পল্লী-সমাজ

বেণী বাহিরে যাই বলুক, সে মনে মনে রমাকে ভয় করিত। এখন সে শয্যাগত, মামলা-মকদ্দমা করিতে পারিবে না; উপরন্তু তাহাদের মুসলমান প্রজারাও রমেশের কথা ঠেলিতে পারিবে না। পরে যাই হোক, আপাততঃ বে-দখল করিবার এমন অবসর আর মিলিবে না বলিয়া সে একেবারে জিদ ধরিয়া বসিল। রমেশ আশ্চর্য হইয়া অস্বীকার করিতেই বেণী বহু প্রকারের যুক্তি প্রয়োগ করিয়া শেষে কহিল, হবে না কেন? বাগে পেয়ে সে কবে তোমাকে রেয়াৎ করেচে যে, তার অসুখের কথা তুমি ভাবতে যাচ্ছ? তোমাকে যখন সে জেলে দিয়েছিল, তখন তোমার অসুখই বা কোন্ কম ছিল ভাই!

কথাটা সত্য। রমেশ অস্বীকার করিতে পারিল না। তবু কেন যে তাহার মন কিছুতেই তাহার বিপক্ষতা করিতে চাহিল না—বেণীর সহস্র কটু উত্তেজনা সত্ত্বেও রমার অসহায় পীড়িত অবস্থা মনে করিতেই তাহার সমস্ত বিরুদ্ধ-শক্তি সঙ্কুচিত হইয়া বিন্দুবৎ হইয়া গেল; তাহার সুস্পষ্ট হেতু সে নিজেও খুঁজিয়া পাইল না! রমেশ চুপ করিয়া রহিল। বেণী কাজ হইতেছে জানিলে ধৈর্য ধরিতে জানে। সে তখনকার মত আর পীড়াপীড়ি না করিয়া চলিয়া গেল।

এবার আর একটা জিনিস রমেশের বড় দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। বিশ্বেশ্বরীর কোন দিনই সংসারে যে বিশেষ আসক্তি ছিল না, তাহা সে পূর্বেও জানিত, কিন্তু এবার ফিরিয়া আসিয়া সেই অনাসক্তিটা যেন বিতৃষ্ণায় পরিণত হইয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইতেছিল। কারাগার হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়া বেণীর সমভিব্যাহারে যেদিন সে-গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, সেদিন বিশ্বেশ্বরী আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলেন, সজলকণ্ঠে বারংবার অসংখ্য আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, তথাপি কি যেন একটা তাহাতে ছিল, যাহাতে সে ব্যথাই পাইয়াছিল। আজ হঠাৎ কথায় কথায় শুনিল বিশ্বেশ্বরী কাশী-বাস সঙ্কল্প করিয়া যাত্রা করিতেছেন, আর ফিরিবেন না; শুনিয়া সে চমকিয়া গেল।

কৈ সে ত কিছুই জানে না! নানা কাজে পাঁচ-ছদিনের মধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই, কিন্তু যেদিন হইয়াছিল সেদিন ত তিনি কোন কথা বলেন নাই! যদিচ সে জানিত, তিনি নিজে হইতে আপনার বা পরের কথা আলোচনা করিতে কোন দিন ভালবাসেন না, কিন্তু আজিকার সংবাদটার সহিত সেদিনের স্মৃতিটা পাশাপাশি চোখের সামনে তুলিয়া ধরিবামাত্র তাঁহার এই একান্ত বৈরাগ্যের অর্থ দেখিতে পাইল। আর তাহার লেশমাত্র সংশয় রহিল না, জ্যাঠাইমা সত্যই বিদায় লইতেছেন। এ যে কি, তাঁহার অবিদ্যমানতা যে কি অভাব, মনে করিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। আর মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া সে এ-বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বেলা তখন নটা-দশটা। ঘরে ঢুকিতে গিয়া দাসী জানাইল তিনি মুখুয্যেবাড়ি গেছেন।

রমেশ আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, এমন সময় যে?

এ দাসীটি বহুদিনের পুরানো। সে মৃদু হাসিয়া কহিল, মার আবার সময়-অসময়। তা ছাড়া, আজ তাঁদের ছোটবাবুর পৈতে কিনা ।

যতীনের উপনয়ন?

রমেশ আরও আশ্চর্য হইয়া কহিল, কৈ এ কথা ত কেউ জানে না?

দাসী কহিল, তাঁরা কাউকে বলেন নি। বললেও ত কেউ গিয়ে খাবে না—রমাদিদিকে কর্তারা সব একঘরে করে রেখেছেন কিনা।

রমেশের বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিতেই দাসী সলজ্জে ঘাড়টা ফিরাইয়া বলিল, কি জানি ছোটবাবু—রমাদিদির কি সব বিশ্রী অখ্যাতি বেরিয়েচে কিনা—আমরা গরীব-দুঃখী মানুষ, সে সব জানিনে ছোটবাবু—বলিতে বলিতে সে সরিয়া পড়িল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া রমেশ গৃহে ফিরিয়া আসিল। এ যে বেণীর ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ তাহা জিজ্ঞাসা না করিয়াও সে বুঝিল। কিন্তু ক্রোধ কি জন্য এবং কিসের প্রতিহিংসা কামনা করিয়া সে কোন্‌ বিশেষ কদর্য ধারায় রমার অখ্যাতিকে প্রবাহিত করিয়া দিয়াছে, এ-সকল ঠিকমত অনুমান করাও তাহার দ্বারা সম্ভবপর ছিল না।

পরিচ্ছেদ – উনিশ

সেইদিন অপরাহ্নে একটা অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটিল। আদালতের বিচার উপেক্ষা করিয়া কৈলাস নাপিত এবং সেখ মতিলাল সাক্ষীসাবুদ সঙ্গে লইয়া রমেশের শরণাপন্ন হইল। রমেশ অকৃত্রিম বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করিল, আমার বিচার তোমরা মানবে কেন বাপু?

বাদী-প্রতিবাদী উভয়েই জবাব দিল, মানব না কেন বাবু, হাকিমের চেয়ে আপনার বিদ্যাবুদ্ধিই কোন্‌ কম? আর হাকিম হুজুর যা কিছু তা আপনারা পাঁচজন ভদ্রলোকেই ত হয়ে থাকেন! কাল যদি আপনি সরকারী চাকরি নিয়ে হাকিম হয়ে বসে বিচার করে দেন, সেই বিচার ত আমাদেরই মাথা পেতে নিতে হবে। তখন ত মানব না বললে চলবে না।

কথা শুনিয়া রমেশের বুক গর্বে আনন্দে স্ফীত হইয়া উঠিল। কৈলাস কহিল, আপনাকে আমরা দুজনেই দু’কথা বুঝিয়ে বলতে পারব; কিন্তু আদালতে সেটি হবে না। ত ছাড়া গাঁটের কড়ি মুঠো ভরে উকিলকে না দিতে পারলে সুবিধে কিছুতেই হয় না বাবু। এখানে একটি পয়সা খরচ নেই, উকিলকে খোসামোদ করতে হবে না, পথ হাঁটাহাঁটি করে মরতে হবে না। না বাবু, আপনি যা হুকুম করবেন, ভাল হোক মন্দ হোক, আমরা তাতেই রাজী হয়ে আপনার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরে যাব। ভগবান সুবুদ্ধি দিলেন, আমরা দুজনে তাই আদালত থেকে ফিরে এসে আপনার চরণেই শরণ নিলাম।

একটা ছোট নালা লইয়া উভয়ের বিবাদ। দলিল-পত্র সামান্য যাহা কিছু ছিল রমেশের হাতে দিয়া কাল সকালে আসিবে বলিয়া উভয়ে লোকজন লইয়া প্রস্থান করিবার পর রমেশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। ইহা তাহার কল্পনার অতীত। সুদূর ভবিষ্যতেও সে কখনো এত বড় আশা মনে ঠাঁই দেয় নাই। তাহার মীমাংসা ইহারা পরে গ্রহণ করুক বা না করুক, কিন্তু আজ যে ইহারা সরকারী আদালতের বাহিরে বিবাদ নিষ্পত্তি করিবার অভিপ্রায়ে পথ হইতে ফিরিয়া তাহার কাছে উপস্থিত হইয়াছে, ইহাই তাহার বুক ভরিয়া আনন্দস্রোত ছুটাইয়া দিল। যদিও বেশি কিছু নয়, সামান্য দুইজন গ্রামবাসীর অতি তুচ্ছ বিবাদের কথা, কিন্তু এই তুচ্ছ কথার সূত্র ধরিয়াই তাহার চিত্তের মাঝে অনন্ত সম্ভাবনার আকাশ-কুসুম ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার এই দুর্ভাগিনী জন্মভূমির জন্য ভবিষ্যতে সে কি না করিতে পারিবে তাহার কোথাও কোনো হিসাব-নিকাশ, কূল-কিনারা রহিল না। বাহিরে বসন্ত জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছিল, সেদিকে চাহিয়া হঠাৎ তাহার রমাকে মনে পড়িল। অন্য কোন দিন হইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সর্বাঙ্গ জ্বালা করিয়া উঠিত।

0 Shares