পল্লী-সমাজ

ধর্মদাস নিতান্ত অত্যুক্তি করেন নাই। উদ্যোগ-আয়োজন যেরূপ হইতেছিল, এদিকে সেরূপ কেহ করে নাই। কলিকাতা হইতে ময়রা আসিয়াছিল। তাহারা প্রাঙ্গণের একধারে ভিয়ান চড়াইয়াছে—সেদিকে পাড়ার কতকগুলো ছেলেমেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে; কাঙ্গালীদের বস্ত্র দেওয়া হইবে—চণ্ডীমণ্ডপের ও-ধারের বারান্দায় অনুগত ভৈরব আচার্য থান ফাড়িয়া পাট করিয়া গাদা করিতেছিল—সেদিকেও জনকয়েক লোক থাবা পাতিয়া বসিয়া এই অপব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করিয়া মনে মনে রমেশের নির্বুদ্ধিতার জন্য তাহাকে গালি পাড়িতেছিল। গরীব-দুঃখী সংবাদ পাইয়া অনেক দূরের পথ হইতেও আসিয়া জুটিতেছিল। লোকজন, প্রজা-পাঠক বাড়ি পরিপূর্ণ করিয়া কেহ কলহ করিতেছিল, কেহ বা মিছিমিছি শুধু কোলাহল করিতেছিল। চারিদিকে চাহিয়া ব্যয়বাহুল্য দেখিয়া ধর্মদাসের কাসি আরও বাড়িয়া গেল।

প্রত্যুত্তরে রমেশ সঙ্কুচিত হইয়া ‘না না’ বলিয়া আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ধর্মদাস হাত নাড়িয়া থামাইয়া দিয়া ঘড়্‌ঘড়্‌ করিয়া কত কি বলিয়া ফেলিল, কিন্তু কাসির ধমকে তাহার একটি বর্ণও বুঝা গেল না।

গোবিন্দ গাঙ্গুলী সর্বাগ্রে আসিয়াছিল। সুতরাং ধর্মদাস যাহা বলিয়াছিল তাহা বলিবার সুবিধা তাহারই সর্বাপেক্ষা অধিক থাকিয়াও নষ্ট হইয়াছে ভাবিয়া তাহার মনে মনে ভারি একটা ক্ষোভ জন্মিতেছিল। সে এ সুযোগ আর নষ্ট হইতে দিল না। ধর্মদাসকে উদ্দেশ করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কাল সকালে, বুঝলে ধর্মদাসদা, এখানে আসব বলে বেরিয়েও আসা হ’ল না—বেণীর ডাকাডাকি—গোবিন্দখুড়ো, তামাক খেয়ে যাও। একবার ভাবলুম, কাজ নেই—তারপর মনে হ’ল ভাবখানা বেণীর দেখেই যাই না। বেণী কি বললে জান বাবা রমেশ! বললে, খুড়ো, বলি তোমরা ত রমেশের মুরুব্বি হয়ে দাঁড়িয়েচ, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, লোকজন খাবে-টাবে ত? আমিই বা ছাড়ি কেন। তুমি বড়লোক আছ না আছ, আমার রমেশ কারো চেয়ে খাটো নয়। তোমার ঘরে ত এক মুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই। বললুম বেণীবাবু, এই ত পথ, একবার কাঙ্গালী-বিদায়টা দাঁড়িয়ে দেখো। কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটাও বলি একে! এতটা বয়েস হ’ল, এমন আয়োজন কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু তাও বলি ধর্মদাসদা, আমাদের সাধ্যিই বা কি! যাঁর কাজ তিনি উপর থেকে করাচ্চেন। তারিণীদা শাপভ্রষ্ট দিক্‌পাল ছিলেন বৈ ত নয়!

ধর্মদাসের কিছুতেই কাসি থামে না, সে কাসিতেই লাগিল, আর তাহার মুখের সামনে গাঙ্গুলীমশাই বেশ বেশ কথাগুলি অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতে লাগিল দেখিয়া ধর্মদাস আরও ভাল কিছু বলিবার চেষ্টায় যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল।

গাঙ্গুলী বলিতে লাগিল, তুমি ত আমার পর নও বাবা—নিতান্ত আপনার। তোমার মা যে আমার একেবারে সাক্ষাৎ পিসতুতো বোনের খুড়তুতো ভগিনী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে বাড়ি—সে-সব তারিণীদা জানতেন। তাই যে-কোন কাজ-কর্মে—মামলা-মোকদ্দমা করতে, সাক্ষী দিতে—ডাক গোবিন্দকে!

ধর্মদাস প্রাণপণ-বলে কাসি থামাইয়া খিঁচাইয়া উঠিল—কেন, বাজে বকিস্ গোবিন্দ? খক্—খক্—খক্—আমি আজকের নয়—না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বল্‌লি, আমার জুতো নেই, খালি-পায়ে যাই কি করে? খক্‌—খক্‌—তারিণী অমনি আড়াই টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কিনে দিল। তুই সেই পায়ে দিয়ে বেণীর হয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি! খক্‌—খক্‌—খক্‌—

গোবিন্দ চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিল, এলুম?

এলিনে?

দূর মিথ্যাবাদী ।

মিথ্যাবাদী তোর বাবা !

গোবিন্দ তাহার ভাঙ্গা ছাতি হাতে করিয়া লাফাইয়া উঠিল, তবে রে শালা!

ধর্মদাস তাহার বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া হুঙ্কার দিয়াই প্রচণ্ডভাবে কাসিয়া ফেলিল। রমেশ শশব্যস্তে উভয়ের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। ধর্মদাস লাঠি নামাইয়া কাসিতে কাসিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল, ও শালার সম্পর্কে আমি বড় ভাই হই কিনা, তাই শালার আক্কেল দেখ—

ওঃ, শালা আমার বড় ভাই! বলিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলীও ছাতি গুটাইয়া বসিয়া পড়িল।

শহরের ময়রারা ভিয়ান ছাড়িয়া চাহিয়া রহিল। চতুর্দিকে যাহারা কাজ-কর্মে নিযুক্ত ছিল, চেঁচামেচি শুনিয়া তাহারা তামাশা দেখিবার জন্য সুমুখে ছুটিয়া আসিল। ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলিয়া হাঁ করিয়া মজা দেখিতে লাগিল এবং এই-সমস্ত লোকের দৃষ্টির সুমুখে রমেশ লজ্জায় বিস্ময়ে হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না। কি এ? উভয়েই প্রাচীন, ভদ্রলোক—ব্রাহ্মণ-সন্তান! এত সামান্য কারণে এমন ইতরের মত গালিগালাজ করিতে পারে! বারান্দায় বসিয়া ভৈরব কাপড়ের থাক দিতে দিতে সমস্তই দেখিতেছিল, শুনিতেছিল। এখন উঠিয়া আসিয়া রমেশকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, প্রায় শ’-চারেক কাপড় ত হ’ল, আরও চাই কি?

রমেশের মুখ দিয়া হঠাৎ কথাই বাহির হইল না। ভৈরব রমেশের অভিভূত ভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিল। মৃদু অনুযোগের স্বরে কহিল, ছিঃ গাঙ্গুলীমশাই! বাবু একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজ-কর্মের বাড়িতে কত ঠেঙ্গাঠেঙ্গি রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যায়—আবার যে-কে সেই হয়। নিন্‌ উঠুন চাটুয্যেমশাই—দেখুন দেখি আরও থান ফাড়ব কি না?

ধর্মদাস জবাব দিবার পূর্বেই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সোৎসাহে শিরশ্চালনপূর্বক খাড়া হইয়া বলিল, হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়! নইলে বিরদ কর্ম বলেচে কেন? শাস্তরে আছে লক্ষ কথা না হলে বিয়েই হয় না যে! সে বছর—তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যেমশায়ের কন্যা রমার গাছ পিতিষ্ঠের দিনে সিদে নিয়ে রাঘব ভট্‌চায্যিতে হারাণ চাটুয্যেতে মাথা-ফাটাফাটি হয়ে গেল? কিন্তু আমি বলি ভৈরবভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্ছে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া, আর ছেলেদের একখানা ক’রে দিলেই নাম হ’ত। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্মদাসদা?

0 Shares