বামুনের মেয়ে

না না বলচি, এ ঠাট্টা—তামাশা—নাতনী সুবাদে—আহা হা! চুপ কর না—ঝি-চাকর এসে পড়বে যে! বলিতে বলিতে গোলোক খটখট করিয়া শশব্যস্তে পলায়ন করিলেন।

জ্ঞানদার হাতের বেগুন হাতেই রহিল, সে মুখের মধ্যে অঞ্চল গুঁজিয়া দিয়া উচ্ছ্বসিত রোদন প্রাণপণে নিরোধ করিল।

বাটীর দাসী হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া জানাইল, মাসীমা, ঝি সঙ্গে করে কানা দাদামশাই যে স্বয়ং এসে হাজির গো!

জ্ঞানদা তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা-মুখে চাহিল। তাহার অশ্রু-কলুষিত ব্যথিত দৃষ্টির সম্মুখে দাসী বিস্ময়ে লজ্জায় বলিল, তোমাদের সেই পুরোনো ঝিকে সঙ্গে নিয়ে তোমার শ্বশুরমশাই এসেচেন মাসীমা। কি হয়েচে গা?

খবর শুনিয়া জ্ঞানদার মুখের উপর রক্তের লেশমাত্রও যেন আর রহিল না। মুখোমুখি মৃত্যুকে দেখিয়াও মানুষ বোধ হয় এমন পাণ্ডুর হইয়া যায় না।

দাসী ভীত হইয়া কহিল, কি হয়েচে মাসীমা?

জ্ঞানদা ইহারও উত্তর দিল না, কেবল বিহ্বল শূন্যদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

দাসী পুনরায় বলিল, তোমার কি কোন অসুখ করেচে মাসীমা?

এতক্ষণে জ্ঞানদা মাথা নাড়িয়া কহিল, হাঁ। বাবা কতক্ষণ এসেচেন কালী?

ঝি বলিল, সে ত জানিনে মাসীমা। এইমাত্র দেখলুম তিনি উঠানে দাঁড়িয়ে বাবুর সঙ্গে কথা কইচেন।

জ্ঞানদা আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবুর সঙ্গে?

ঝি বলিল, হাঁ। আমি বাইরে থেকে আসছিলুম, বাবু ডেকে বলে দিলেন, কালী, তোমার মাসীমাকে খবর দাও গে তাঁর শ্বশুরমশাই তাঁকে নিতে এসেছেন। ও মা, ঐ যে নিজেই আসচেন! বলিয়া ঝি একটুখানি সরিয়া দাঁড়াইল। পরক্ষণেই লাঠির শব্দে বুঝা গেল এ লাঠি যাঁর তাঁকে চোখের চেয়ে লাঠির উপরে চলাচলের পথটা অধিক নির্ভর করিতে হয়।

পরক্ষণেই একটি মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকের পশ্চাতে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি লাঠির দ্বারা পথ ঠাহর করিতে করিতে প্রবেশ করিলেন এবং ডাকিয়া বলিলেন, আমার মা কোথায় গো?

জ্ঞানদা উঠিয়া আসিয়া তাঁহার পদতলে গলবস্ত্র হইয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বৃদ্ধ মানুষ চিনিতে না পারিলেও চেহারাটা দেখিতে পাইতেন। তিনি আশীর্বাদ করিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, বুড়ো-বুড়ীকে এমন করে ভুলে কি করে আছিস মা?

যে স্ত্রীলোকটি সঙ্গে আসিয়াছিল সে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, তা সত্যি বৌদিদি। বুড়ো শাশুড়ী মরে, কেবল মুখে তাঁর—আমার বৌমাকে নিয়ে এসো—আমার বৌমাকে এনে দাও। কেমন করে এতদিন ভুলে আছ বল ত?

জ্ঞানদা এ অভিযোগের কোন জবাব দিল না। কেবল এক হাতে অশ্রু মুছিতে মুছিতে অন্য হাতে বৃদ্ধ শ্বশুরের হাত ধরিয়া তাঁহাকে বারান্দায় আনিল, এবং স্বহস্তে আসন পাতিয়া তাঁহাকে বসাইয়া দিয়া নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

বৃদ্ধ উপবেশন করিয়া বলিতে লাগিলেন, চাটুয্যেমশাইকে দু’খানা চিঠি দিলাম। কিন্তু একটারও জবাব পেলাম না। মনে ভাবলাম, তিনি বড়লোক, নানা কাজ তাঁর, আমাদের মত গরীবকে উত্তর দেবার কথা হয়ত তাঁর মনেই নেই। কিন্তু মা ত আমার এই দুঃখীরই ঘরের লক্ষ্মী—

যে দাসী সঙ্গে আসিয়াছিল অসম্পূর্ণ কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিল, হলেই বা ভগিনীপতি বড়লোক, তাই বলে ঘরের বৌকে আর কে কতদিন পরের বাড়ি ফেলে রাখতে পারে, বৌদিদি? তা ছাড়া, যার সেবা করতে আসা, সেই বোনই যখন মারা গেল! আমি বলি—

বৃদ্ধ বাধা দিয়া বলিলেন, থাক সদু ওসব কথা। তোমার শাশুড়ীঠাকরুন, বৌমা, বড় পীড়িত। আজ দিন ভালো দেখেই তিনি পাঠিয়ে দিলেন যে আমার বৌমাকে একবার—

সদু বলিল, বৌদিদি, তোমার জন্যেই বুঝি প্রাণটা তাঁর বেরুচ্চে না। আজ ক’দিন থেকে কেবল বলচেন—সদু, মা আমার, যা তুই একবার এঁকে নিয়ে। এনে একবার দেখা আমার মাকে। বলিতে বলিতে সদুর গলা করুণায় আর্দ্র হইয়া উঠিল।

বৃদ্ধ কহিলেন, চাটুয্যেমশায় যে আমার চিঠি দুটো পাননি, তা ত আর আমরা জানিনে।

আমরা কত কথাই না তোলাপাড়া করছিলাম। বড় ভালো লোক—সাধু ব্যক্তি। শুনেই বললেন, বিলক্ষণ! আপনাদের বৌ আপনারা নিয়ে যাবেন তাতে বাধা দেবে কে? পালকি বেহারা বলে দিলেন। তোমার শাশুড়ীর অসুখ শুনে দুঃখ করে বার বার বলতে লাগলেন, আমার বড় বিপদের দিনে জ্ঞানদাকে আপনারা পাঠিয়েছিলেন, এখন আপনাদের বিপদের সময় এমন পাষণ্ড সংসারে কে আছে যে তাকে ফিরে পাঠাতে আপত্তি করবে! এখ্‌খুনি নিয়ে যান, আমি সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিচ্চি।

জ্ঞানদা এতক্ষণ একেবারে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া ছিল, অকস্মাৎ বিবর্ণমুখে বলিয়া উঠিল—চাটুয্যেমশাই বললেন এই কথা? এখ্‌খুনি পাঠাবেন? আজই?

সৌদামিনী খুশী হইয়া কহিল, হাঁ—বললেন বৈ কি। বরঞ্চ এমনও বলে দিলেন যে, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লে তিনটের গাড়ি ধরে অনায়াসে কাল সকাল নাগাদ বাড়ি পৌঁছান যাবে। তা ছাড়া ঘরে মর-মর রোগী, কোথাও কি একটা দিনও দেরি করবার জো আছে বৌদিদি! আহা! বুড়ী যেন কেবল হা-পিত্যেস করে তোমার পথ চেয়ে আছে!

জ্ঞানদা কেবল যেন কলের পুতুলের মত তাহার পূর্ব-কথাটাই আবৃত্তি করিতে পারিল। কহিল, উনি বললেন পাঠাবেন? আজই?

বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, হাঁ মা, আজই বৈ কি! থাকবার ত জো নেই।

কিন্তু সৌদামিনী বিরক্ত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার কণ্ঠস্বরে তাহা অপ্রকাশও রহিল না। কহিল, শোন কথা একবার। শাশুড়ী মরে—যার ঘরের বৌ তিনি নিজে এসেচেন নিতে—কে পাঠাবে না শুনি? তা ছাড়া, আর থাকাই বা এখানে কিজন্যে? ভালো, তোমার ভগ্নীপতিকে জিজ্ঞেসা করেই না হয় পাঠাও না বৌদিদি?

কিন্তু পাঠাইতে হইল না। বোধ করি কাছেই কোথাও তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন, খটখট করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভাবটা তাঁহার অত্যন্ত ব্যস্ত। বৃদ্ধকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, না মুখুয্যেমশাই, বসে গল্প করলে চলবে না। বেলা বেড়ে যাচ্ছে, স্নানাহ্নিক সেরে আহারাদির পরে একটু বিশ্রাম করে বেরুতেই সময় হয়ে যাবে। ওদিকে আবার বারবেলা পড়বে। বিলক্ষণ! পাঠাতে আপত্তি! আমাদের না হয় একটু কষ্টই হবে, তা বলে—সে কি কথা! শাশুড়ীঠাকরুনের অত বড় ব্যারাম, আমার যে সহস্র ঝঞ্ঝাট—এতটুকু ফুরসত নেই, নইলে যে নিজে গিয়ে জ্ঞানদাকে রেখে আসতাম! চিঠি কি একটাও পেলাম! তা হলে আপনাকে নাকি আবার কষ্ট করে আসতে হয়? পিয়ন বেটারা সব হয়েচে—কালী কোথায় গেলি? ভুলোকে না হয় এইখানেই বল্‌ না এক কল্‌কে তামাক দিয়ে যেতে। নিন মুখুয্যেমশাই, আর দেরি নয়, উঠুন। জ্ঞানদা, একটুখানি চটপট নাও দিদি—ওদিকে আবার তিনটের গাড়ি ধরাই চাই। আঃ—চোঙদারটা আবার বাইরে বসে—গিন্নী স্বর্গীয় হওয়া থেকে কি যে মন হয়েচে মুখুয্যেমশাই, কিছু মনেই থাকে না। মধুসূদন! তুমিই ভরসা! তুমিই ভরসা! বলিতে বলিতে গোলোক চাটুয্যেমশাই যে পথে আসিয়াছিলেন সেই পথে সমস্ত বাড়িটা খড়মের কঠোর শব্দে মুখরিত করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

0 Shares