পথের দাবী

ক্ষতি এবং অনিষ্ট কত যে হইয়াছে দূর হইতে নিরূপণ করা শক্ত। সম্ভবতঃ যথেষ্ট হইয়াছে। কিন্তু যতই হউক, দুটা কাজ তাঁহাকে করিতেই হইবে। তাঁহাদের জ্যামেকা ক্লবের যে অংশটা সিঙ্গাপুরে আছে তাহাকে বাঁচাইতেই হইবে, এবং যেখানে হউক, এবং যেমন করিয়া হউক ব্রজেন্দ্রকে তাঁহার খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে। নদীর দক্ষিণে সিরিয়মের সন্নিকটে একখানা চীনা জাহাজ মাল বোঝাই করিয়া দেশে চলিয়াছে, কাল অতি প্রত্যূষেই তাহা ছাড়িয়া যাইবে, ইহাতেই কোনমতে একটা স্থান পাওয়া গিয়াছে। সেই সংবাদই হীরা সিং এইমাএ দিয়া গেল।

শুনিয়া সুমিত্রার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। খুব সম্ভব, ব্রজেন্দ্র এখন সিঙ্গাপুরে। এবং, যে ব্যক্তি তাহার সন্ধানে চলিল, তাহার দৃষ্টি হইতে স্বর্গে-মর্ত্যে কোথাও তাহার পরিত্রাণ নাই। তখন বিশ্বাসঘাতকতার শেষ-বিচারের সময় আসিবে। ইহার দণ্ড যে কি তাহা দলের মধ্যে কাহারও অবিদিত নহে, সুমিত্রাও জানে। ব্রজেন্দ্র তাহার কিছুই নহে, এবং অপরাধ যদি সে করিয়াই থাকে শাস্তি তাহার হউক, কিন্তু যে কারণে সুমিত্রা অকস্মাৎ এমন হইয়া গেল, তাহা ব্রজেন্দ্রের দণ্ডের কথা স্মরণ করিয়া নহে, তাহা এই যে, ব্রজেন্দ্র পতঙ্গ নহে। সে আত্মরক্ষা করিতে জানে। শুধু তাহার পকেটের সুগুপ্ত পিস্তল নহে, তাহার মত ধূর্ত, কৌশলী ও একান্ত সতর্ক ব্যক্তি সংসারে বিরল। তাহার মস্ত ভুল এই হইয়াছে যে ডাক্তার হাঁটা-পথে বর্মা ত্যাগ করিয়া গেছেন এই কথা সে যাবার পূর্বে নিশ্চয় বিশ্বাস করিয়া গেছে। এখন কোন মতে যদি সে ডাক্তারের খোঁজ পায় ত বধ করিবার যতকিছু অস্ত্র তাহার তূণে আছে প্রয়োগ করিতে মুহূর্তের দ্বিধাও করিবে না। বস্তুতঃ, জীবন-মরণ সমস্যায় অপরের বলিবারই বা কি আছে!

কিছুই নাই। শুধু হীরা সিংহের শান্ত মৃদু দুটি শব্দ ‘নাউ’ এবং ‘রেড়ি’ তাহাদের সকলের কানের মধ্যেই সহস্রগুণ ভীষণ হইয়া সহস্র দিক দিয়া আঘাত-প্রতিঘাত করিয়া ফিরিতে লাগিল। ভারতীর মনে পড়িল তাহাদের মৌলমিনের বাটীতে একদিন জন্মতিথি উৎসবের পরিপূর্ণ আনন্দের মাঝখানে অতিথি এবং সর্বোত্তম বন্ধু রেভারেণ্ড লরেন্স আহারের টেবিলে হৃদ্‌রোগে মারা গিয়াছিলেন। আজিও ঠিক তেমনি অকস্মাৎ হীরা সিং ঘরে ঢুকিয়া মৃত্যুদূতের ন্যায় একমুহূর্তে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়া বাহির হইয়া গেল।

হঠাৎ শশী কথা বলিয়া উঠিল। মুখ দিয়া ফোঁস করিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, সব যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্চে ডাক্তার।

কথাটা সাদা এবং নিতান্তই মোটা কথা। কিন্তু সকলের বুকের উপর যেন মুগুরের ঘা মারিল।

ডাক্তার হাসিলেন। শশী কহিল, হাসুন আর যাই করুন, সত্যি কথা। আপনি কাছে নেই মনে হলে সমস্ত যেন ব্ল্যাঙ্ক,—ফাঁকা, ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু আপনার প্রত্যেকটি হুকুম আমি মেনে চলবো।

যথা?

যথা, মদ খাবো না, পলিটিক্সে মিশবো না, ভারতীর কাছে থাকবো এবং কবিতা লিখবো।

ডাক্তার ভারতীর মুখের দিকে একবার চাহিলেন, কিন্তু দেখিতে পাইলেন না। তখন রহস্যভরে প্রশ্ন করিলেন, চাষাড়ে কবিতা লিখবে না কবি?

শশী কহিল, না। তাদের কাব্য তারা লিখতে পারে লিখুক, আমি লিখচি নে। আপনার সে কথা আমি অনেক ভেবে দেখেচি। এবং, এ উপদেশও কখনো ভুলবো না যে, আইডিয়ার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে শুধু শিক্ষিত ভদ্র-সন্তান,অশিক্ষিত কৃষকে পারে না। আমি হব তাদেরই কবি।

ডাক্তার বলিলেন, যাই হয়ো। কিন্তু এইটেই শেষ-কথা নয় কবি, মানবের গতি এইখানেই নিশ্চল হয়ে থাকবে না। কৃষকের দিনও একদিন আসবে, যখন তাদের হাতেই জাতির সকল কল্যাণ-অকল্যাণের ভার সমর্পণ করতে হবে।

শশী কহিল, আসুক সেদিন। তখন, স্বচ্ছন্দ শান্তচিত্তে সব দায়িত্ব তাদের হাতেই তুলে দিয়ে আমরা ছুটি নেব। কিন্তু আজ না। আজ আত্মবলিদানের গুরুভার তারা বইতে পারবে না।

ডাক্তার উঠিয়া আসিয়া তাহার কাঁধের উপর ডান হাত রাখিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, কিছুই বলিলেন না।

অপূর্ব এতক্ষণ নিঃশব্দে স্থির হইয়া শুনিতেছিল, ইঁহাদের কোন আলোচনাতেই কথা কহে নাই। কিন্তু শশীর শেষের দিকের মন্তব্য তাহার ভারী খারাপ ঠেকিল। যে কৃষকের মঙ্গলোদ্দেশে আত্মনিয়োগের সঙ্কল্প সে স্থির করিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে এই-সকল অভিমতে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হইয়া বলিয়া উঠিল, মদ খাওয়া খারাপ, বেশ, উনি ছেড়ে দিন; কাব্যচর্চা ভালো, তাই করুন; কিন্তু কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের কৃষককুল কি এমনি তুচ্ছ, এতই অবহেলার বস্তু? এবং, এরাই যদি বড় হয়ে না ওঠে, আপনাদের বিপ্লবই বা করবে কে? এবং, করবেই বা কেন? আর পলিটিক্স! যথার্থ বলচি ডাক্তার, কৃষকের কল্যাণে সন্ন্যাসব্রত যদি আমি না নিতাম, আজ স্বদেশের রাজনীতিই হতো আমার জীবনের একমাত্র কর্তব্য।

ডাক্তার ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সহসা, প্রসন্ন স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাস্যে তাঁহার মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। কহিলেন, আমি কায়মনে প্রার্থনা করি তোমার সদুদ্দেশ্য যেন সফল হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রও তাচ্ছিল্যের সামগ্রী নয়। দেশের ও দশের কল্যাণে বৈরাগ্যই যদি গ্রহণ করে থাকো, কারও সঙ্গেই তোমার বিরোধ বাধবে না। আমি শুধু এই কথাই বলি, অপূর্ববাবু, সকলে কিন্তু সকল কাজের যোগ্য হয় না।

অপূর্ব স্বীকার করিয়া বলিল, আমার চেয়ে এ শিক্ষা আর কার বেশী হয়েছে ডাক্তার? আপনি দয়া না করলে বহুদিন পূর্বেই ত এই ভ্রমের চরম দণ্ড আমার হয়ে যেতো। এই বলিয়া পূর্বস্মৃতির আঘাতে তাহার সর্বদেহ কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

শশী এ ঘটনা জানিত না, জানানো কেহ আবশ্যক বিবেচনাও করে নাই। অপূর্বর কথাটাকে সে প্রচলিত বিনয় ও শ্রদ্ধাভক্তির নিদর্শনের অতিরিক্ত কিছুই মনে করিল না। কহিল, ভ্রম ত করে অনেকেই, কিন্তু দণ্ডভোগ করে চলে যে নিজের জন্মভূমি। আমি ভাবি, ডাক্তার, আপনার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি কে আছে? কার এতখানি জ্ঞান? জাতি ও দেশ নির্বিশেষে কার এতখানি রাষ্ট্রতন্ত্রের অভিজ্ঞতা? কার এত ব্যথা? অথচ, কিছুই কাজে এলো না। চায়নার আয়োজন নষ্ট হয়ে গেল, পিনাঙের গেল, বর্মার কিছুই রইল না, সিঙ্গাপুরেরও যাবে নিশ্চয়ই,―এক কথায়, আপনার এতকালের সমস্ত চেষ্টাই ধ্বংস হাবার উপক্রম হয়েছে। শুধু প্রাণটাই বাকী, সেও কোন দিন যায়!

ডাক্তার মুখ টিপিয়া একটুখানি হাসিলেন। শশী কহিল, হাসুন আর যাই করুন, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।

ডাক্তার তেমনি হাসিমুখে প্রশ্ন করিলেন, দিব্যচক্ষে আর কিছু দেখতে পাও না কবি?

শশী বলিল, তাও পাই। তাইত আপনাকে দেখলেই মনে হয়, নিরুপদ্রব, শান্তিময় পথে যদি আমাদের সত্যকার পথের-দাবী সূচ্যগ্র মাত্রও খোলা থাকতো!

অপূর্ব বলিয়া উঠিল, বাঃ! একই সঙ্গে একেবারে দুই উলটো কথা।

সুমিত্রা হাসি গোপন করিতে মুখ ফিরাইল, ডাক্তার নিজেও হাসিয়া বলিলেন, তার কারণ, ওঁর মধ্যে দুটো সত্তা আছে অপূর্ববাবু। একজন শশী, আর একজন কবি। এইজন্যই একের মুখের কথা অপরের মনের কথায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে এমন বেসুরার সৃষ্টি করে। একটু থামিয়া বলিলেন, বহু মানবের মধ্যেই এমনি আর একজন নিভৃতে বাস করে। সহজে তাকে ধরা যায় না। তাই, মানুষের কথার ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব-মাত্রই তার কঠোর বিচার করলে অবিচারের সম্ভাবনাই থাকে বেশী। অপূর্ববাবু, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু পারেন নি সুমিত্রা। ভারতী, জীবনযাত্রার মাঝখানে যদি এমনি আঘাত কখনো পাও দিদি, পরলোকগত দাদার এই কথাটি তখন যেন ভুলো না। কিন্তু, এইবার আমি উঠি। ঘাটে আমার নৌকা বাঁধা আছে, ভাটার মুখে অনেকখানি দাঁড় না টানলে আর ভোর-রাত্রে জাহাজ ধরতে পারব না।

0 Shares