বামুনের মেয়ে

জগদ্ধাত্রী কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, তুমি মেয়ের বিয়ে কি দেবে না ঠিক করেছ?

প্রিয় কাজ করিতে করিতে বলিলেন, দেব না? নিশ্চয়ই দেব।

কবে দেবে? শেষে একটা কিছু হয়ে গেলে দেবে?

হুঁ।

জগদ্ধাত্রী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া কহিলেন, রসিকপুরে যাও না একবার!

প্রিয় খোলা পাতার একটা স্থান আঙুল দিয়া চাপিয়া মুখ তুলিয়া চাহিলেন, কহিলেন, রসিকপুরে? কার কি হয়েচে? কেউ খবর দিয়ে গেছে নাকি? কখন দিয়ে গেল?

জগদ্ধাত্রী একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, জয়রাম মুখুয্যের নাতির সঙ্গে যে বিয়ের একটা কথা হয়েছিল, যাও না, গিয়ে একবার পাত্রটিকে দেখেই এসো না।

প্রিয় কহিলেন, কিন্তু যাই কখন? দেখলে ত, একটা বেলা না থাকলে কি কাণ্ড হয়ে যায়। অরুণের ওই দশা, আবার চাটুয্যেমশায়ের ওখান থেকে খবর দিয়ে গেছে তাঁর শ্যালীর নাকি ভারী অসুখ।

জগদ্ধাত্রী কিছু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কার, জ্ঞানদার অসুখ? কি হ’ল আবার তার?

প্রিয় বলিলেন, অম্বল! অম্বল! খাবার দোষে অজীর্ণ রোগ। কেবল গা বমি-বমি—অরুণের ওখান থেকে ফিরে গিয়ে একটি ফোঁটাই—

জগদ্ধাত্রী বলিলেন, তাঁদের ওষুধ দেবার ঢের লোক আছে। তোমার পায়ে পড়ি, একবার যাও রসিকপুরে। পাত্রটিকে একবার দেখে এসে যা হোক করে মেয়েটার একটা উপায় কর।

গৃহিণীর অশ্রুবিকৃত কণ্ঠস্বর বোধ করি প্রিয়বাবুকে কথঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ করিল। কহিলেন, কিন্তু পাত্রটি যে শুনি ভারী বকাটে! কেবল নেশা-ভাঙ—

জগদ্ধাত্রী আর ধৈর্য রক্ষা করিতে পারিলেন না। সহসা কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, করুক নেশা-ভাঙ, হোক গে বকাটে, তবু মেয়েটা দু’দিন নোয়া-সিঁদুর পরতে পাবে। তুমি কি? তোমার হাতে আমার বাপ-মা যদি মেয়ে দিতে পেরে থাকেন, তুমিই বা পারবে না কেন?

এই বলিয়া তিনি অঞ্চলে চোখ মুছিতে মুছিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।

প্রিয় অবাক হইয়া ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন, তাহার পরে বইখানি মুড়িয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া কহিলেন, দু-দুটো সাঙ্ঘাতিক রোগী হাতে—এমনধারা করলে কি রেমিডি সিলেক্ট করা যায়! বলিয়া পুনশ্চ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বইটা বগলে চাপিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।

স্নান, পূজাহ্নিক এবং যথাবিহিত সাত্ত্বিক জলযোগাদি সমাপনান্তর মূর্তিমান ব্রহ্মণ্যের ন্যায় গোলোক চাটুয্যেমহাশয় ধীরে ধীরে অবতরণ করিলেন, এবং বোধ হয় সোজা বাহিরেই যাইতেছিলেন, হঠাৎ কি মনে করিয়া পাশের বারান্দাটা ঘুরিয়া ভাঁড়ার ঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং অত্যন্ত অকস্মাৎ উদ্বেগে পরিপূর্ণ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, অ্যাঁ, এ-সব কি হচ্চে বল দিকি ছোটগিন্নী? অসুখ শরীরে গৃহস্থালীর ছাই-পাঁশ খাটুনিগুলো কি না খাটলেই নয়? তাই আমি বলি! আচ্ছা, দেহ আগে, না কাজ আগে?

জ্ঞানদা বঁটি পাতিয়া তরকারি কুটিতেছিল, কুটিতেই লাগিল। তাঁহার কাষ্ঠ-পাদুকার বিকট খটাখট শব্দও যেমন তাহার কানে যায় নাই, তাঁহার উৎকণ্ঠিত অনুযোগও তেমনি যেন তাহার কানে গেল না।

গোলোক একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিলেন, ব্যাপার কি? আজ সকালে আছ কেমন?

জ্ঞানদা মুখ তুলিল না, হাতের বেগুনটার প্রতি চোখ রাখিয়াই ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, ভালো।

গোলোক অতিশয় আশ্বস্ত হইলেন, কহিলেন, ভালো, ভালো। আমি জানি কিনা, প্রিয় হোক ক্ষ্যাপা-পাগলা কিন্তু ওষুধ দেয় যেন ধন্বন্তরি! কিন্তু যেমন বলে যাবে টাইম-মত খেতে হবে। তাচ্ছিল্য করলে চলবে না তা কিন্তু বলে যাচ্চি।

জ্ঞানদা এত কথার কোন জবাব দিল না, অধোমুখে কাজ করিতেই লাগিল।

গোলোক কিছুক্ষণ তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া কহিলেন, প্রিয়কে বিশেষ করে বলে দিয়েচি দুটি বেলা এসে দেখে যাবে—সকালে এসেছিল ত?

জ্ঞানদা তেমনি নতমুখেই মাথা নাড়িয়া জানাইল, হাঁ।

গোলোক খুশী হইয়া বলিলেন, আসবে বৈ কি! আসবে বৈ কি! সে যে আমার ভারী অনুগত। কিন্তু ঝি বেটী গেল কোথায়? সে যাবে ওষুধ দিয়ে, আর তুমি এদিকে খেটে খেটে শরীর পাত করবে, তা আমি হতে দিতে পারব না। বলি, গেল কোথা সব? থাক এ-সব পড়ে। যাও ওপরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করগে—মধুসূদন! তুমিই ভরসা! এই বলিয়া গোলোক পরের এবং নিজের লৌকিক ও পারলৌকিক উভয় কর্তব্যই আপাততঃ শেষ করিয়া বাহিরে যাইবার উদ্যোগ করিলেন।

তাঁহার খড়মের একটুখানি শব্দে চকিত হইয়া এতক্ষণে জ্ঞানদা মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার মুখে সেদিনের সেই প্রসন্ন হাসিটুকু আজ নাই, আজ তাহা চিন্তা ও বিষাদের ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন। চোখ দুটি আরক্ত, পল্লবপ্রান্তে অশ্রুর আভাস যেন তখনও বিদ্যমান—সেই সজল দৃষ্টি গোলোকের মুখের প্রতি স্থির করিয়া অকস্মাৎ গাঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তুমি কি প্রিয়বাবুর মেয়ে সন্ধ্যাকে বিয়ে করতে চেয়েচ? আমাকে ঠকিয়ো না, সত্যি বল?

গোলোক থতমত খাইয়া হঠাৎ জবাব দিতে পারিলেন না, কিন্তু পরক্ষণেই বলিয়া উঠিলেন, আমি? সন্ধ্যাকে? নাঃ! কে বললে?

জ্ঞানদা কহিল, যেই বলুক। রাসুদিদিকে তুমি তার মায়ের কাছে পাঠিয়েছিলে? সামনের অঘ্রানে সমস্ত স্থির হয়ে গেছে? ভগবানের দোহাই, সত্যি কথা বল।

গোলোক অস্ফুট তর্জনে শাসাইয়া বলিলেন, রাসী-বামনী বলে গেছে? আচ্ছা দেখছি তাকে! আমি—

জ্ঞানদা বলিয়া উঠিল, কেন তবে তুমি আমার এ সর্বনাশ করলে? মুখ দেখাবার, দাঁড়াবার যে আর আমার কোথাও স্থান নেই,—বলিতে বলিতেই তাহার বিকৃতকণ্ঠ বুক-ফাটা ক্রন্দনে একেবারে সহস্রধারে ফাটিয়া পড়িল।

গোলোক ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। চারিদিকে সভয় দৃষ্টিপাত করিয়া হাত তুলিয়া চাপা গলায় বলিতে লাগিলেন, আহা হা! কর কি, কর কি! লোকজন শুনতে পাবে যে মিছে—মিছে—মিছে কথা গো! ঠাট্টা—

জ্ঞানদা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, না কখ্খনো ঠাট্টা নয়—কখ্খনো এ মিথ্যে নয়। এ সত্যি। এ সত্যি। তুমি সব পার। তোমার অসাধ্য কাজ নেই।

0 Shares