বামুনের মেয়ে

সন্ধ্যার পর হইতে তাহার দোতলার পড়িবার ঘরটিতে সে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। শীতের হাওয়া বহিতেছে, কিন্তু তবুও ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করা হয় নাই—সব কয়টাই খোলা খাঁখাঁ করিতেছিল। নির্মেঘ নির্মল আকাশের একপ্রান্ত হইতে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় ভাসিয়া যাইতেছে, তাহারই একটুকরা পিছনের মুক্ত বাতায়নের ভিতর দিয়া আসিয়া তাহার পায়ের কাছে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাহার সম্মুখের খোলা বারান্দার অদূরে একটা ছোট নারিকেল বৃক্ষের মাথার উপর পাতায় পাতায় জ্যোৎস্নার আলোক পড়িয়া ঝকঝক করিতেছিল, সে তাহার প্রতি অর্ধ-জাগ্রত অর্ধ-নিদ্রাতুরের ন্যায় চাহিয়া কি যে ভাবিতেছিল তাহার কোন ঠিকানা ছিল না। পাচক আহারের কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিলে, ক্ষুধা নাই বলিয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দিল, এবং দেওয়ালে একটা অন্ধকার স্থান হইতে ঘড়িতে এগারটা বাজিয়া তাহার শোবার সময়টা নির্দেশ করিয়া দেওয়া সত্ত্বেও আজ তাহার নড়িবার ইচ্ছাই হইল না, যেমন ছিল তেমনি নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

হঠাৎ তাহার কানে সদর দরজায় করাঘাতের আওয়াজ এবং পরক্ষণে তাহা খোলার শব্দও শুনিতে পাইল। একবার ইচ্ছা করিল ডাকিয়া হেতু জিজ্ঞাসা করে, কারণ, পল্লীগ্রামে এত রাত্রে সহজে কেহ কাহারও বাটীতে যায় না, কিন্তু উদ্যমের অভাবে প্রশ্ন করা হইল না।

কিন্তু অধিকক্ষণ ভাবিতে হইল না। মুহূর্ত-কয়েক পরেই দ্বারপ্রান্তে নূতন রেশমের শাড়ির প্রবল খসখস শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই কে একজন ঝড়ের মত ঢুকিয়া তাহার পায়ের কাছে উপুড় হইয়া পড়িল।

অরুণ শশব্যস্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল জ্যোৎস্নার আলোকে ইহার পরিধানের রাঙ্গা চেলী চকচক করিতেছে। এ যে কে, তাহা চক্ষের নিমেষে উপলব্ধি করিয়া ভয়ে বিস্ময়ে তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা সেই মুহূর্তেই একেবারে শুকাইয়া উঠিল। সে যে কি বলিবে, কি করিবে, কিছুই ভাবিয়া পাইল না।

কিন্তু তাহারও সময় রহিল না। একটা ভয়ানক মর্মান্তিক চাপা কান্নায় অকস্মাৎ ঘরের বাতাস, ঘরের আঁধার, ঘরের ম্লান আলোক, ঘরের যাহা-কিছু সমস্ত একসঙ্গে একমুহূর্তে যেন চিরিয়া খানখান হইয়া গেল।

মিনিট দুই-তিন হতবুদ্ধির ন্যায় নিঃশব্দে থাকিয়া অরুণ একটুখানি সরিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি সন্ধ্যা?

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার পরিধানের রাঙ্গা চেলীর সঙ্গে সর্বাঙ্গের অলঙ্কার জ্যোৎস্নায় জ্বলিতে লাগিল, সুন্দর ললাটে চন্দ্ররশ্মি পড়িয়া চন্দনের পত্রলেখা দীপ্ত হইয়া উঠিল এবং তাহারই ঈষৎ নিম্নে অশ্রুভরা আয়ত চোখ দুটি জ্বলজ্বল করিতে লাগিল।নারীর এমন রূপ অরুণ আর কখনো দেখে নাই, সে যেন একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল।

সন্ধ্যা কহিল, অরুণদা, আমি পিঁড়ি থেকে পালিয়ে এসেচি তোমাকে নিয়ে যেতে। আর আমার লজ্জা নেই, ভয় নেই, মান-অপমানের জ্ঞান নেই—তুমি ছাড়া আজ আর আমার পৃথিবীতে কেউ নেই—তুমি চল।

কোথায় যাব?

যেখান থেকে এইমাত্র একজন উঠে চলে গেল—সেই আসনের উপরে।

অরুণ মনে মনে অত্যন্ত আহত হইল। কাণ্ডটা কি ঘটিয়াছে সে বুঝিল। কিছু একটা কলহের পর বর-পক্ষীয়েরা জোর করিয়া পাত্র তুলিয়া লইয়া গেছে। হিন্দুসমাজে এরূপ দুর্ঘটনা বিরল নহে, তাই সেই অপরের পরিত্যক্ত আসনে অকস্মাৎ তাহার ডাক পড়িয়াছে। যেমন করিয়াই হউক, আজ সন্ধ্যার বিবাহ হওয়া চাই-ই।

কিন্তু নিজে আঘাত খাইলেও অরুণ প্রতিঘাত করিতে পারিল না, বরঞ্চ সস্নেহ ভর্ৎসনার কণ্ঠে কহিল, ছিঃ—তোমার নিজে আসা উচিত হয়নি সন্ধ্যা। এমন ত প্রায়ই ঘটে—তোমার বাবা কিংবা আর কেউ ত আসতে পারতেন?

বাবা? বাবা ভয়ে কোথায় লুকিয়েচেন! মা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন, তাঁকে ধরাধরি করে তুলেচে। আমি সেইসময়ে তোমার কাছে ছুটে এসে পড়েচি। উঃ—এত বড় সর্বনাশ কি পৃথিবীতে আর কারও হয়েচে? আমরা বাঁচব কি করে?

তাহার শেষ কথাটায় অরুণ পুনরায় ঘা খাইল। কহিল, কিন্তু আমাকে দিয়ে ত তোমাদের কুল রক্ষা হবে না সন্ধ্যা, আমি যে ভারী ছোট বামুন! কিন্তু দেশে আরও অনেক কুলীন আছে—তোমার বাবা হয়ত এতক্ষণ সেই সন্ধানেই গেছেন।

সন্ধ্যা কাঁদিয়া বলিল, না, না, না অরুণদা—বাবা কোথাও যাননি, তিনি ভয়ে পালিয়ে গেছেন। আমাকে আর কেউ নেবে না—কেউ বিয়ে করবে না। কেবল তুমি ভালোবাসো,—কেবল তুমিই আমার চিরদিন মান রাখো।

তাহার ভয়ানক উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায় অরুণ ক্লেশ বোধ করিল, হাত ধরিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে সন্ধ্যা বাধা দিয়া বলিল, না আমি উঠব না—যতক্ষণ পারি তোমার পায়ের কাছেই পড়ে থাকব। কুলরক্ষা হবে না বলছিলে? কার কুল অরুণদা? আমি ত বামুনের মেয়ে নই—আমি নাপিতের মেয়ে! তাও ভাল মেয়ে নই। আজ আমার ছোঁয়া জল কেউ খাবে না! উঃ! এত বড় শাস্তি আমাকে তুমি কেন দিলে ভগবান! আমি তোমার কি করেছিলাম!

অরুণ চমকাইয়া উঠিল। তাহার হঠাৎ মনে হইল বুঝি বা সন্ধ্যা প্রকৃতিস্থা নয়। হয়ত এ-সমস্তই তাহার উষ্ণমস্তিষ্কের উদ্ভট বিকৃত কল্পনা। হয়ত বা এ-সকল কিছুই ঘটে নাই—সে পলাইয়া আসিয়াছে—বাড়িতে তাহাদের এতক্ষণ হুলস্থূল বাধিয়া গিয়াছে। তাহাকে শান্ত করিয়া বাড়ি পাঠাইবার অভিপ্রায়ে সস্নেহে মাথায় হাত রাখিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আচ্ছা, চল সন্ধ্যা, তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাই।

সন্ধ্যা গড় হইয়া প্রণাম করিয়া তাহার পায়ের ধুলো মাথায় লইয়া বলিল, চল। তুমি যে যাবে সে আমি জানতুম। কিন্তু আমার সমস্ত কথা শুনে তবে চল—নইলে কি জানি, তুমিও হয়ত—কি বলেছিলুম তোমাকে একদিন? ছোট বামুন, না? আজ বোধ হয় সেই পাপেই কেবল প্রমাণ হয়ে গেল আমি বামুনের মেয়ে নই। উঃ—আমরা বেঁচে থাকব কি করে অরুণদা?

তাহার মানসিক যাতনার পরিমাণ দেখিয়া অরুণের মন আবার দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া উঠিল, তাহার মনে হইল হয়ত বা যথার্থই কি একটা ঘটিয়াছে—হয়ত বা সে সত্য ঘটনাই বিবৃত করিতেছে। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কে এ কথা প্রমাণ করলে?

0 Shares