বিপ্রদাস

দাসী কহিল, না।মা মাঝে মাঝে কালী-দর্শনের জন্যে কলকাতায় এলে এ-বাড়িতেই থাকেন কিনা, তাই ও-সব হবার জো নেই।

বন্দনা মনে মনে বলিল, এখানেও সেই প্রবল-প্রতাপ মা। আচার-অনাচারের কঠিন শাসন। সে ফিরিয়া গিয়া কাপড় জামা গামছা প্রভৃতি লইয়া আসিল,কহিল, এখানে দু-চারদিন যদি থাকতে হয়, তোমাকে কি বলে ডাকব? এখানে তুমি ছাড়া আর বোধ হয় কোন দাসী নেই?

সে বলিল, আছে, কিন্তু তার অনেক কাজ।ওপরে আসবার সময় পায় না।যা দরকার হয় আমাকেই আদেশ করবেন, দিদি, আমার নাম অন্নদা। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের লোক, হয়ত অনেক দোষ-ত্রুটি হবে।

তাহার বিনয়বাক্যে বন্দনা মনে মনে খুশী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় তোমার বাড়ি অন্নদা? তোমার কে কে আছে?

অন্নদা বলিল, বাড়ি আমার এঁদের গ্রামেই—বলরামপুরে। একটি ছেলে, তাকে এঁরাই লেখাপড়া শিখিয়ে কাজ দিয়েছেন, বৌ নিয়ে সে দেশেই থাকে। ভালই আছে দিদি।

বন্দনা কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, তবে নিজে তুমি এখনো চাকরি কর কেন, বৌ-ব্যাটা নিয়ে বাড়িতে থাকলেই ত পার?

অন্নদা কহিল, ইচ্ছে ত হয় দিদি, কিন্তু পেরে উঠিনে। দুঃখের দিনে বাবুদের কথা দিয়েছিলুম নিজের ছেলে যদি মানুষ হয়, পরের ছেলেদের মানুষ করার ভার নেব। সেই ভারটা ঘাড় থেকে নামাতে পারিনে। দেশের অনেকগুলি ছেলে এই বিদেশে লেখাপড়া করে। আমি না দেখলে তাদের দেখবার কেউ নেই।

তারা বুঝি এই বাড়িতেই থাকে?

হাঁ, এই বাড়িতে থেকেই কলেজে পড়ে। কিন্তু আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে,আমি বাইরেই আছি, ডাকলেই সাড়া পাবেন।

বন্দনা বাথরুমে ঢুকিয়া দেখিল ভিতরে নানাবিধ ব্যবস্থা। পাশাপাশি গোটা-তিনেক ঘর,স্পর্শদোষ বাঁচানোর যতপ্রকার ফন্দি-ফিকির মানুষের বুদ্ধিতে আসিতে পারে তাহার কোন ত্রুটি ঘটে নাই। বুঝিল এসব মায়ের ব্যবহারের জন্য। পাথরের মেঝে, পাথরের জলচৌকি, একদিকে গোটা-তিনেক প্রকাণ্ড তাঁবার হাঁড়া, বোধ হয় গঙ্গাজল রাখার জন্য,—নিত্য মাজাঘষায় ঝকঝক করিতেছে—তিনি কবে আসিয়াছিলেন এবং আবার কবে আসিবেন নিশ্চিত কেহ জানে না, তথাপি অবহেলার চিহ্নমাত্র কোথাও চোখে পড়িবার জো নাই। যেন এখানেই বাস করিয়া আছেন এমনি সযত্ন-সতর্ক ব্যবস্থা। এ যে কেবল হুকুম করিয়া, শাসন চালাইয়াই হয় না, তাহার চেয়েও বড় কিছু-একটা সমস্ত নিয়ন্ত্রিত করিতেছে, এ কথা বন্দনা চাহিবামাত্রই অনুভব করিল। এবং এই মা, এই স্ত্রীলোকটি যে এ-সংসারে সর্বসাধারণের কতখানি ঊর্ধ্বে অবস্থিত এই কথাটা সে বহুক্ষণ পর্যন্ত নিজের মনে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিল। গল্পে, প্রবন্ধে, পুস্তকে ভারতীয় নারীজাতির বহু দুঃখের কাহিনী সে পড়িয়াছে, তাহাদের হীনতার লজ্জায় নিজে নারী হইয়া সে মর্মে মরিয়া গেছে—ইহা মিথ্যাও নয়,—কিন্তু এই ঘরের মধ্যে আজ একাকী দাঁড়াইয়া সে-সকল সত্য বলিয়া মানিয়া লইতেও তাহার বাধিল।

বাহিরে আসিতে অন্নদা হাসিমুখে কহিল, বড্ড দেরি হয়ে গেল যে দিদি, প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক, ওঁরা সব নীচে খাবার ঘরে অপেক্ষা করে আছেন। চলুন।

তোমাদের বড়বাবু কাছারি-ঘর থেকে বেরিয়েছেন?

হাঁ, তিনিও নীচে আছেন।

আমাদের সঙ্গে বোধকরি খাবেন না?

অন্নদা সহাস্যে কহিল, খেলেও ত সেই দুপুরের পরে দিদি। আজ আবার তাও নেই। একাদশী, সন্ধ্যের পরে বোধ হয় কিছু ফলমূল খাবেন।

বন্দনা কি করিয়া যেন বুঝিয়াছিল এ গৃহে এই স্ত্রীলোকটি ঠিক দাসী জাতীয় নয়। কহিল, তিনি ত আর বামুনের ঘরের বিধবা নয়, একাদশীর উপোস করবেন কোন্‌ দুঃখে? কাল গাড়িতে একাদশী না হোক দশমীর উপবাস ত এমনিই হয়ে গেছে।

অন্নদা বলিল, তা হোক, উপোস ওঁর গায়ে লাগে না। মা বলেন, আর জন্মে তপস্যা করে বিপিন এ জন্মে উপোস-সিদ্ধির বর পেয়েছে। ওঁর খাওয়া দেখলে অবাক হতে হয়।

বন্দনা নীচে আসিয়া দেখিল, তাহাদের অভ্যস্ত চা রুটি ডিম প্রভৃতি টেবিলে সুসজ্জিত, এবং পিতা ও সস্ত্রীক পাঞ্জাবের ব্যারিস্টার ক্ষুধায় চঞ্চল। অধৈর্য তাহাদের প্রায় শেষ সীমায় উপনীত, মুহূর্তে খবরের কাগজ ফেলিয়া দিয়া সাহেব অনুযোগের কণ্ঠে কহিলেন, ইঃ—এত দেরি মা, সকালবেলাটায় আর ত কোন কাজ হবে না দেখচি।

বিপ্রদাস অদূরে বসিয়াছিল; বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মুখুয্যেমশাই, আপনি খাবেন না?

বিপ্রদাস কথাটা বুঝিল, হাসিয়া কহিল, চা আমি খাইনে। খাই শুধু ডাল-ভাত। তার সময় এ নয়—আমার জন্যে চিন্তা নেই, তুমি বসে যাও।

বন্দনা ইহার উত্তর দিল না, পিতা এবং অতিথি দুজনকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, আমার অপরাধ হয়ে গেছে। বলে পাঠান উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। খাবার ইচ্ছে আমার নেই, কিন্তু আপনারা আর অপেক্ষা করবেন না—আরম্ভ করে দিন। আমি বরঞ্চ আপনাদের চা তৈরি করে দিই। এই বলিয়া সে তৎক্ষণাৎ কাজে লাগিয়া গেল।

সকলেই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। চাকরটা একধারে দাঁড়াইয়াছিল, সে কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। পিতা উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, অসুখ করেনি ত মা? সস্ত্রীক ব্যারিস্টারসাহেব কি যে বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন না।

বন্দনা চা তৈরি করিতে করিতে কহিল, না বাবা, অসুখ করেনি, শুধু খেতে ইচ্ছে করচে না।

তা হলে কাজ নেই। কাল বেশী রাত্রের খাওয়াটা বোধ করি তেমন হজম হয়নি। তা ছাড়া দিনের বেলা পিত্তি পড়ে গেল কিনা।

তাই বোধ হয় হবে। বেলা হলে মুখুয্যেমশায়ের সঙ্গে বসে ডাল-ভাত খাব, এ-বাড়িতে সে হয়ত হজম করতে পারব।

কথাটায় আর কেহ তেমন খেয়াল করিল না, কিন্তু বিপ্রদাসের মুখের উপর দিয়া যেন একটা কাল ছায়া মুহূর্তের জন্য ভাসিয়া গেল।

চাকরটা কি ভাবিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, আজ একাদশী; ও-বেলায় দুটো ফলমূল ছাড়া আর ত কিছু খান না।

বন্দনা এইমাত্র এ কথা শুনিয়া আসিয়াছিল, তথাপি বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিল, শুধু ফলমূল? বেশ হালকা খাওয়া। সে-ই বোধ হয় খুব ভাল হবে। না, মুখুয্যেমশাই?

0 Shares