বামুনের মেয়ে

রামময়কে ঔষধ দিতে সন্ধ্যা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ভয়ব্যাকুল-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ক্যাস্টর অয়েল অতখানি ত সব খেয়ে আসোনি বাবা?

নাঃ—উঃ—গাড়ুটা কৈ রে?

তবে বুঝি তুমি—

না—না—না—দে না শিগগির গাড়ুটা! পোড়া বাড়িতে যদি কোথাও কিছু পাওয়া যাবে! তবে থাকগে গাড়ু। বলিতে বলিতেই প্রিয়বাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে খিড়কির দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

রামময় কহিল, দিদিঠাকরুন, ওষুধটা তা হলে—

সন্ধ্যা চকিত হইয়া বলিল, ওষুধ? হাঁ, এই যে দিই এনে।

এই যে তুমি বললে ‘আর্‌নি’ নাকি, তাই দু’ফোঁটা দিয়ে দাও দিদিঠাকরুন। মুখুয্যেমশায়ের ওষুধটা না হয়—

সন্ধ্যা অন্তরে ব্যথা পাইয়া কহিল, আমি কি বাবার চেয়ে বেশি বুঝি রামময়?

রামময় লজ্জিত হইয়া বলিল, না—তা না,—তবে মুখুয্যেমশায়ের ওষুধটা বড়ো জোর ওষুধ কিনা দিদিঠাকরুন,—আমি রোগা মানুষ—বরঞ্চ গিয়েই না হয় সাঁতেদের মেধোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে পাঠিয়ে দেব—কাল থেকে তার পেট নাবাচ্চে,—দাঠাকুরের ওষুধ দিলেই ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ঐ তোমার ওষুধটাই আজ দাও দিদিমণি।

সন্ধ্যা বিষণ্ণমুখে কহিল, আচ্ছা, এসো এইদিকে।

এই বলিয়া সে রামময়কে সঙ্গে লইয়া বারান্দা দিয়া পাশের একটা ঘরে চলিয়া গেল।

জগদ্ধাত্রী ঠাকুরঘরের জন্য এক ঘড়া জল আনিতে পুকুরে গিয়াছিলেন, বাড়ি ঢুকিয়াই জলপূর্ণ কলসীটা দাওয়ার উপর ধপ্‌ করিয়া বসাইয়া দিয়া ক্রুদ্ধস্বরে ডাক দিলেন, সন্ধ্যে?

সন্ধ্যা ঘরের মধ্য হইতে সাড়া দিল, যাই মা।

মা কহিলেন, তোর বাবা এখনো ফেরেনি? ঠাকুরপূজো আজ তা হলে বন্ধ থাক?

মেয়ে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, বাবা ত অনেকক্ষণ এসেচেন মা। তেল মেখে নাইতে গেছেন।

কৈ, পুকুরে ত দেখলুম না?

তিনি যে কোথায় ছুটিয়া গেলেন সন্ধ্যা তাহা জানিত। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আজ বোধ হয় তা হলে নদীতে গেছেন। অনেকক্ষণ হলো, এলেন বলে।

জগদ্ধাত্রী কিছুমাত্র শান্ত হইলেন না, বরঞ্চ অধিকতর উত্তপ্তকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, এঁকে নিয়ে আর ত পারিনে, সন্ধ্যে, হয় উনিই কোথাও যান, না হয় আমিই কোথাও চলে যাই। বার বার বলে দিলুম, ভট্‌চায্যিমশাই আসতে পারবেন না, আজ একটু সকাল সকাল ফিরো। তবু এই বেলা—ঠাকুরের মাথায় একটু জল পর্যন্ত পড়তে পেলে না—তা ছাড়া কাল রাত্তিরে কি করে এসেছে জানিস? বিরাট পরামাণিকের সুদের সমস্ত টাকা মকুফ করে একেবারে রসিদ দিয়ে এসেচে।

সন্ধ্যা আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, কে বললে মা?

কেন, বিরাটের নিজের বোনই বলে গেল যে। ভাজকে নিয়ে সে পুকুরে নাইতে এসেছিল।

সন্ধ্যা একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, ভাই-বোনে তাদের ঝগড়া মা, হয়ত কথাটা সত্যি নয়।

মা রাগিয়া বলিলেন, কেন তুই সব কথা ঢাকতে যাস বল দিকি সন্ধ্যে? জ্বর বলে বিরাট নাপতে ডেকে নিয়ে গেছে, ওষুধ খেয়েচে, ধন্বন্তরি বলে পায়ের ধূলো নিয়েচে, জমিদার বলে, গৌরী সেন বলে, ন্যাজ চুলকে দিয়েচে—তারা বলে আর হেসে লুটোপুটি! টাকা যাক, কিন্তু মনে হলো যেন আর ঘরে ফিরে কাজ নেই—ওই কলসীটাই আঁচলে জড়িয়ে পুকুরে ডুবে মরি। আজকাল যেন বড্ড বাড়িয়ে তুলেচে সন্ধ্যে, আমি সংসার চালাই বা কি করে বল্‌ দিকি?

কত টাকা মা?

কত! দশ-বারো টাকার কম নয় বললুম। একমুঠো টাকা কিনা স্বচ্ছন্দে—

কথাটা তাঁহার সমাপ্ত হইতে পাইল না। প্রিয়বাবু আর্দ্রবস্ত্রে ব্যতিব্যস্তভাবে বাড়ি ঢুকিতে ঢুকিতে চেঁচাইয়া ডাকিলেন, সন্ধ্যে, গামছা—গামছা—গামছাটা একবার দে দিকি মা। একোনাইট তিরিশ শক্তি—বাক্সর একেবারে কোণের দিকে— ৭৫৩

জগদ্ধাত্রী অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, একোনাইট ঘোচাচ্চি আমি। শ্বশুরের অন্নে জমিদার সাজতে লজ্জা করে না তোমার? কে বললে বিরাট নাপতেকে সুদ ছেড়ে দিতে। কার জায়গায় তুমি হাড়ী-দুলে এনে বসাও? কার জমি তুমি ‘গোচর’ বলে দান করে এসো? চিরটা কাল তুমি হাড়মাস আমার জ্বালিয়ে খেলে! আজ, হয় আমি চলে যাই, না হয়, তুমি আমার রাড়ি থেকে বার হয়ে যাও।

সন্ধ্যা তীব্রকণ্ঠে কহিল, মা, দুপুরবেলা এ-সব তুমি কি শুরু করলে বল ত?

মা তেমনিভাবে জবাব দিলেন, এর আবার দুপুর-সকাল কি? কে ও? ঠাকুরপুজো সেরে উনুনের ছাইপাঁশ দুটো গিলে যেন বাড়ি থেকে দূর হয়ে যায়। আমি অনেক সয়েচি, আর সইতে পারব না, পারব না, পারব না।

বলিতে বলিতেই তিনি অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া দ্রুতবেগে তাঁহার ঘরের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিলেন।

হুঁ, বলিয়া প্রিয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, বললুম তাদের জমিদার বলেই কি সুদের এতগুলো টাকা ছেড়ে দিতে পারি বিরাট? তোরা বলিস কি? কিন্তু কে কার কথা শোনে? আর তাদেরই বা দোষ দেব কি ? ওষুধ খাবে ত পথ্যির যোগাড় নেই। নেট্রাম দু’শ শক্তি একটা ফোঁটা দিয়ে—

সন্ধ্যার দুই চক্ষে অশ্রু টলটল করিতেছিল, সে অলক্ষ্যে আঁচলে মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, কেন বাবা তুমি মাকে না জানিয়ে এসব হাঙ্গামার মধ্যে যাও?

আমি ত বলি যাব না—কিন্তু প্রিয় মুখুয্যে ছাড়া যে গাঁয়ের কিছুটি হবার জো নেই, তাও ত দেখতে পাই। কোথায় কার রোগ হয়েচে, কোথায় কার—

বক্তব্য সম্পূর্ণ করিতে না দিয়াই সন্ধ্যা চলিয়া গেল এবং তৎক্ষণাৎ শুষ্কবস্ত্র ও গামছা আনিয়া পিতার হাতে দিয়া কহিল, আর দেরি করো না বাবা, ঠাকুরপূজোটি সেরে ফেল। আমি আসচি।

এই বলিয়া সে তাহার ঘরে চলিয়া গেল এবং প্রিয়বাবুও মাথা মুছিতে মুছিতে বোধ করি বা ঠাকুরঘরের উদ্দেশেই প্রস্থান করিলেন। বলিতে বলিতে গেলেন—ইঃ—আবার যে পেটটা কামড়াতে লাগলো! পরাণের নামে—ইঃ—

যে গোলোক চাটুয্যে মহাশয়ের নামে বাঘে ও গরুতে একত্রে একঘাটে জলপান করে বলিয়া সেদিন রাসমণি বারংবার সন্ধ্যাকে ভয় প্রদর্শন করিয়াছিলেন, সেই হিন্দুকুল-চূড়ামণি পরাক্রান্ত ব্যক্তিটি এইমাত্র তাঁহার বৈঠকখানায় আসিয়া বসিয়াছিলেন। তাঁহার পরিধানের পট্টবস্ত্র ও শিখাসংলগ্ন টাটকা একটি করবী পুষ্প দেখিয়া মনে হয় অনতিবিলম্বেই তাঁহার সকালের আহ্নিক ও পূজা সারা হইয়াছে। বাহিরের লোকজন তখনও হাজির হইয়া উঠিতে পারে নাই, ভৃত্য হুঁকায় নল করিয়া তামাক দিয়া গিয়াছিল, সুডৌল ভুঁড়িটি তাকিয়ায় ঠেস দিয়া, অন্যমনস্ক-মুখে তাহাই পান করিবার আয়োজন করিতেছিলেন, এমনি সময়ে অন্দরের কবাটটা নড়িয়া উঠার শব্দে চোখ তুলিয়া বলিলেন, কে?

0 Shares