বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, হয়েছে কি বন্দনা, এত রাগ কিসের? কেউ টাকা ঠকিয়ে নেয়নি ত?
না, ঠকিয়ে নেয়নি, ধার নিয়েছে।
কত?
বেশি না চার-পাঁচ শ’।
তাদের নাম জানো ত?
জানতুম কিন্তু ভুলে গেছি। এই বলিয়া বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, কহিল, ছি ছি, এত অল্প পরিচয়েও যে কেউ কারও কাছে টাকা চাইতে পারে আমি ভাবতেও পারিনে। বলতে মুখে বাধে না, লজ্জার ছায়া এতটুকু চোখে পড়ে না, এ যেন তাদের প্রতিদিনের ব্যাপার। এ কি করে সম্ভব হয় মুখুয্যেমশায়?
বিপ্রদাসের মুখ গম্ভীর হইল, কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, তোমার মনটাকে তারা বড় বিষিয়ে দিয়েছে বন্দনা, কিন্তু সবাই এমনি নয়, ঐ মাসীমার দলটাই তোমাদের সমস্ত দল নয়। যারা বাইরে রয়ে গেল খুঁজলে হয়ত তাদেরও একদিন দেখা পাবে।
বন্দনা বলিল, পাই ভালোই। তখন ধারণা আমার সংশোধন করবো, কিন্তু যাদের দেখতে পেলুম তারা সবাই শিক্ষিত, সবাই পদস্থ লোকের আত্মীয়। গল্প-উপন্যাসের রঙ-করা ভাষায় সজ্জিত হয়ে এরা দূরে থেকে আমার চোখে কি আশ্চর্য অপরূপ হয়েই না দেখা দিত। মনে গর্বের সীমা ছিল না, ভাবতুম আমাদের মেয়েদের পেছিয়ে পড়ার দুর্নাম এবার ঘুচলো। আমার সেই ভুল এবার ভেঙ্গেচে মুখুয্যেমশাই।
বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, ভুল কিসের? এঁরা যে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন এ ত মিথ্যে নয়।
শুনিয়া বন্দনা হাসিল, বলিল, না মিথ্যে হবে কেন, সত্যিই। তবু আমার সান্ত্বনা এই যে সংখ্যায় এঁরা অত্যন্ত স্বল্প,—এঁদেরই গড়ের মাঠের মনুমেন্টের ডগায় ঠেলে তুলে হট্টগোল বাধানো যেমন নিষ্ফল তেমনি হাস্যকর।
বিপ্রদাস বলিল, এ হচ্চে তোমার আর এক ধরনের গোঁড়ামি। স্বধর্মত্যাগের বিপদ আছে বন্দনা,—সাবধান।
বন্দনা এ কথায় কান দিল না, বলিতে লাগিল, এই নগণ্য দলের বাইরে রয়েছে বাঙলার প্রকাণ্ড নারীসমাজ। এদের আমি আজও দেখিনি, বাইরে থেকে বোধ করি দেখাও মেলে না, তবু মনে হয় বাতাসের মতো এরাই আছে বাঙালীর নিশ্বাসে মিশে। জানি, এদের মধ্যে আছে ছোট, আছে বড়,—বড়র দৃষ্টান্ত রয়েছে আমার মেজদিতে, তাঁর শাশুড়ীতে,—এবার কলকাতায় আসা আমার সার্থক হলো মুখুয্যেমশাই। আপনি হাসচেন যে?
ভাবছি, টাকার শোকটা মানুষকে কি রকম বক্তা করে তোলে। এ দোষটা আমারও আছে কিনা।
কোন্ টাকার শোক—সেই পাঁচশ’-র?
তাই ত মনে হচ্চে।
বন্দনা হাসিয়া বলিল, টাকার জন্যে আর ভাবনা নেই। আপনাকে সেবা করার মজুরী হিসাবে ডবল আদায় করে ছাড়বো। আপনি না দেন মায়ের কাছে আদায় হবে।
অন্নদা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আটটা বাজে, বিপিনের খাবার সময় হলো।
বন্দনা ব্যস্ত হইয়া বলিল, চলো অনুদি যাচ্চি। কেমন, যাই মুখুয্যেমশাই?
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, যাও। কিন্তু সেবার ত্রুটি হলে মজুরী কাটা যাবে।
ত্রুটি হবে না মশাই, হবে না। বলিয়া সেও হাসিমুখে বাহির হইয়া গেল।
পরিচ্ছেদ – আঠারো
বন্দনা বলিল, খাবার হয়ে গেছে নিয়ে আসি?
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তোমার কেবলি চেষ্টা হচ্চে আমার জাত মারার। কিন্তু সন্ধ্যে-আহ্নিক এখনো করিনি, আগে তার উদ্যোগ করিয়ে দাও।
আমি নিজে করে দেবো মুখুয্যেমশাই?
নইলে কে আর আছে এখানে যে করে দেবে? কিন্তু মার পূজোর ঘরে যেতে পারবো না—গায়ে জোর নেই,—এই ঘরে করে দিতে হবে। আগে দেখবো কেমন আয়োজন করো, খুঁত ধরবার কিছু থাকে কিনা, তখন বুঝে দেখবো খাবার তুমি আনবে, না আমাদের বামুনঠাকুর আনবে।
শুনিয়া বন্দনা পুলকে ভরিয়া গেল, বলিল, আমি এই শর্তেই রাজী। কিন্তু একজামিনে পাস যদি হই তখন কিন্তু মিথ্যে ছলনায় ফেল করাতে পারবেন না। কথা দিন।
দিলুম কথা। কিন্তু আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে কি তোমার এত লাভ?
তা আমি বলবো না, এই বলিয়া বন্দনা দ্রুত প্রস্থান করিল।
মিনিট-দশেকের মধ্যে সে স্নান করিয়া প্রস্তুত হইয়া একটি জলপূর্ণ ঘটি লইয়া প্রবেশ করিল। ঘরের যে দিকটায় খোলা জানালা দিয়া পূবের রোদ আসিয়া পড়িয়াছে সেই স্থানটি জল দিয়া ভাল করিয়া মার্জনা করিয়া নিজের আঁচল দিয়া মুছিয়া লইল, পূজার ঘর হইতে আসন কোশাকুশি প্রভৃতি আনিয়া সাজাইল, ধূপদানি আনিয়া ধূপ জ্বালাইল, তারপরে বিপ্রদাসের ধুতি গামছা এবং হাত-মুখ ধোবার পাত্র আনিয়া কাছে রাখিয়া দিয়া বলিল, আজ সময় নেই ফুল তুলে এনে মালা গেঁথে দেবার, নইলে দিতুম, কাল এ ত্রুটি হবে না। কিন্তু আধ-ঘণ্টা সময় দিলুম, এর বেশি নয়। এখন বেজেছে ন’টা—ঠিক সাড়ে ন’টায় আবার আসবো। এর মধ্যে আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না, আমি চললুম। এই বলিয়া সে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া প্রস্থান করিল।
বিপ্রদাস কোন কথা না বলিয়া শুধু চাহিয়া রহিল। আধ-ঘণ্টা পরে বন্দনা যখন ফিরিয়া আসিল তখন সন্ধ্যাবন্দনা সমাপ্ত করিয়া বিপ্রদাস একটা আরামচৌকিতে হেলান দিয়া বসিয়াছে।
পাস না ফেল মুখুয্যেমশাই?
পাস ফার্স্ট ডিভিশনে। আমার মাকেও হার মানিয়েছ। কার সাধ্য বলে তোমাকে ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছদের ইস্কুল-কলেজে পড়ে বি. এ. পাস করেচ।
এবার তা হলে খাবার আনি?
আনো। কিন্তু তার আগে এগুলো রেখে এসো গে, বলিয়া বিপ্রদাস কোশাকুশি প্রভৃতি দেখাইয়া দিল।
এ আর আমাকে বলে দিতে হবে না মশাই জানি, বলিয়া পূজার পাত্রগুলি সে হাতে তুলিয়া লইয়াছে এমন সময়ে ঘরের বাহিরে বারান্দায় অনেকগুলি উঁচুগোড়ালি জুতার খুট্ খুট্ শব্দ একসঙ্গে কানে আসিয়া পৌঁছিল, এবং পরক্ষণে অন্নদা দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া বলিল, বন্দনাদিদি, তোমার মাসীমা—
মাসী এবং আরও দুই-তিনটি অল্পবয়সী মেয়ে একেবারে ভিতরে আসিয়া পড়িলেন, বিপ্রদাস দাঁড়াইয়া উঠিয়া অভ্যর্থনা করিল, আসুন।
মাসী বলিলেন, নীচে থেকেই খবর পেলুম বিপ্রদাসবাবু ভালো আছেন—
বিপ্রদাস কহিল, হাঁ, আমি ভাল আছি।
আগন্তুক মেয়েরা বন্দনাকে দেখিয়া যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হইল, পায়ে জুতা নাই, গায়ে জামা নাই, ভিজা চুলে গরদের শাড়ী ভিজিয়াছে; এলো কালো চুলের রাশি পিঠের পরে ছড়ানো, দুই হাতে পূজোর জিনিসপত্র, তাহার এ মূর্তি তাহাদের শুধু অদৃষ্টপূর্ব অপরিচিত নয়, অভাবনীয়। বন্দনা বলিল, আপনারা দোর ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান, এগুলি রেখে আসি গে।