বিপ্রদাস

কৌতূহল অদম্য হইয়া উঠিল। বুঝিল, হঠাৎ দেখা হইয়া গেলে লজ্জা রাখিবার ঠাঁই রহিবে না, এই রাত্রে ঘর ছাড়িয়া নীচে আসার কোন কারণই দেওয়া যাইবে না, কিন্তু আগ্রহ সংবরণ করিতে পারিল না।

ধ্যানের কথা বন্দনা পুস্তকে পড়িয়াছে, ছবিতে দেখিয়াছে, কিন্তু ইহার পূর্বে কখনো চোখে দেখে নাই। নিঃশব্দ রাত্রির নিঃসঙ্গ অন্ধকারে সেই দৃশ্যই আজ তাহার দৃষ্টিগোচর হইল। বিপ্রদাসের দুই চোখ মুদ্রিত, তাহার বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহ আসনের পরে স্তব্ধ হইয়া আছে, উপরের বাতির আলোটা তাহার মুখে, কপালে প্রতিফলিত হইয়া পড়িয়াছে—বিশেষ কিছুই নয়, হয়ত আর কোন সময়ে দেখিলে বন্দনার হাসিই পাইত, কিন্তু তন্দ্রাজড়িত চক্ষে এ মূর্তি আজ তাহাকে মুগ্ধ করিয়া দিল। এইভাবে কতক্ষণ সে যে দাঁড়াইয়াছিল তাহার হুঁশ নাই, কিন্তু হঠাৎ যখন চৈতন্য হইল তখন পূবের আকাশ ফরসা হইয়া গেছে, এবং ভৃত্যের দল ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিল বলিয়া। ভাগ্য ভাল যে, ইতিমধ্যে জাগিয়া উঠিয়া কেহ তাহার সম্মুখে আসিয়া পড়ে নাই। আর সে অপেক্ষা করিল না, ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া নিজের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িতেই গভীর নিদ্রামগ্ন হইতে তাহার মুহূর্ত বিলম্ব হইল না।

দ্বারে করাঘাত করিয়া অন্নদা ডাকিল, দিদি, বড্ড বেলা হয়ে গেল যে, উঠবেন না?

বন্দনা ব্যস্ত হইয়া দ্বার খুলিয়া বাইরে আসিয়া দাঁড়াইল, বাস্তবিকই বেলা হইয়াছে, লজ্জিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এঁরা বোধ হয় আজও অপেক্ষা করে আছেন? একটু সকালে আমাকে তুলে দিলে না কেন? স্নান করে তৈরি হয়ে নিতে ত এক ঘণ্টার আগে পেরে উঠব না অন্নদা।

তাহার বিপন্ন মুখের পানে চাহিয়া অন্নদা হাসিয়া বলিল, ভয় নেই দিদি, আজ আর ওঁরা সবুর করতে পারেন নি,—শেষ করে নিয়েছেন—এখন যতক্ষণ খুশি স্নান করুন গে, কেউ পেছু ডাকবে না।

শুনিয়া বন্দনা যেন বাঁচিয়া গেল। সেও হাসিমুখে কহিল, তোমাদের অনেক জিনিসই পছন্দ করিনে সত্যি, কিন্তু এটা করি। সকলের দল বেঁধে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে যে গেলবার পালা নেই এ মস্ত স্বস্তি।

অন্নদা বলিল, কিন্তু সকালে কি আপনার ক্ষিদে পায় না দিদি?

বন্দনা কহিল, একদিনও না। অথচ ছেলেবেলা থেকে নিত্যই খেয়ে আসচি। আচ্ছা যাই, আর দেরি করব না।—এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

ঘণ্টা-দুই পরে নীচে বিপ্রদাসের সহিত তাহার দেখা হইল। সে কাছারি-ঘর হইতে কাজ সারিয়া বাহির হইতেছিল। বন্দনা নমস্কার কহিল।

চা খাওয়া হলো?

হাঁ।

ওঁরা অপেক্ষা করতে পারলেন না, কিন্তু তোমারই—

বন্দনা থামাইয়া দিয়া কহিল, সেজন্যে ত অনুযোগ করিনি মুখুয্যেমশাই।

বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, মেজাজের বাহাদুরি আছে তা অস্বীকার করব না, কিন্তু দু বোনের মধ্যে প্রভেদটি যেন চন্দ্র-সূর্যির মত। শুনলাম নাকি শীঘ্রই যাচ্ছ বিলেতে শিক্ষাটা পাকা করে নিতে। যাও, ফিরে এসে একটা খবর দিয়ো, গিয়ে একবার মূর্তিটা দেখে আসব।

শুনিয়া বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, কিন্তু জবাব দিল না।

বিপ্রদাস কহিল, সে দেশে শুনেচি বেলা বারোটা পর্যন্ত লোককে ঘুমুতে হয়। কঠিন-সাধনা। তোমাকে কিন্তু কষ্ট করে সাধতে হবে না, এদেশ থেকেই আয়ত্ত হয়ে রইল।

বন্দনা এবারও হাসিল, কিন্তু তেমনিই চুপ করিয়া বিপ্রদাসের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। নিতান্তই সাদাসিধে সাধারণ ভদ্র চেহারা। হাস্য-পরিহাসে স্নেহশীল, তাহাদেরই একজন। অথচ কাল রাত্রির নীরবতায়, নির্জন গৃহের মধ্যে স্তব্ধ-মৌন এই মূর্তিটিকে কি যে রহস্যাবৃত মনে হইয়াছিল, এই দিবালোকে সেই কথা স্মরণ করিয়া তাহার কৌতুকের সীমা রহিল না।

মুখুয্যেমশাই, এঁরা কোথায়? কাউকে ত দেখচি নে?

বিপ্রদাস কহিল, তার মানে তাঁরা নেই। অর্থাৎ শ্বশুর মশাই এবং সস্ত্রীক ব্যারিস্টারমশাই—তিনজনেই গেছেন হাওড়ায় রেলওয়ে স্টেশনে—গাড়ি রিজার্ভ করতে।

বন্দনা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, সস্ত্রীক ব্যারিস্টারমশাই করতে পারেন, কিন্তু বাবা করতে যাবেন কেন? তাঁর ছুটি শেষ হতে এখনো ত আট-দশ দিন বাকী আছে। তা ছাড়া আমাকে না বলে?

বিপ্রদাস কহিল, বলবার সময় পাননি, বোধ করি ফিরে এসেই বলবেন। সকালে বোম্বাইয়ের অফিস থেকে জরুরী তার এসেচে—মুখের ভাব দেখে সন্দেহ রইল না যে না গেলেই নয়।

কিন্তু আমি? এত শিগগির আমি যেতে যাব কেন?

বিপ্রদাসও সেই সুরে সুর মিলাইয়া কহিল, নিশ্চয়ই, যেতে যাবে কেন? আমিও ত ঠিক তাই বলি।

বন্দনা বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসু-মুখে চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস কহিল, বোনটিকে একটা তার করে দাও না,—দেওরটিকে সঙ্গে করে এসে পড়ুন। তোমাদের মিলবেও ভাল, অতিথি-সৎকারের দায় থেকে আমিও অব্যাহতি পেয়ে বাঁচব।

বন্দনা সভয়ে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, সে কি সম্ভব হতে পারে মুখুয্যেমশাই? মা কি কখনো এ প্রস্তাবে রাজী হবেন? আমাকে তিনি ত দেখতে পারেন না।

বিপ্রদাস কহিল, একবার চেষ্টা করেই দেখো না। বল ত তার করার একটা ফরম পাঠিয়ে দিই,—কি বল?

বন্দনা উৎসুক-চক্ষে ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া শেষে কি ভাবিয়া বলিল, থাক গে মুখুয্যেমশাই, এ আমি পারব না।

তবে থাক।

আমি বরঞ্চ বাবার সঙ্গে না হয় চলেই যাই।

সেই ভাল, এই বলিয়া বিপ্রদাস চলিয়া গেল।

খাবার টেবিলের উপর পিতার টেলিগ্রামটা পড়িয়াছিল, বন্দনা খুলিয়া দেখিল সত্যই বোম্বাই অফিসের তার। অত্যন্ত জরুরী,—বিলম্ব করিবার জো নাই।

বন্দনা ঘরে গিয়া আরেকবার তোরঙ্গ গুছাইতে প্রবৃত্ত হইল।

বাবা তখনও ফিরেন নাই, ঘণ্টা-কয়েক পরে অন্নদা ঘরে ঢুকিয়া কহিল, আপনার নামে একটা টেলিগ্রাম এসেছে দিদি, এই নিন।

আমার টেলিগ্রাম? সবিস্ময়ে হাতে লইয়া বন্দনা খুলিয়া দেখিল বলরামপুর হইতে মা তাহাকেই তার করিয়াছেন। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইয়াছেন পিতার সহিত সে যেন কোনমতে ফিরিয়া না যায়। বৌমা দ্বিজুকে লইয়া রাত্রের গাড়িতে যাত্রা করিতেছে।

0 Shares