বামুনের মেয়ে

সন্ধ্যা হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, তোমার জাত নেই, ধর্ম নেই, কেন তুমি আমাকে ছুঁয়ে দিলে!

আমার জাত নেই? ধর্ম নেই?

না নেই। তুমি বিলেত গেছ—তুমি ম্লেচ্ছ। সেদিন মা তোমাকে পেতলের ঘটিতে জল খেতে দিয়েছিল, তোমার মনে নেই?

অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, না, আমার মনে নেই। কিন্তু তোমার কাছে আজ আমি অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছ!

সন্ধ্যা চোখ মুছিয়া কহিল, শুধু আমার কাছে নয়, সকলের কাছে। শুধু আজ নয়, যখন থেকে কারও নিষেধ শোনোনি—বিলেত চলে গেলে, তখন থেকে।

অরুণ কহিল, কিন্তু আমি মনে করেছিলাম—

কিন্তু কি মনে করিয়াছিল তাহা আর বলিতে পারিল না। নিমেষমাত্র স্থির থাকিয়া কহিল, আমি আর হয়ত এ-বাড়িতে আসব না, কিন্তু আমাকে তুমি ঘৃণা করো না সন্ধ্যা—আমি ঘৃণিত কাজ কখনো করিনি।

সন্ধ্যা কহিল, তোমার কি ক্ষিদে-তেষ্টা পায়নি অরুণদা? তুমি কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কেবল ঝগড়াই করবে?

অরুণ কহিল, না, ঝগড়া আমি করব না। যে ঘৃণা করে, তার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিবাদ করবার মত ছোট আমি নই। এই বলিয়া অরুণ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল,—সন্ধ্যা সেইদিকে একদৃষ্টে চাহিয়া যেন পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় বসিয়া রহিল।

মা সুমুখে আসিয়া প্রসন্নমুখে কহিলেন, যাক, আর বোধ হয় আসবে না?

সন্ধ্যা চকিত হইয়া বলিল, না।

মা বলিলেন, খামকা ছুঁয়ে দিলে, যা, কাপড়খানা ছেড়ে ফেল গে।

সন্ধ্যা মায়ের মুখের প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কাপড়খানা পর্যন্ত ছেড়ে ফেলতে হবে?

তাহার ম্লানমুখের অন্তরের ছবি জননীর চোখে পড়িল না, তিনি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, হবে না?

খ্রিস্টেন মানুষ—বিধবা গিন্নী-বান্নী হলে যে নেয়ে ফেলতে হতো! সেদিন রাসু-মাসী—হাঁ, বড়াই করে বটে—কিন্তু বিচের-আচার শিখতে হয় ত ওর কাছে। দুলে-ছুড়ী ছুঁলে কি ছুঁলে না, তবু নাতনীটাকে অবেলায় ডুব দিইয়ে তবে দোরে তুললে।

সন্ধ্যা কহিল, বেশ ত মা যাচ্চি।

মা ঘাড় নাড়িয়া বামনাই আচার-বিচার সম্বন্ধে বোধ হয় আরও কিছু উপদেশ দিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু পিছন হইতে ডাক শুনিলেন, জগো, ঘরে আছিস গা?

গোলোক চাটুয্যেমশায় একেবারে উঠানের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছিলেন; জগদ্ধাত্রী ফিরিয়া চাহিয়া সাড়া দিলেন, ও মা, চাটুয্যেমামা যে! কি ভাগ্যি!

কিন্তু সেদিনকার রাসু-মাসী ও কন্যার ঘটনাটা স্মরণ করিয়া তাঁহার মুখ শুষ্ক হইয়া উঠিল। সন্ধ্যা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, গোলোক মায়ের উত্তর না দিয়া মেয়েকেই সম্ভাষণ করিলেন, সহাস্যে কহিলেন, বলি আমার সন্ধ্যে নাতনী কেমন আছিস গো? যেন রোগা দেখাচ্ছে না?

সন্ধ্যা বলিল, না, ভালো আছি ঠাকুদ্দা।

জগদ্ধাত্রী শুষ্কমুখে একটু হাসি আনিয়া বলিলেন, হাঁ ভালই বটে! মাস ঘুরতে চলল মামা, রোজ অসুখ, রোজ জ্বর। আজও ত সাবু খেয়ে রয়েচে।

গোলোক কহিলেন, তাই নাকি? তা হবে না কেন বাছা,—কোথায় আজ ও কাঁখে-কোলে ছেলেপুলে নিয়ে ঘরকন্না করবে, না তোরা ওকে টাঙিয়ে রেখে দিলি! পাত্রস্থ করবি কবে? বয়স যে—

জগদ্ধাত্রী বয়সের কথাটা তাড়াতাড়ি চাপিয়া দিয়া বলিয়া উঠিলেন, কি করব মামা, আমি একা মেয়েমানুষ আর কতদিকে সামলাবো! তোমার জামাই গেরাহ্যি করে না—ডাক্তারি নিয়েই উন্মত্ত,—আমার এমন ধিক্কার হয় মামা, যে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শাশুড়ীর কাছে কাশীতে পালিয়ে গিয়ে থাকি। তারপরে যার যা কপালে আছে হোক।—বলিতে বলিতে তাঁহার কণ্ঠস্বর গদগদ হইয়া উঠিল!

গোলোক কহিলেন, পাগলাটা এখন করচে কি?

জগদ্ধাত্রী বলিলেন, তাই একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে গেলেও যে বাঁচি, ঘরে শিকল দিয়ে ফেলে রেখে দি। এ যে দু’য়ের বার—জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একেবারে খাক্‌ করে দিলে! এই বলিয়া তিনি চোখের কোণটা আঁচলে মুছিয়া ফেলিলেন।

গোলোক সহানুভূতির স্বরে বলিলেন, তাই বটে, তাই বটে—আমি অনেক কথাই শুনতে পাই। তা তোরাও ত বাপু, ধনুকভাঙ্গা পণ করে আছিস, স্বয়ং কার্তিক নইলে আর মেয়ের বিয়ে দেব না। আমাদের ভারী কুলীনের ঘরে তা কি কখনো হয়, না, হয়েচে বাছা? শুনিস নি, তখনকার দিনে কত কুলীনকে গঙ্গাযাত্রা করেও কুলীনের কুল রক্ষা করতে হতো? মধুসূদন তুমিই সত্য!

জগদ্ধাত্রী ক্ষুব্ধ হইয়া বলিলেন, কে তোমাকে বলেচে মামা, জামাই আমার ময়ূরে চড়ে না এলে মেয়ে দেব না? মেয়ে আগে, না কুল আগে? বংশে কেউ কখনো শূদ্দুর বলে কায়েতের ঘরে পা ধুলে না, আর আমি চাই কার্তিক। ছোট ঘরে যাব না এই আমার পণ—তা মেয়ে জলে ফেলে দিতে হয় দেব।

গোলোক খুশী হইয়া বলিলেন, এই ত কথা! আচ্ছা, আমি দেখচি।

যাই যাই করিয়াও সন্ধ্যা নতশিরে আরক্তমুখে দাঁড়াইয়াছিল। গোলোক তাহার প্রতি চাহিয়া সহাস্যে রহস্য করিয়া বলিলেন, কার্তিক যখন চাসনে জগো, তখন মেয়েকে না হয় আমার হাতেই দে না! সম্পর্কেও বাধবে না, থাকবেও রাজরানীর মত। কি বলিস নাতনী—পছন্দ হবে?

অন্য সময়ে হইলে সন্ধ্যা পরিহাসে যোগ দিতে পারিত, কিন্তু অরুণ হইতে আরম্ভ করিয়া পিতার প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়া পর্যন্ত সে ক্রোধে, দুঃখে, লজ্জায় জ্বলিয়া যাইতেছিল, মুখ তুলিয়া কঠিনভাবে জবাব দিল, পছন্দ কেন হবে না ঠাকুদ্দা? দড়ির খাটের চতুর্দোলায় চেপে আসবেন এই দিক দিয়ে, আমি মালা গেঁথে দাঁড়িয়ে থাকব তখন। এই বলিয়া সে দ্রুতপদে খিড়কির দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল।

সে যে ভয়ানক রাগ করিয়া গেল তাহা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ব্যর্থ পরিহাসের এই তীব্র লাঞ্ছনায় প্রথমটা গোলোক অবাক হইয়া গেলেন, পরে হাঃ হাঃ করিয়া খানিকটা কাষ্ঠহাসি হাসিয়া কহিলেন, মেয়ে ত নয়, যেন বিলিতি পল্টন! এ না হয় দাদা-নাতনী সম্পর্ক—বলতেও পারে, কিন্তু সেদিন রাসুর মুখে শুনলাম নাকি, যা মুখে এসেচে তাই বলেচে! মা-বাপ পর্যন্ত রেয়াত করেনি।

গোড়ায় জগদ্ধাত্রীর ঠিক এই ভয়ই ছিল, কেবল মাঝখানে আশা করিয়াছিলেন পরিহাসের মধ্য দিয়া বুঝি এবারের মত ফাঁড়া কাটিয়া গেল। হয়ত কাটিয়াই যাইত, শুধু মেয়েটাই আবার নিরর্থক খোঁচা মারিয়া বিবরের সর্পকে বাহিরে আনিয়া দিল। কন্যার প্রতি তাঁহার বিরক্তির অবধি রহিল না, কিন্তু প্রকাশ্যে সবিনয়ে কহিলেন, না মামা, সন্ধ্যা ত সে-সব কিছুই বলেনি। মাসী তিলকে তাল করেন, সে ত তুমি বেশ জানো!

0 Shares