বামুনের মেয়ে

জগদ্ধাত্রী হাতের কাজ রাখিয়া দিয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া অত্যন্ত কঠোরস্বরে মেয়েকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, তুই ঠাকুরঘরে যাবি, না আমি কাজকর্ম ফেলে রেখে উঠে যাবো সন্ধ্যা?

সন্ধ্যা মায়ের মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু কথাও কহিল না, উঠিবারও চেষ্টা করিল না।

ধীরে ধীরে পিতামহীকে জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু, যে জিনিসটার এত সম্মান—এতদিন ধরে এমনভাবে চলে আসচে ঠাকুরমা, তাকে কি নষ্ট হতে দেওয়াই ভাল?

এবার শাশুড়ীও বধূর রুক্ষ-কথায় বিশেষ কর্ণপাত করিলেন না। নাতিনীর প্রশ্নের জবাবে বলিলেন, কিছু একটা দীর্ঘদিন ধরে কেবল চলে আসচে বলেই তা ভাল হয়ে যায় না দিদি, সম্মানের সঙ্গে হলেও না। মাঝে মাঝে তাকে যাচাই করে বিচার করে নিতে হয়। যে মমতায় চোখ বুজে থাকতে চায় সে-ই মরে। আমার সকল কথা কাউকে বলবার নয় ভাই, কিন্তু এ নিয়ে সমস্ত জীবনটাই না কি আমাকে অহরহ বিষের জ্বালা সইতে হয়েছে,—বলিতে বলিতে তাঁহার গলা যেন ভিতরের অব্যক্ত যাতনায় বুজিয়া আসিল।

সন্ধ্যা তাঁহার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, থাক গে ঠাকুরমা এ-সব কথা।

তিনি অন্য হাত দিয়া পৌত্রীকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া নীরবে আপনাকে আপনি একমুহূর্তেই সংবরণ করিয়া ফেলিলেন, তারপর সহজকণ্ঠে ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, সন্ধ্যা, দেশের রাজা একদিন শুধু গুণের সমষ্টি ধরেই ব্রাহ্মণকে কৌলীন্য-মর্যাদা দিয়ে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন, তারপরে আবার এমন দুর্দিনও একদিন এসেছিল যেদিন এই দেশেরই রাজার আদেশে তাঁদের বংশধরদের কেবল দোষের সংখ্যা গণনা করেই মেলবদ্ধ করা হয়েছিল। যে সম্মানের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ত্রুটি এবং অনাচারের উপর, তার ভিতরের মিথ্যেটা যদি জানতে দিদি, তা হলে আজ যে বস্তু তোমাদের এত মুগ্ধ করে রেখেচে, শুধু কেবল সেই কুল নয়—ছোটজাত বলে যে দুলে-মেয়ে দুটোকে তোমরা তাড়িয়ে দিলে, তাদেরও ছোটো বলতে তোমাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হতো।

জগদ্ধাত্রী ক্রোধ এবং বিরক্তি আর সহ্য করিতে না পারিয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন, কিন্তু সন্ধ্যা চুপ করিয়া সেইখানেই বসিয়া রহিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, তাহার সত্যবাদিনী সন্ন্যাসিনী পিতামহী ভিতরের কি একটা অত্যন্ত লজ্জা ও ব্যথার ইতিহাস কিছুতেই প্রকাশ করিতে পারিতেছেন না, কিন্তু তাঁহার বুক ফাটিতেছে। তাহার হঠাৎ মনে হইল, তাহার পিতামহের বহুবিবাহের সহিত ইহার কি যেন একটা ঘনিষ্ঠ সংস্রব আছে।

খানিকক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া সে সলজ্জে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, সত্যিই কি ঠাকুরমা, আমাদের মধ্যে খুব বেশি অনাচার প্রবেশ করেচে? যা নিয়ে আমরা এত গর্ব করি তার কি অনেকখানি ভুয়ো?

পিতামহী কহিলেন, এর যে কতখানি ভুয়ো সে যে আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না! কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করিতেও যে তাঁর চোখে জল আসিয়া পড়িল তাহা সন্ধ্যার অন্ধকারেও সন্ধ্যার অবিদিত রহিল না। তিনি হাত দিয়া চোখ দুটি মুছিয়া ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, কিন্তু এখন আমি মাঝে মাঝে কি মনে করি জানিস সন্ধ্যা? মানুষে মানুষে ব্যবধানের এই যে মানুষের হাতে-গড়া গণ্ডি, এ কখনো ভগবানের নিয়ম নয়। তঁর প্রকাশ্য মিলনের মুক্ত সিংহদ্বারে মানুষে যতই কাঁটার উপর কাঁটা চাপায়, ততই গোপন গহ্বরে তার অত্যাচারের বেড়া অনাচারে শতচ্ছিদ্র হতে থাকে। তাদের মধ্যে দিয়ে তখন পাপ আর আবর্জনাই কেবল লুকিয়ে প্রবেশ করে।

অতঃপর কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। সন্ধ্যার নিশ্চয় মনে হইতে লাগিল, ইহার সহিত তাহার পিতামহের বহুবিবাহের সত্যই কি একটা কদর্য সম্বন্ধ আছে এবং কিছু না বুঝিয়াও তাহার কেমন যেন ভয় করিতে লাগিল।

ঠাকুরমা বলিলেন, যাও দিদি, ঠাকুরঘরের কাজটি সেরে ফেল গে, নইলে তোমার মা বড় রাগ করবেন।

সন্ধ্যা অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল, তিনি নিজেই করে নেবেন এখন। বলিয়াই সে তাঁহার একটা হাত ধরিয়া কহিল, চল না ঠাকুরমা আমার ঘরে গিয়ে একটু সেকালের গল্প করবে!

এই বলিয়া সে একরকম জোর করিয়া তাঁহাকে টানিয়া তুলিয়া নিজের ঘরের দিকে প্রস্থান করিল।

রাত্রি খুব বেশী হয় নাই, বোধ হয় একপ্রহর হইয়া থাকিবে, কিন্তু শীতের দিনের পল্লীগ্রামে ইহারই মধ্যে অত্যন্ত গভীর মনে হইতেছিল। জ্ঞানদার শয়ন-কক্ষের এক কোণে একটা মাটির প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছিল। ঘরের মেঝেয় বসিয়া জ্ঞানদা এবং তাহারই অদূরে বসিয়া রাসমণি হাত-মুখ নাড়িয়া বুঝাইয়া বলিতেছেন, কথা শোন্‌ জ্ঞানদা, পাগলামি করিস নে। ওষুধটুকু দিয়ে গেছে—খেয়ে ফ্যাল্‌। আবার যেমন ছিল সব তেমনি হবে, কেউ জানতেও পারবে না।

জ্ঞানদা অশ্রুরুদ্ধ-স্বরে বলিল, এমন কথা আমাকে তোমরা কেমন করে বল দিদি! পাপের ওপর এতবড় পাপ আমি কি করে করব? নরকেও যে আমার জায়গা হবে না!

রাসমণি ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, আর এতবড় কুলে কালি দিয়েই বুঝি তুমি স্বর্গে যাবে ভেবেচ? যা রয় সয় তাই কর্‌ জ্ঞানদা, আদিখ্যেতা করে এতবড় একটা দেশপুজ্যি লোকের মাথা হেঁট করে দিসনে।

জ্ঞানদা হাতজোড় করিয়া কাঁদিয়া বলিল, ও আমি কিছুতে খেতে পারব না, আমাকে বিষ দিয়ে তোমরা মেরে ফেলবে, আমি টের পেয়েচি।

রাসমণি মুখখানা অতিশয় বিকৃত করিয়া কহিলেন, তবে, তাই বল্‌ মরবার ভয়ে খাব না। মিছে ধর্ম ধর্ম করিস নে।

জ্ঞানদা কহিল, কিন্তু ও যে বিষ!

রাসমণি বলিলেন, বিষ তা তোর কি? তুই ত আর মরচিস নে। বলিয়াই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর চক্ষের নিমিষে কোমল ও করুণ করিয়া কহিলেন, পাগলী আর বলে কাকে! আমরা কি তোকে খারাপ জিনিস খেতে বলতে পারি বোন? এ কি কখনো হয়? রাসী-বাম্‌নীকে এমন কথা কি কেউ বলতে পারে? তা নয় দিদি—কপালের দোষে যে শত্রুটা তোর পেটে জন্মেচে, সেই আপদ-বালাইটা ঘুচে যাক—কতক্ষণেরই বা মামলা! তারপরে যা ছিলি তাই হ—খা, দা, ঘুরে বেড়া, তীর্থ-ধর্ম বার-ব্রত কর্‌—এ কথা কে-ই বা জানবে, আর কে-ই বা শুনবে!

0 Shares