বিপ্রদাস

কিন্তু আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন? আমাকে আপনার কিসের দরকার?

দরকার আমার নয়, অনুদিদির, সে-ই ভয় পেয়েচে। তার মুখে শুনলুম, পরশু তোমার বোনের বিয়ে, চুকে গেলে একদিন এসো। আমার জবানি তোমার মেজদি কিছু খবর পাঠিয়েছেন সেগুলো তোমাকে শোনাবো।

আজ পারেন না?

না, আজ নয়।

বন্দনা মিনিট-দুই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তার পরে কহিল, মুখুয্যেমশাই, অসুখ আপনার বেশি নয়, দু’দিনেই সেরে উঠবেন। আমি জানি আমাকে প্রয়োজন নেই, তবুও আপনার সেবার ভান করেই আমি থাকবো, সেখানে ফিরে যাবো না। আমার তোরঙ্গটা আনতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি, আপনি আপত্তি করতে পারবেন না।

বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, কিসের আপত্তি বন্দনা, তোমার থাকার? কিন্তু বোনের বিয়ের যে!

বিয়ে ত আমার সঙ্গে নয়—আমি না গেলেও বোনের বিয়ে আটকাবে না।

সত্যি থাকবে না বিয়েতে?

না।

কিন্তু এরই জন্যে যে কলকাতায় রয়ে গেলে?

বন্দনা কহিল, যাচ্ছিলুম বোম্বায়ে, স্টেশন থেকে ফিরে এলুম, কিন্তু ঠিক এই জন্যেই নয়। দূরে থাকি, আপন সমাজের প্রায় কাউকে চিনিনে, মুখে মুখে কত কথা শুনি, গল্প-উপন্যাসে কত কি পড়ি, তাদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারিনে—মনে হয় বুঝি বা আমরা সমাজছাড়া এক-ঘরে। মাসীমা ডাকলেন, ভাবলুম প্রকৃতির বিয়ের উপলক্ষে দৈবাৎ যে সুযোগ মিললো, এমন আর পাবো না। তাই ফিরে এলুম মুখয্যেমশাই।

বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, কিন্তু সেই বিয়েটাই যে বাকী এখনো। দলের লোকদের চেনবার সুযোগ পেলে কৈ?

সুযোগ পুরো পাইনি সত্যি, কিন্তু যতটা পেয়েচি সে-ই আমার যথেষ্ট।

নিজের সঙ্গে এঁদের কতখানি মিললো বন্দনা? শুনতে পারি কি?

বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, বলিল, আপনি সেরে উঠুন তার পরে বিস্তারিত করে শোনাবো।

চাকরে আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। শিয়রের জানালাটা বন্ধ করিয়া বন্দনা ঔষধ খাওয়াইল, কহিল, আর বসে নয়, এবার আপনাকে শুতে হবে। এই বলিয়া এলোমেলো বিছানাটা ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিয়া বালিশগুলা ঠিক করিয়া দিল, বিপ্রদাস শুইয়া পড়িলে পা হইতে বুক পর্যন্ত চাদর দিয়া ঢাকিয়া দিয়া বলিল, সেরে উঠে নিজেকে শুদ্ধশুচি করে তুলতে না জানি কত গোবর-গঙ্গাজলই না আপনার লাগবে!

বিপ্রদাস দুই হাত প্রসারিত করিয়া বলিল, এত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সেবাযত্ন করতেও একটু জানো দেখচি।

জানি একটু? না মুখুয্যেমশাই, এ চলবে না। আমাদের সম্বন্ধে আপনাকে আরো একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে।

অর্থাৎ—

অর্থাৎ আমাদের নিন্দেই যদি করেন সজ্ঞানে করতে হবে। এমনধারা চোখ বুজে যা-তা বলতে আমি দেবো না। বিপ্রদাসের মুখে পরিহাসের চাপা হাসি, কহিল, এই আমাদেরটা কারা বন্দনা? কাদের সম্বন্ধে আরও খোঁজ-খবর নিতে হবে? যাদের থেকে এইমাত্র পালিয়ে এলে তাদের?

কে বললে আমি পালিয়ে এলুম?

আমি বলচি।

জানলেন কি করে?

জানলুম তোমার মুখ দেখে।

বন্দনা ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া কহিল, দ্বিজুবাবু একদিন বলেছিলেন দাদার চোখে কিছুই এড়ায় না। কথাটা যে কতখানি সত্যি আমি বিশ্বাস করিনি। আপনার অসুখ আমি চাইনে, কিন্তু এ আমাকে সত্যিই উদ্ধার করেছে। সত্যিই পালিয়ে এসে আমি বেঁচে গেছি। যে কটা দিন আপনি অসুস্থ আমি আপনার কাছেই থাকবো, তার পরে সোজা বাবার কাছে চলে যাবো—মাসীর বাড়িতে আর ফিরবো না। দূর থেকে যাদের দেখতে চেয়েছিলুম তাদের দেখা পেয়ে গেছি, এমন ইচ্ছে আর নেই যে একটা দিনের জন্যেও ওদের মধ্যে গিয়ে কাটিয়ে আসি।

বিপ্রদাস নীরবে চাহিয়া রহিল। বন্দনা বলিতে লাগিল, ওদের শুধু শাড়ী গাড়ি আর মিথ্যে ভালবাসার গল্প। কোথায় নৈনি আর কোথায় মুসৌরির হোটেল আমি জানিও নে, কিন্তু ওদের মুখে মুখে তার কি-যে নোংরা চাপা ইঙ্গিত,—শুনতে শুনতে ইচ্ছে হতো, কোথাও যেন ছুটে পালিয়ে যাই। আজ এই ঘরের মধ্যে বসে মনে হচ্ছে যেন এই ক’টা দিন অবিশ্রাম এলোমেলো ধূলোবালির ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে আমার দিনরাত কেটেছে। এর ভেতর ওরা বাঁচে কি করে মুখুয্যেমশাই?

বিপ্রদাস বলিল, সে রহস্য আমার জানার কথা নয়। মরুভূমির মধ্যে কবরগুলো যেমন টিকে থাকে বোধ করি তেমনি করে।

বন্দনা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দুঃখের জীবন। ওদের না আছে শান্তি, না আছে কোন ধর্মের বালাই। কিছু বিশ্বাস করে না, কেবলি করে তর্ক। একটু থামিয়া বলিল, খবরের কাগজ পড়ে, ওরা জানে অনেক। পৃথিবীর কোথায় কি নিত্য ঘটচে কিছুই ওদের অজানা নয়। কিন্তু আমি ত ও-সব পড়তে পারিনে, তাই অর্ধেক কথা বুঝতেই পারতুম না। শুনতে শুনতে যখন অরুচি ধরে যেতো তখন আর কোথাও সরে গিয়ে নিশ্বেস ফেলে বাঁচতুম। কিন্তু তাদের ত ক্লান্তি নেই, তার বকতে সবাই যেন মেতে উঠতো।

কিন্তু তোমার বাবা কাছে থাকলে সুবিধে হত বন্দনা। খবরের কাগজের সব খবর তাঁকে জিজ্ঞেসা করলেই টের পেতে—ওদের কাছে ঠকতে হতো না।

বন্দনা হাসিমুখে সায় দিয়া বলিল, হাঁ, বাবার সে বাতিক আছে। সমস্ত খবর খুঁটিয়ে না পড়ে তাঁর তৃপ্তি নেই। কিন্তু আমাদের মেয়েদের তাতে দরকার কি বলুন ত? কি হবে জেনে পৃথিবীর কোথায় কি দিনরাত ঘটচে!

এ কথা তোমার মেজদির মুখে শোভা পায় বন্দনা, তোমার মুখে নয়। এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল।

বন্দনা বলিল, তারা কি আমার মেজদির চেয়ে বেশী জানে মনে করেছেন? একটুও না। শূন্য কলসী বলেই মুখ দিয়ে তাদের এত আওয়াজ বার হয়। তাদের আর কিছু না জেনে থাকি এ খবরটা জেনে নিয়েচি মুখুয্যেমশাই।

কিন্তু জ্ঞান ত চাই।

না চাইনে! জ্ঞানের আস্ফালনে মুখের মধু তাদের বিষ হয়ে উঠচে। জানে তারা আমার মেজদির মতো সবাইকে ভালবাসতে? জানে না। পারে তারা মেজদির মতো ভক্তি করতে? পারে না। ওদের বন্ধুই কি কেউ আছে? মনে হয় কেউ নেই এমনি পরস্পরের বিদ্বেষ। তাদের অভাবটাই কি কম? বাইরের জাঁকজমকে বোঝাই যাবে না ভেতরটা ওদের এত ফোঁপরা। কিসের জন্যে ওদের নিয়ে এত মাতামাতি? সমস্ত ভেতরটা যে একেবারে ঘূণে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

0 Shares