্তু ভারতীর নিজে হইতে দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে ভরসা হইল না।

ডাক্তার কথা কহিলেন। বলিলেন, শশীর মুখে শুনলাম, তুমি প্রচুর বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে জাভায় ফিরে যাচ্চ।

সুমিত্রা কহিল, হাঁ, আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে লোক এসেছে।

কবে যাবে?

প্রথম স্টিমারেই—শনিবারে।

ডাক্তার একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, যাক, এবারে তাহলে তুমি বড়লোক হলে।

সুমিত্রা ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, কহিল, হাঁ, সমস্ত পেলে তাই বটে।

ডাক্তার বলিলেন, পাবে। এটর্নির পরামর্শ ছাড়া কাজ করো না। আর, একটু সাবধানে থেকো। যাঁরা তোমাকে নিতে এসেছেন, তাঁরা পরিচিত লোক ত?

সুমিত্রা বলিল, হাঁ, তাঁরা বিশ্বাসী লোক, সকলকেই আমি চিনি।

তাহলে ত কথাই নেই, এই বলিয়া ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া ভারতীকে লক্ষ্য করিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ শশী কথা কহিল; বলিল, এ হল মন্দ নয় ডাক্তার। যে তিনজন বাঙালী মহিলাকে আপনি নিলেন—নবতারা গেলেন, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট যেতে উদ্যত, শুধু ভারতী—

ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, তোমার দুশ্চিন্তার হেতু নেই, কবি, ভারতীও মহাজনের পন্থা অনুসরণ করবেন তা একপ্রকার স্থির হয়ে গেছে।

প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু ক্রুদ্ধ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল, কিন্তু জবাব দিল না।

ডাক্তারের পরিহাসের মধ্যে যে ব্যথা আছে শশী ইহাই অনুমান করিয়া কহিল, আপনাকেও শীঘ্র চলে যেতে হচ্চে। তাহলেই দেখুন, আপনার পথের-দাবীর এ্যাক্টিভিটি বর্মায় অন্ততঃ শেষ হয়ে গেল।

কে আর চালাবে! এই বলিয়া শশী গভীর নিঃশ্বাস মোচন করিল। তাহার এই দীর্ঘশ্বাস অকৃত্রিম এবং যথার্থই বেদনায় পূর্ণ, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, ডাক্তারের মুখের পরে ইহার লেশমাত্র প্রতিবিম্ব পড়িল না। তেমনি হাসিমুখে কহিলেন, ও কি কথা কবি? এতকাল এত দেখেশুনে শেষে তোমারই মুখে সব্যসাচীর এই সার্টিফিকেট! তিনজন মহিলা চলে যাবেন বলে পথের-দাবী শেষ হয়ে যাবে? মদ ছেড়ে দিয়ে কি এই হল নাকি? তার চেয়ে বরঞ্চ তুমি আবার ধরো।

কথাটা তামাশার মত শুনাইলেও যে তামাশা নয় তাহা বুঝিয়াও ভারতী ঠিকমত বুঝিতে পারিল না। কটাক্ষে চাহিয়া দেখিল, সুমিত্রা নতনেত্রে নিঃশব্দে বসিয়া আছে। তখন সে মুখ তুলিয়া ডাক্তারের মুখের প্রতি স্থির দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, দাদা, আমার ত আর বোঝবার জন্যে মদ ধরবার আবশ্যক নেই, কিন্তু তবু ত বুঝতে পারলাম না। নবতারা কিছুই নয়, আর আমি তার চেয়েও অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু সুমিত্রাদিদি—যাঁকে তুমি নিজে থেকে প্রেসিডেন্টের আসন দিয়েছ,—তিনি চলে গেলেও কি তোমার পথের-দাবীতে আঘাত লাগবে না? সত্যি কথা বলো দাদা, শুদ্ধমাত্র কাউকে লাঞ্ছনা করবার জন্যেই রাগ করে যেন বলো না! এই বলিয়া সে চোখাচোখি হইবার নিঃসন্ধিগ্ধ ভরসায় পলকমাত্র সুমিত্রার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু অন্যত্র অপসারিত করিল। চোখে চোখ মিলিল না, সুমিত্রা সেই যে মুখ নীচু করিয়া বসিয়া ছিল, ঠিক তেমনি নির্বাক নতমুখে মূর্তির মত বসিয়া রহিল।

ডাক্তার ক্ষণকাল মৌন হইয়া রহিলেন, তাহার পরে ধীরে ধীরে কহিলেন, আমি রাগ করে বলিনি ভারতী, সুমিত্রা অবহেলার বস্তু নয়। কিন্তু তুমি হয়ত জানো না, কিন্তু নিজে সুমিত্রা ভালরূপেই জানেন যে এ-সকল ব্যাপারে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ গণনা করতে নেই। তা ছাড়া প্রাণ যাদের এমন অনিশ্চিত তাদের মূল্য স্থির হবে কি দিয়ে বল ত? মানুষ ত যাবেই। যত বড়ই হোক, কারও অভাবকেই যেন না আমরা সর্বনাশ বলে ভাবি, একজনের স্থান যেন জলস্রোতের মত আর একজন স্বচ্ছন্দে এবং অত্যন্ত অনায়াসেই পূর্ণ করে নিতে পারে এই শিক্ষাই ত আমাদের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা ভারতী!

ভারতী কহিল, কিন্তু এ ত আর সংসারে সত্যই ঘটে না! এই যেমন তুমি। তোমার অভাব কেউ কোনদিন পূর্ণ করতে পারে এ কথা ত আমি ভাবতেই পারিনে দাদা।

ডাক্তার বলিলেন, তোমার চিন্তার ধারা স্বতন্ত্র, ভারতী। আর, এই যেদিন টের পেয়েছিলাম, সেই দিন থেকেই তোমাকে আর আমি দলের মধ্যে টানতে পারিনি। কেবলি মনে হয়েছে, জগতে তোমার অন্য কাজ আছে।

ভারতী বলিল, আর কেবলই আমার মনে হয়েছে আমাকে অযোগ্য জ্ঞানে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্চো। যদি আমার অন্য কাজ থাকে, আমি তারই জন্যে এখন থেকে সংসারে বার হবো, কিন্তু আমার প্রশ্নের ত জবাব হল না, দাদা। আসলে কথাটা তুচ্ছ। তোমার অভাব জলস্রোতের মতই পূর্ণ হতে পারে কি না? তুমি বলছ পারে,—আমি বলচি, পারে না। আমি জানি, পারে না, আমি জানি, মানুষ শুধু জলস্রোত নয়—তুমি ত নও-ই।

মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া সে পুনশ্চ কহিল, কেবল এই কথাটাই জানবার জন্যে তোমাকে আমি পীড়াপীড়ি করতাম না। কিন্তু যা নয়, যা নিজে জানো তুমি সত্য নয়, তাই দিয়ে আমাকে ভোলাতে চাও কেন?

ডাক্তার হঠাৎ উত্তর দিতে পারিলেন না, উত্তরের জন্য ভারতী অপেক্ষাও করিল না। কহিল, এদেশে আর তোমার থাকা চলে না,—তুমিও যাবার জন্যে পা তুলে আছো। আবার তোমাকে ফিরে পাওয়া যে কত অনিশ্চিত এ কথা ভাবতেও বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকে, তাই ও আমি ভাবিনে, তবুও এ সত্য ত প্রতিমুহূর্তেই অনুভব না করে পারিনে। এ ব্যথার সীমা নেই, কিন্তু তার চেয়েও আমার বড় ব্যথা তোমাকে এমন করে পেয়েও পেলাম না! আজ আমার কত দিনের কত প্রশ্নই মনে হচ্চে দাদা, কিন্তু যখনি জিজ্ঞাসা করেছি তুমি সত্য বলেছ, মিথ্যা বলেছ, সত্যি-মিথ্যায় জড়িয়ে দিয়ে বলেছ,—কিন্তু কিছুতেই সত্য জানতে দাওনি। তোমার পথের-দাবীর সেক্রেটারি আমি, তবু যে তোমার কাজের পদ্ধতিতে আমার এতটুকু আস্থা ছিল না এ কথা তোমাকে ত আমি একটা দিনও লুকোই নি। তুমি রাগ করোনি, অবিশ্বাস করোনি,—হাসিমুখে শুধু বারবার সরিয়ে দিতে চেয়েছ। অপূর্ববাবুর জীবন-দানের কথা আমি ভুলিনি। মনে হয়, আমার ছোট্ট জীবনের কল্যাণ কেবল তুমিই নির্দেশ করে দিতে পারো। দোহাই দাদা, যাবার পূর্বে আর নিজেকে গোপন করে যেয়ো না,—তোমার, আমার, সকলের যা পরম সত্য তাই আজ অকপটে প্রকাশ কর।

0 Shares