বামুনের মেয়ে

অরুণ আর কথা কহিল না, কেবল তাহার মুখের উপর হইতে নিজের বিস্মিত, ব্যথিত চোখ দুটি সরাইয়া লইল।

সন্ধ্যা জোর করিয়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, তুমি যেখানেই যাও না অরুণদা, আমাকে কিন্তু সহজে ভুলতে পারবে না। অনেককাল তোমার মনে থাকবে, বার বার এত অপমান তোমাকে কেউ করেনি।

অরুণ মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি যে-জন্যে এসেছিলে তা ত এখনো বলনি?

সন্ধ্যা প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসিল। একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, পৃথিবীতে আশ্চর্যের আর অন্ত নেই। তারপরে কি একটা বলিতে গিয়া হঠাৎ থামিয়া গিয়া কহিল, অথচ আমার মান তুমি না রাখলে পৃথিবীতে আর কেউ রাখবার নেই। এ তোমার বিশ্বাস হয় অরুণদা?

অরুণ শুধু নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

সন্ধ্যা কহিল, এককড়ি দুলের বিধবা স্ত্রীকে আর তার মেয়েকে এককড়ির বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমার বাবা তাদের ডেকে এনেচেন। আমি দিয়েছি তাদের আশ্রয়।

কোথায়?

আমাদের পুরানো গোয়ালঘরে। কিন্তু বামুনপাড়ার মধ্যে তারা থাকতে পাবে না।

অরুণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

সন্ধ্যা বলিল, কেন কি? তারা যে দুলে! তারা আমাদের পুকুরঘাট থেকে খাবার জল নেয়, তারা পথের ওপর ছাগলকে ফ্যান খাওয়ায়—গোলোকঠাকুর্দা না জেনে পাছে মাড়িয়ে ফেলেন—মা প্রতিজ্ঞা করেছেন কাল সকালে তাদের ঝাঁটা মেরে বিদায় করে তবে স্নান করবেন। তুমি তাদের স্থান দাও অরুণদা—তাদের কিছু নেই—তারা একেবারে নিরাশ্রয়।

অরুণ কহিল, বেশ, কিন্তু কোথায় স্থান দেব?

সন্ধ্যা বলিল, তা আমি জানিনে—যেখানে হোক। তুমি ছাড়া আর আমি কাকে গিয়ে বলব?

অরুণ একটু ভাবিয়া বলিল, আমার উড়ে মালীটা বাড়ি চলে গেছে—তার ঘরটাতে কি তারা থাকতে পারবে? না হয় একটু-আধটু সারিয়ে দেব।

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া কথা কহিতে পারিল না, কেবল অধোমুখে মাথা নাড়িয়া তাহার সম্মতি জানাইল।

অরুণ কহিল, তা হলে তাদের পাঠিয়ে দাও গে। মালীটা ফিরে এলে তার অন্য ব্যবস্থা করে দেব।

সন্ধ্যা ইহারও জবাব দিতে পারিল না। তেমনি নতনেত্রে থাকিয়া বোধ হয় আপনাকে সামলাইতে লাগিল। তারপর আস্তে আস্তে বলিল, এখন আমার মুখেও পান নেই, গা ধুতেও এসেছিলাম। এই সময়ে তোমাকে একটু প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিয়ে যাই। এই বলিয়া সে গড় হইয়া নমস্কার করিয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় দিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

অরুণ তাহাকে ফিরিয়া ডাকিবার, বা আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার চেষ্টা করিল না, কেবল সেইদিকে চাহিয়া সে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

বোধ করি দিন-দুই পরে হইবে, জগদ্ধাত্রী তাঁহার পুষ্করিণী হইতে স্নান করিয়া বাড়ি ফিরিতেছিলেন, পথের মধ্যে রাসমণি দেখা দিলেন। তাঁহার সমস্ত চোখমুখ উত্তেজনা ও আগ্রহের আতিশয্যে কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিয়াছে; কাছে আসিয়া অশ্রু-গদগদকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, জাগো, মা আমার, তোর ঐ পাগলি মেয়েটা কি শেষে এমন তপিস্যেই করেছিল। অ্যাঁ, এ যে স্বপনের অতীত!

জগদ্ধাত্রী কিছুই বুঝিলেন না, কিন্তু এঁর মুখে কেবল মেয়েটার নাম শুনিয়াই মনে মনে ভয় পাইলেন। উদ্‌গ্রীব হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েচে মাসী? কি করেচে সন্ধ্যে?

রাসমণি বলিলেন, যা করেচে তা পৃথিবীতে কোন্‌ মেয়ে কবে করেচে শুনি? যা ভিজে কাপড়ে, ভিজে চুলে গিয়ে শ্রীধরকে সাষ্টাঙ্গে নমস্কার কর্‌ গে। পঞ্চাননের আর বিশালাক্ষীর স্থানে পূজো পাঠিয়ে দি গে। কিন্তু আমাকে বাছা, ইষ্টিকবজখানি গলায় ধারণ করতে একটি সরু সোনার গোট করিয়ে দিতে হবে, তা কিন্তু আগে থেকে বলে রাখচি।

জগদ্ধাত্রী আকুল হইয়া কহিলেন, কি হয়েছে মাসী? খুলে না বললে বুঝব কি করে?

রাসমণি একটু হাসিয়া বলিলেন, খুলে বলতে হবে? তবে বলি। তোরা মায়ে-ঝিয়ে ঢের পুণ্যি করেছিলি, নইলে এ কখনো হয় না। ভেবে মরছিলি মেয়েটার বিয়ে দিবি কি করে,—এখন যাএকেবারে রাজার শাশুড়ী হয়ে বস গে।

কথা শুনিয়া জগদ্ধাত্রী দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া চাহিয়া রহিলেন।

রাসমণি সদয়কণ্ঠে কহিলেন, তোর একার দোষ নেই জগো, শুনে আমিও অমনি করে চেয়েছিলুম, মনে হলো বুঝি-বা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপন দেখচি।

জগদ্ধাত্রী বলিলেন, খুলে বল না মাসী কি হয়েচে? আমি যে আকাশপাতাল ভেবে মরে গেলুম।

রাসমণি তখন জগদ্ধাত্রীর বাম বাহুটা নিজের মুঠার মধ্যে গ্রহণ করিয়া কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিসফিস করিয়া বলিলেন, কথা গোপন রাখিস মা, আহ্লাদে এখুনি জানাজানি করে ফেলিস নে—ভাঙচি পড়ে যেতে পারে। আমাকে ছাড়া নাকি চাটুয্যেদাদা আর জনপ্রাণীকে বিশ্বাস করেন না, তাই সকালেই ডেকে আমাকে বললেন, রাসু, জগদ্ধাত্রীকে খবরটা দিয়ে এসো গে দিদি। তার মেয়ের জন্যে আর ভেবে মরতে হবে না—আমার হাতেই সঁপে দিয়ে একেবারে রাজার শাশুড়ী হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে ঘরে বসুক গে। মনে ভাবলাম, আমারও ত বৈকুণ্ঠপুরী শূন্য খাঁখাঁ করচে—ছেলেটাও মানুষ হচ্ছে না—যাক্‌, এক কাজে দু’কাজ হবে। একটা ব্রাহ্মণের কুলরক্ষাও করা হবে, গাঁয়ের মেয়ে গাঁয়েই থাকবে। তাদেরও ত সবেমাত্র ওই মেয়েটি—

কিন্তু কথাটাকে তিনি রাজার ভাবী শাশুড়ীর মুখের দিকে চাহিয়া আর শেষ করিতে পারিলেন না। শুনিতে শুনিতে জগদ্ধাত্রী একেবারে যেন কাঠ হইয়া গিয়াছিলেন।

রাসমণি ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, কি হলো রে জগো?

জগদ্ধাত্রী নিজেকে সামলাইয়া লইয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, নাঃ—মাসী, গোলোকমামা তোমাকে তামাশা করেচেন।

তামাশা কি লো? এতটা বয়স হলো তামাশা কাকে বলে জানিনে? তা ছাড়া ভাই-বোনে তামাশা?

জগদ্ধাত্রী কহিলেন, তামাশা বৈ কি মাসী? একি কখন হতে পারে?

রাসমণি একটু হাসিলেন, বলিলেন, তা সত্যি বাছা—আমারও প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, বুঝি-বা স্বপনই দেখচি। কিন্তু পরেই বুঝলাম, না, জেগেই আছি। মেয়েটার অদৃষ্ট বটে! নইলে কুলীনের মেয়ের ভাগ্যে এ কেউ কখনো দেখেচে না শুনেচে। আশীর্বাদ করি জন্ম-এয়োস্ত্রী হয়ে থাক, কিন্তু যা যা বলে দিলুম আজকেই কর গে বাছা। আর কথাটা না যেন পাঁচ-কান হয়। আগে ভালোয় ভালোয় আশীর্বাদটা হয়ে যাক।

0 Shares