বিপ্রদাস

বন্দনা নীরবে চাহিয়া রহিল, দ্বিজদাস বলিতে লাগিল, জানো নিশ্চয়ই যে একদিন তোমার প্রতি ছিল তাঁর যত বড় বিতৃষ্ণা আর একদিন জন্মালো তাঁর তেমনি গভীর স্নেহ। রূপে, গুণে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, কাজকর্মে, দয়া-মায়ায় একা বৌদি ছাড়া মার কাছে কেউ তোমার আর জোড়া রইলো না। তোমাকে ম্লেচ্ছ বলে সাধ্য কার? তখনি মা কোমর বেঁধে প্রমাণ করতে বসতেন এতবড় নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণ-তনয়া সমস্ত ভারতবর্ষ হাতড়ালে খুঁজে মিলবে না। এই বলিয়া দ্বিজদাস নিজের রসিকতার আনন্দে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল।

এ হাসি বন্দনার অত্যন্ত খারাপ লাগিলেও সে নিজেও হাসিয়া ফেলিল।

দ্বিজদাস বলিল, হাসচ কি বন্দনা, আসলে সেই ত হয়েছে সকলের বিপদ।

বন্দনা কহিল, এতে বিপদ হবে কিসের জন্যে?

দ্বিজদাস বলিল, তবে অবধানপূর্বক শ্রবণ কর। দয়াময়ীর দুই পুত্র,—জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ। জ্যেষ্ঠের প্রতি যেমন অগাধ আশা ও ভরসা, কনিষ্ঠের প্রতি তেমনি অপরিসীম সন্দেহ ও ভয়। তাঁর ধারণা অপদার্থতায় পৃথিবীতে কনিষ্ঠের সমকক্ষ নেই। কিন্তু মা ত! গর্ভে ধারণ করে সন্তানকে সহজে জলাঞ্জলি দিতে পারেন না,—অতএব মনে মনে পুত্রের সদ্গতির উপায় নির্ধারণ করলেন তোমার স্কন্ধে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে সংসার-মরুভূমি নির্ভয়ে উত্তীর্ণ করে দেবেন। কিন্তু বিধাতা বিরূপ, অকস্মাৎ কাল সন্ধ্যায় আবিষ্কৃত হল বন্দনার স্কন্ধদেশে স্থান নাই, ছোট সে তরী—অর্থাৎ কিনা দয়াময়ীর সকল সঙ্কল্প, সকল স্বপ্নজাল ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত করে কে এক সুধীরচন্দ্র তথায় পূর্বাহ্ণেই সমারূঢ়, তাঁকে নড়ায় সাধ্য কার! এই বলিয়া সে আর এক দফা উচ্চহাস্যে ঘর ভরিয়া দিল।

বন্দনা কয়েক মুহূর্ত নীরবে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, এ-রকম বিকট হাসির কারণটা আপনার কি? মা অপদস্থ হয়েছেন তাই, না আপনি নিজে অব্যাহতি পেলেন তারই আনন্দোচ্ছ্বাস? কোন্‌টা?

দ্বিজদাস স্মিতমুখে বলিল, যদিচ এর কোনটাই নয়, তথাপি কবুল করতে বাধা নেই যে অকস্মাৎ পদস্খলনে মা-জননীর এই ধরাশায়িনী মূর্তিতে দর্শক হিসেবে আমি কিঞ্চিৎ অনাবিল আনন্দ-রস উপভোগ করেচি। তবে, ক্ষতি তাঁর বিশেষ হবে না যদি এর থেকে তিনি অন্ততঃ এটুকু শিক্ষা লাভ করে থাকেন যে, সংসারে বুদ্ধি পদার্থটা তাঁরই নিজস্ব নয়, ওতে অপরেরও দাবী থাকতে পারে। কারণ, আমাকে না হোক দাদাকেও মা যদি তাঁর ষড়যন্ত্রের আভাস দিতেন, আর কিছু না ঘটুক, এ কর্মভোগ থেকে তাঁকে নিষ্কৃতি দিতে পারা যেত। দাদা এবং আমি উভয়েই জানতুম, তুমি অন্যের বাগ্‌দত্তা বধূ, পরস্পর প্রণয়শৃঙ্খলে আবদ্ধ,

অতএব এ ব্যবস্থার অন্যথা ঘটা সম্ভবপরও নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, আপনারা কার কাছে কবে শুনলেন?

দ্বিজদাস বলিল, তোমার বাবার কাছে। এখানে আমাদের আসার দিনই রায়সাহেব তোমাদের ভালবাসা, বাগ্‌দান ও আশু বিবাহের মনোজ্ঞ আলোচনায় আমাদের দু ভায়ের দু জোড়া কানেই সুধাবর্ষণ করেছিলেন। না না, রাগ করো না বন্দনা, সাদাসিধে নিরীহ মানুষ, চিত্তের প্রফুল্লতায় সুসংবাদ আত্মীয়স্বজনের কাছে চেপে রাখবার প্রয়োজনই মনে করেন নি।

বন্দনা কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, এই জন্যেই কি মুখুয্যেমশাই মৈত্রেয়ীকে দেখতে আমাদের পাঠিয়েছিলেন?

দ্বিজদাস বলিল, সে ঠিক জানিনে। কারণ, দাদার সমস্ত মনের কথা দেবতাদেরও অজ্ঞাত। শুধু এটুকু জানি তাঁর মতে মৈত্রেয়ী দেবী সর্বগুণান্বিতা কন্যা। বলরামপুরের ধনী ও মহামাননীয় মুখুয্যে-পরিবারের অযোগ্যা নয়।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মৈত্রেয়ী দেবী সম্বন্ধে আপনার অভিমতটা কি?

দ্বিজদাস বলিল, এ বাড়িতে ও প্রশ্ন অবৈধ। আমি তৃতীয় পক্ষ। প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষ, অর্থাৎ মা ও দাদা যে-কোন নারীর গলদেশে আমাকে বন্ধন করে দেবেন, তাঁরই কণ্ঠলগ্ন হয়ে আমি পরমানন্দে ঝুলতে থাকব। এই এ গৃহের সনাতন রীতি, এর পরিবর্তন নেই।

তাহার বলার ভঙ্গীতে বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, বলিল, আর ধরুন, মৈত্রেয়ীর পরিবর্তে বন্দনার গলদেশেই যদি তাঁরা আপনাকে বেঁধে দেন?

দ্বিজদাস ললাটে করাঘাত করিয়া বলিল, হায় বন্দনা, সে আশা বৃথা! দুষ্ট রাহু পূর্ণচন্দ্র ভক্ষণ করেছে, কোথাকার সুধীরচন্দ্র লাফ মেরে এসে প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিলে, দ্বিজদাসের স্বর্ণলঙ্কা চোখের সম্মুখে ভস্মীভূত হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গ বন্ধ করো কল্যাণি,

অভাগার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাবে।

তাহার নাটকীয় উক্তিতে বন্দনা আর একবার হাসিয়া ফেলিল বলিল, সোনার লঙ্কার সবটা ত পোড়েনি দ্বিজুবাবু, অশোক-কাননটা রক্ষে পেয়েছিল! হৃদয় বিদীর্ণ না হতেও পারে।

দ্বিজদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, সে আশ্বাস বৃথা। শ্রীরামচন্দ্রের বরাতের জোর ছিল, কিন্তু আমি সর্ববাদিসম্মত হতভাগ্য দ্বিজদাস। আমার দগ্ধ অদৃষ্টে সমস্ত আশাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,—কিছুই অবশিষ্ট নেই।

না যায়নি।

কি যায়নি?

বন্দনা জোর দিয়া বলিল, কিছুই যায়নি। দ্বিজদাস হতভাগ্য বলে বন্দনা হতভাগিনী নয়। আমার অদৃষ্টকে পুড়িয়ে ছাই করে এ সাধ্য সুধীরের নেই। সংসারে কারও নেই, মায়েরও না, আপনার দাদারও না।

তাহার শান্ত-দৃঢ় কণ্ঠস্বরে দ্বিজদাস অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।

চুপ করে রইলেন যে? আমার মনের কথা আপনি টের পাননি, আজ কি এই ছলনা করতে চান?

না, ছলনা করতে চাইনে বন্দনা, অনুমান করেছিলুম তা মানি। কিন্তু সন্দেহও ছিল প্রচুর।

বন্দনা কহিল, সে সন্দেহ যেন আজ থেকে যায়। ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু সন্দেহ আমার ত ছিল না। সেই প্রথম দিন থেকেই না। বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এলুম, একলা উপরের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে হাত তুলে ইঙ্গিতে আমাকে বিদায় দিলেন, মাত্র একটি বেলার পরিচয়, তবু কি অর্থ তার আমার কাছে এতটুকু অস্পষ্ট ছিল ভাবেন?

0 Shares