বামুনের মেয়ে

গোলোক প্রত্যুত্তরে শুধু কেবল একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, মধুসূদন! তুমিই ভরসা!

চোঙদার প্রস্থানের উপক্রম করিতে তিনি ডাকিয়া কহিলেন, আর দেখ, হরেনের কাছ থেকে এলে, রেলের রসিদটা দেখিয়ে যেয়ো।

চোঙদার ঘাড় নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে।

গোলোক কহিলেন, তা হলে আট শ আর পাঁচ শ হলো! বাকী রইল সতের শ—মাসতিনেক সময় আছে—হয়ে যাবে, কি বল হে?

চোঙদার বলিলেন, আজ্ঞে হয়ে যাবে বৈ কি।

গোলোক কহিলেন, তাই তোমাকে তখনই বলেছিলুম চোঙদার, একেবারে ওটা পুরোপুরি হাজার-পাঁচেকের কন্‌টাক্টোই করে ফেল। তখন সাহস করলে না—

চোঙদার কহিলেন, আজ্ঞে, অতগুলো ছাগল-ভেড়া যদি যোগাড় না হয়ে ওঠে—

গোলোক প্রতিবাদ করিলেন না, কহিলেন, তাই ভাল, তাই ভাল। ধর্মপথে একের জায়গায় আধ, আধের জায়গায় সিকি হয় সেও ঢের, কিন্তু অধর্মের পথে মোহরও কিছু নয়। বুঝলে না চোঙদার? মধুসূদন! তুমিই ভরসা!

চোঙদার আর কিছু না বলিয়া প্রস্থান করিলে ভগবদ্ভক্ত গৃহস্থ-সন্ন্যাসী চাটুয্যেমহাশয় দগ্ধ হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চিন্তিতমুখে তামাক টানিতে লাগিলেন, বিষয়কর্ম বোধ করি বা বিষের মতই বোধ হইতে লাগিল, কিন্তু এমনি সময়ে অন্দরের দিকের কবাটটা ঈষৎ উদ্ঘাটিত করিয়া দাসী মুখ বাড়াইয়া কহিল, মাসীমা একবার ভেতরে ডাকচেন।

গোলোক চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন বল্‌ ত সদু?

দাসী কহিল, একটুখানি জলখাবার নিয়ে বসে আছেন মাসীমা।

গোলোক হুঁকাটা রাখিয়া দিয়া একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, তোর মাসীর জ্বালায় আর আমি পারিনে সদু। পর্বদিনটায় যে একবেলা উপবাস করব সে বুঝি তার সইল না! এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং যাইতে যাইতে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া গেলেন, সংসারে থেকে পরকালের দুটো কাজ করার কতই না বিঘ্ন! মধুসূদন! হরি!

সন্ধ্যার শরীরটা কিছুদিন হইতে তেমন ভাল চলিতেছিল না। প্রায়ই জ্বর হইত, এবং পিতার চিকিৎসাধীনে থাকিয়া সে যেন ধীরে ধীরে মন্দের দিকেই পথ করিতেছিল। মা বিপিন ডাক্তারকে ডাকিয়া পাঠাইবেন বলিয়া প্রত্যহ ভয় দেখাইতেছিলেন, এবং এই লইয়া মাতায়-কন্যায় একটু না একটু কলহ প্রায় প্রতিদিনই ঘটিতেছিল। আজ সায়াহ্নবেলায় সন্ধ্যা সম্মুখের বারান্দায় একটি খুঁটি ঠেস দিয়া বসিয়া মাতৃ-প্রদত্ত সাগুর বাটিটা চোখ বুজিয়া নিঃশেষ করিল এবং তাড়াতাড়ি একটি পান মুখে পুরিয়া দিয়া কোনমতে সেগুলার ঊর্ধ্বগতি নিবারণ করিল। এই খাদ্যবস্তুটার প্রতি তাহার অতিশয় বিতৃষ্ণা ছিল, কিন্তু তথাপি না খাওয়া এবং কম খাওয়া লইয়া আর তাহার কথা সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা হইল না।

কোথাও না কোথাও হইতে মা যে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াছেন, ইহা সে নিশ্চয় জানিত। ইতিপূর্বে বোধ হয় সে একখানা বই পড়িতেছিল—তাহার খোলা পাতাটা উপুড় করিয়া তাহার কোলের উপর রাখা ছিল, সেইখানা পুনরায় হাতে তুলিয়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেই শুনিতে পাইল প্রাঙ্গণের একপ্রান্ত হইতে ডাক আসিল, খুড়ীমা, কৈ গো?

যে বাড়ি ঢুকিয়াছিল সে অরুণ। তাহার জামাকাপড় এবং পরিশ্রান্ত চেহারা দেখিলেই বুঝা যায় সেই এইমাত্র অন্যত্র হইতে আসিতেছে।

মুহূর্তের জন্য সন্ধ্যার পাণ্ডুর মলিন মুখের উপর একটা রক্তিমাভা দেখা দিয়া গেল। সে চোখ তুলিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি বুঝি কোলকাতা থেকে আসচ অরুণদা?

অরুণ কাছে আসিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, হাঁ, কিন্তু তোমাকে এমন শুক্‌নো দেখাচ্চে কেন? আবার জ্বর নাকি?

সন্ধ্যা বলিল, ঐ-রকম কিছু একটা হবে বোধ হয়; কিন্তু তোমার চেহারাটাও ত খুব তাজা দেখাচ্চে না।

অরুণ হাসিয়া কহিল, চেহারার আর অপরাধ কি? সারাদিন নাওয়া-খাওয়া নেইআচ্ছা প্যাটার্ন ফরমাস করেছিলে যা হোক, খুঁজে খুঁজে হয়রান। এই নাও।

এই বলিয়া সে পকেট হইতে একটা কাগজের মোড়ক বাহির করিয়া সন্ধ্যার হাতে গুঁজিয়া দিয়া বলিল, খুড়ীমা কৈ? কাকা বেরিয়েছেন বুঝি? গেল-শনিবারে কিছুতেই বাড়ি আসতে পারলাম না—তাই ওটা আনতে দেরি হয়ে গেল। কি বুনবে, পাখি-পক্ষী, না ঠাকুর-দেবতা? না গোলাপফুলের—

সন্ধ্যা কহিল, সে ভাবনার ঢের সময় আছে; কিন্তু যা আনতে সাতদিন দেরি হলো, তা দিতে কি ঘণ্টা-খানেক সবুর সইত না, ইস্টিসান থেকে বাড়ি না গিয়ে এখানে এলে কেন?

অরুণ সহাস্যে কহিল, নাওয়া-খাওয়া ত? সে সন্ধ্যার পরে। কিন্তু ঘন ঘন এত অসুখ হতে লাগল কেন বল ত?

তাহার ‘সন্ধ্যা’ কথাটার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন নিগূঢ় কটাক্ষ সন্ধ্যার কর্ণমূলে আঘাত করিয়া একটুখানি রাঙ্গা করিয়া দিল, কিন্তু যেন লক্ষ্যই করে নাই এমনিভাবে সে রাগ করিয়া কহিল, তারই বা আর বাকী কি অরুণদা? যাও, আর মিছিমিছি দেরি করতে হবে না।

প্রত্যুত্তরে অরুণ পুনরায় হাসিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু জগদ্ধাত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার নিজের মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। তিনি ক্রোধে সমস্ত মুখখানা কালো করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং কন্যাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, পানটা আর চিবোস নে সন্ধ্যে, ওটা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে যত পারিস হাসি-তামাশা কর্‌।

বলিয়াই কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত-মাত্র না করিয়া দ্রুতপদে ঘরে চলিয়া গেলেন।

অকস্মাৎ কি যেন একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল। অরুণ বজ্রাহতের ন্যায় নিশ্চল নির্বাক হইয়া রহিল এবং সন্ধ্যা বিবর্ণ হইয়া উঠিল, কিছুক্ষণের জন্য সায়াহ্নের আকাশতল হইতে সমস্ত আলো যেন একেবারে নিবিয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত এইভাবে থাকিয়া মুখের পান ফেলিয়া দিয়া, সহসা কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিয়া উঠিল, কেন তুমি এ-বাড়িতে আর এস অরুণদা? আমাদের সর্বনাশ না করে কি তুমি ছাড়বে না?

প্রথমটা অরুণ একটা কথাও কহিতে পারিল না, তারপরে ধীরে ধীরে শুধু বলিল, মুখের পান ফেলে দিলে সন্ধ্যা—আমি কি সত্যিই তোমার অস্পৃশ্য?

0 Shares