মনোরমার তাস খেলা দু’দিন বন্ধ হইয়াছে—ললিতা আসে না। তাহাকে দেখিয়া অবধি গিরীন্দ্র যে আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা প্রথম হইতেই মনোরমা সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাঁহার সেই সন্দেহ আজ সুদৃঢ় হইল।
এই দুইদিন গিরীন কি একরকম উৎসুক ও অন্যমনস্ক হইয়াছিল। অপরাহ্নে বেড়াইতে যাইত না, যখন-তখন বাড়ির ভিতরে আসিয়া এঘর-ওঘর করিত, আজ দুপুরবেলা আসিয়া বলিল, দিদি, আজও খেলা হবে না?
মনোরমা বলিলেন, কি করে হবে গিরীন, লোক কৈ? না হয়, আয় আমরা তিনজনেই খেলি।
গিরীন নিরুৎসাহভাবে বলিল, তিনজনে কি খেলা হয় দিদি? ও-বাড়ির ললিতাকে একবার ডাকতে পাঠাও না।
সে আসবে না।
গিরীন বিমর্ষ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন আসবে না, ওদের বাড়িতে মানা করে দিয়েচে বোধ হয়, না?
মনোরমা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, ওর মামা-মামী সে-রকম মানুষ নয়—সে নিজেই আসে না।
গিরীন হঠাৎ খুশি হইয়া বলিল, তা হলে তুমি নিজে আজ একবার গেলেই আসবেন—কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে নিজের মনেই ভারী অপ্রতিভ হইয়া গেল।
মনোরমা হাসিয়া ফেলিলেন,—আচ্ছা, তাই যাই, বলিয়া চলিয়া গেলেন এবং খানিক পরে ললিতাকে ধরিয়া আনিয়া তাস পড়িয়া বসিলেন।
দু’দিন খেলা হয় নাই, আজ অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জমিয়া গেল। ললিতারা জিতিতেছিল।
ঘণ্টা-দুই পরে সহসা কালী আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, সেজদি, শেখরদা ডাকচেন—জলদি!
ললিতার মুখ পাণ্ডুর হইয়া গেল, তাস-দেওয়া বন্ধ করিয়া বলিল, শেখরদা অফিসে যাননি?
কি জানি, চলে এসেচেন, বলিয়া সে ঘাড় নাড়িয়া প্রস্থান করিল।
ললিতা তাস রাখিয়া দিয়া মনোরমার মুখপানে চাহিয়া কুন্ঠিতভাবে বলিল, যাই সই-মা।
মনোরমা তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, সে কি রে, আর দু-হাত দেখে যা।
ললিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না সই-মা, ইনি তা হলে বড় রাগ করবেন, বলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।
গিরীন প্রশ্ন করিল, শেখরদাদা আবার কে দিদি?
মনোরমা বলিলেন, ঐ যে সুমুখের ফটকওয়ালা বড় বাড়িটা।
গিরীন ঘাড় নাড়িয়া বলিল,—ও—ওই বাড়ি। নবীনবাবু ওঁদের আত্মীয় বুঝি?
মনোরমা মেয়ের মুখের পানে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আত্মীয় কেমন! ললিতাদের ঐ ভিটেটুকু পর্যন্ত বুড়ো আত্মসাৎ করবার ফিকিরে আছেন!
গিরীন আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল।
মনোরমা তখন গল্প করিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া গত বৎসর টাকার অভাবে গুরুচরণবাবুর মেজমেয়ের বিবাহ হইতেছিল না, পরে অসম্ভব সুদে নবীন রায় টাকা ধার দিয়া বাড়িখানি বাঁধা রাখিয়াছেন। এ টাকা কোনদিন শোধ হইবে না এবংঅবশেষে বাড়িটা নবীন রায়ই গ্রহণ করিবেন।
মনোরমা সমস্ত কথা বলিয়া পরিশেষে মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, বুড়ার আন্তরিক ইচ্ছা গুরুচরণবাবুর ভাঙ্গা বাড়িটি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া ঐখানে ছোটো ছেলে শেখরের জন্যে একঢি বড় রকমের বাড়ি তৈরি করেন—দুই ছেলের দুই আলাদা বাড়ি—মতলব মন্দ নয়।
ইতিহাস শুনিয়া গিরীনের ক্লেশ বোধ হইতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দিদি, গুরুচরণবাবুর আরও ত মেয়ে আছে, তাদেরি বা বিয়ে কি করে দেবেন?
মনোরমা বলিলেন, নিজের ত আছেই, তা ছাড়া ললিতা। ওর বাপ-মা নেই, সমস্ত ভার ঐ গরীবের ওপর। বড় হয়ে উঠেচে, এই বছরের মধ্যে বিয়ে না দিলেই নয়। ওদের সমাজে সাহায্য করতে কেউ নেই, জাত নিতে সবাই আছে—আমরা বেশ আছি গিরীন।
গিরীন চুপ করিয়া রহিল, তিনি বলিতে লাগিলেন, সেদিন ললিতার কথা নিয়েই ওর মামী আমার কাছে কেঁদে ফেললে—কি করে যে কি হবে তার কিছুই স্থির নেই—ওর ভাবনা ভেবেই গুরুচরণবাবুর পেটে অন্ন-জল যায় না,হাঁ গিরীন, মুঙ্গেরে তোদের কোন বন্ধুবান্ধব এমন নেই যে, শুধু মেয়ে দেখে বিয়ে করে? অমন মেয়ে কিন্তু পাওয়া শক্ত।
গিরীন বিষণ্ণভাবে মুদু হাসিয়া বলিল, বন্ধুবান্ধব আর পাবো কোথায় দিদি, তবে টাকা দিয়ে আমি সাহায্য করতে পারি।
গিরীনের পিতা ডাক্তারি করিয়া অনেক টাকা এবং বিষয়-সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, সে-সমস্তরই এখন সে মালিক।
মনোরমা বলিলেন, টাকা, তুই ধার দিবি?
ধার আর কি দেব দিদি—ইচ্ছে হয়, উনি শোধ দেবেন, না হয় নাই দেবেন।
মনোরমা বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, তোর টাকা দিয়ে লাভ? ওরা আমাদের আত্মীয়ও নয়, সমাজের লোকও নয়—এমনি কে কাকে টাকা দেয়?
গিরীন তাহার বোনের মুখের পানে চাহিয়া হাসিতে লাগিল, তার পরে কহিল, সমাজের লোক নাই হলেন, বাঙ্গালী ত? ওঁর একান্ত অভাব, আর আমার বিস্তর রয়েচে,— তুমি একবার বলে দেখো না দিদি, উনি যদি নিতে রাজি হন, আমি দিতে পারি। ললিতা তাঁদেরও কেউ নয়, আমাদেরও কেউ নয়—তার বিয়ের সমস্ত খরচ না হয় আমিই দেব।
তাহার কথা শুনিয়া মনোরমা বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন না। ইহাতে তাঁহার নিজের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছুই নাই বটে, তথাপি এত টাকা একজন আর একজনকে দিতেছে দেখিলে অনেক স্ত্রীলোকই প্রসন্ন-চিত্তে গ্রহণ করিতে পারে না।
চারু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিল, সে মহা খুশি হইয়া লাফাইয়া উঠিল, বলিল, তাই দাও মামা, আমি সই-মাকে বলে আসচি।
তাহার মা ধমক দিয়া বলিলেন, তুই থাম চারু, ছেলেমানুষ—এ-সব কথায় থাকিস নে। বলতে হয় আমিই বলব।
গিরীন কহিল, তাই বলো দিদি। পরশু রাস্তার উপর দাঁড়িয়েই গুরুচরণবাবুর সঙ্গে একটুখানি আলাপ হয়েছিল, কথায়বার্তায় মনে হল—বেশ সরল লোক; তুমি কি বল?