বামুনের মেয়ে

প্রিয় রাগ করিয়া বলিলেন, কিন্তু আমি দিতে যাব কেন? গাঁয়ে কি আর মানুষ নেই?

বুড়ো ষষ্ঠীচরণ এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিল, এইবার সে ঘাড় নোয়াইয়া আর একটা প্রণাম করিয়া বলিল, যদি অভয় দেন ত বলি জামাইবাবু, এ গাঁয়ে আপনি ছাড়া আর মানুষ নেই। আপনি দয়া করেন ত, দশজনে চলে বাঁচবে, নইলে আমরা চাষী-মানুষ কোথায় পাব বাঁশ কেনবার টাকা?

প্রিয় একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, লোকজনের কি কষ্ট হচ্ছে নাকি?

ত্রৈলোক্য কহিল, মরে যাচ্ছে বাবাঠাকুর, হাত-পা ভেঙ্গে একেবারে মরে যাচ্ছে।

প্রিয় কহিলেন, কিন্তু গিন্নী শুনলে যে ভারী রাগ করবে!

ষষ্ঠীচরণ কহিল, আপনি দিলে মা-ঠাকরুন করবেন কি? তখন না হয় সবাই গিয়ে তাঁর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ব।

প্রিয় চিন্তিত-মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিলেন, লোকজনের কষ্ট হচ্চে, আচ্ছা নাও গে যাও—কিন্তু গিন্নী যেন শুনতে না পায়। উঃ—বড় বেলা হয়ে গেল—রস্‌কে বাগদীর পরিবারটা রাত্রে কেমন ছিল কে জানে! ব্রায়োনিয়ার অ্যাক্‌শনটা—নড়লে-চড়লে ব্যথা—হতেই হবে। আচ্ছা চললুম—চললুম। বলিয়া প্রিয় দ্রুতবেগে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

বুড়া ষষ্ঠীচরণ একটু হাসিল, কিন্তু ত্রৈলোক্য কহিল, ক্ষ্যাপাটে লোকে বলে বটে, কিন্তু খুড়ো, পাগলাঠাকুর ছাড়া গরীব-দুঃখীর দরদও কেউ বোঝে না। মন যেন গঙ্গাজলের মত সাদা। এই বলিয়া সে যেদিকে পাগলাঠাকুর অন্তর্হিত হইয়াছিল সেই দিকে মুখ করিয়া দুই হাত জোড় করিয়া একটা নমস্কার করিল।

ষষ্ঠীচরণ বলিল, হুকুম হয়ে গেল, আর দেরি নয় ত্রৈলোক্য, কাজটা শেষ করে ফেলতে পারলে হয়।

ত্রৈলোক্য ঘাড় নাড়িয়া কহিল, তাই চল খুড়ো।

পরিচ্ছেদ – দুই

সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, কিন্তু তখনও আলো জ্বালা হয় নাই। অরুণ তাহার পড়িবার ঘরের মধ্যে টেবিলের উপর দুই পা তুলিয়া দিয়া কড়িকাঠের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছিল। তাহার ক্রোড়ের উপর বই খোলা, কিন্তু একটু মনোযোগ করিলেই দেখা যাইত যে, এ কেবল সন্ধ্যার অজুহাতেই পড়া বন্ধ হয় নাই, বরঞ্চ আলো যখন যথেষ্ট ছিল, তখনও ঐ বই ওখানে অমনি করিয়াই পড়িয়া ছিল। বস্তুতঃ সেইদিন হইতে সে কাজেও যায় নাই, বাড়ির বাহির পর্যন্ত হয় নাই। এই কয়টা দিন তাহার কেবল একটা কথাই বার বার মনে পড়িয়াছে যে, একজনের কাছে সে একেবারে অস্পৃশ্য হইয়া গেছে! ঘৃণা এবং অশুচিতা এতদূরে গিয়াছে যে, তাহাকে ছুঁইয়া ফেলিলেও একজনের মুখের পান ফেলিয়া দিবার প্রয়োজন হয়!

সহসা তাহার চিন্তা বাধা পাইল। দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া সে চোখ নামাইয়া ঠাহর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে ওখানে?

আমি সন্ধ্যা,—বলিয়া সাড়া দিয়া সন্ধ্যা দরজা খুলিয়া চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইল।

অরুণ ব্যস্ত হইয়া পা নামাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং একান্ত বিস্ময়ের কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তুমি এখানে? এমন সময়ে যে? ঘরে এসে বসো।

সন্ধ্যা কহিল, আমার বসবার সময় নেই। আমি পুকুরে গা ধুতে এসে তোমার এখানে লুকিয়ে এসেচি। আমাদের একটা মান রাখবে অরুণদা?

অরুণ অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিল, মান? তোমাদের? নিশ্চয় রাখব সন্ধ্যা।

তা আমি জানতুম, বলিয়া সন্ধ্যা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, বাবার কাছে শুনলুম এ ক’দিন তুমি কাজে যাওনি, বাড়ি থেকে পর্যন্ত বেরোও নি—কেন শুনি?

আমার শরীর ভাল নেই।

সন্ধ্যা কহিল, না থাকা আশ্চর্য নয়, কিন্তু তা নয়। বাবা তা হলে সকলের আগে সেই কথাটাই বলতেন।

অরুণ চুপ করিয়া রহিল। সন্ধ্যা নিজেও একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনশ্চ কহিল, কারণ আমি জানি অরুণদা। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তুমি আর কখনো যেয়ো না।

অরুণ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না—শুধু কেবল তোমাদের বাড়িতে নয়—এ গ্রামের বাস তুলে দিয়ে আর কোথাও যাব কিনা, যেথায় বিনাদোষে মানুষে মানুষকে এত হীন, এত লাঞ্ছিত করে না—আমি সেই কথাই দিনরাত ভাবচি।

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া বলিয়া উঠিল, জন্মভূমি ত্যাগ করে চলে যাবে?

অরুণ কহিল, জন্মভূমিই ত আমাকে ত্যাগ করচে সন্ধ্যা। আজ তোমার কাছেও আমি এমন অশুচি হয়ে গেছি যে, তোমাকেও মুখের পান ফেলে দিতে হলো। এই ঘৃণা সয়েও কি আমাকে তুমি এই গ্রামে থাকতে বল?

সন্ধ্যা নিরুত্তরে অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। অরুণ কহিল, আচারের নাম নিয়ে এই চিরাগত সংস্কার তোমাদের মনটাকে হয়ত আর স্পর্শ পর্যন্ত করে না, কিন্তু যেখানে করে, সেখানে মানুষের হাত থেকে মানুষের এই লাঞ্ছনা মানুষকে যে বেদনায় কতদূর বিদ্ধ করতে পারে, এই কথাটা যে একদিন আমাকে এমন করে অনুভব করতে হবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, কিন্তু এ লাঞ্ছনা কি তুমি নিজেই টেনে আনোনি অরুণদা?

অরুণ কহিল, কি জানি। কিন্তু, আচ্ছা সন্ধ্যা, প্রায়শ্চিত্ত করলে কি এর কোন উপায় হয় বলতে পার?

সন্ধ্যা বলিল, হতে পারে, কিন্তু একদিন আত্মমর্যাদা হারাবার ভয়ে তুমি রাজী হওনি—আবার আজ যদি নিজেই তাকে বিসর্জন দাও ত, আমি বলি অরুণদা, তুমি আর যাই কর, এখানে আর থেকো না।

অরুণ কহিল, কিন্তু তোমার ঘৃণা যে সেখানেও আমাকে টিকতে দেবে না!

কিন্তু তাতেই বা তোমার কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি?

অরুণ কহিল, সন্ধ্যা! এ কথা তুমিও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলে?

সন্ধ্যা বলিল, তুমি যে আমার লজ্জার, আমার সঙ্কোচের আবরণটুকু রাখতে দিলে না অরুণদা। আভাসে ইঙ্গিতে তোমাকে কতবার জানিয়েচি সে কিছুতেই হয় না, তবুও তোমার ভিক্ষার জবরদস্তি যেন কোনমতেই শেষ হতে চায় না। বাবা রাজী হতে পারেন, মাও ভুলতে পারেন, কিন্তু আমি ভুলতে পারিনে আমি কতবড় বামুনের মেয়ে!

অরুণ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, আর আমি?

সন্ধ্যা বলিল, তুমিও আমার স্বজাতি—কিন্তু তবুও বাঘ আর বেড়াল ত এক নয় অরুণদা! কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেই যেন মনে মনে শিহরিয়া উঠিল।

0 Shares